এক মহিলার প্রকাশ্যে শ্লীলতাহানির ছবি ছড়িয়ে পড়া নিয়ে তপ্ত ফেসবুক। তা এ রকম ছবি দেখলে এমনিতে বহু লোকেই রেগে গিয়ে শেয়ার করবেন, অপরাধীদের সবার সামনে নিয়ে আসার শুভ তাড়না থেকেই হয়তো। এ ক্ষেত্রেও শেয়ার হয়েছে। তবে যাঁরা করেছেন, তাঁরা করেছেন আরও একটি কারণে। এক হিন্দু নারীর (এবং মুসলিম কর্তৃক) সম্মানহানি বলে। তাই অনেক ‘সহি হিন্দু’র গর্জন শোনা গিয়েছিল। এই গর্জানোই হয়তো আবার নতুন দাঙ্গা হিসেবে বর্ষিত হতে পারত, যদি না কারও তত্ত্বতল্লাশিতে উঠে আসত এই ছবিটি আসলে একটি ভোজপুরি সিনেমার দৃশ্য। যে প্রোফাইল থেকে এসেছিল, সেটি আরও নানাবিধ বিদ্বেষমূলক পোস্ট করে চলেছিল। প্রভূত সম্ভাবনা— সেটি এই সব উসকানির জন্যই বানানো এক ফেক প্রোফাইল।
কিন্তু, এই ওড়াতে বলা, সরাতে বলা-র সঙ্গে বাক্স্বাধীনতার কোনও দ্বন্দ্ব আছে কি? বিশেষ করে এই সময়, যখন ‘বারণ’ করা হচ্ছে এমন কিছু করতে, যা করলে অন্যের অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। বারণ করা হচ্ছে লেখালিখি করতেই। কথায় কথা বাড়ে, তর্কে তর্ক। অতএব কথা কোয়ো না, শব্দ কোরো না, সম্ভাব্য দাঙ্গাবাজ জনতাকে নিদ্রা যেতে দাও। ডাকাডাকি তো কোরোই না।
কথার আওয়াজ আর ডাকাডাকি। এইখানে এসেই বোধ হয় তফাতটা হয়ে যায়। দ্বন্দ্বের ধন্দ আর থাকে না। কেন? জনতাকে ডাকাডাকি, খোঁচাখুঁচি। একটি যেমন এই ভোজপুরি ছবিটি। একে সত্যি ভেবে খেপে গিয়ে জনতা কিছু করতেই পারে। তাই ছবি যে হেতু ভুয়ো, তাকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই। অবকাশ থাকত, যদি সেটি সত্যি হত। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কি সরিয়ে ফেলার দাবি যুক্তিযুক্ত? এই তর্ক খুঁচিয়ে তোলে দাঙ্গার খবর মিডিয়ায় দেখানো উচিত কি না— এই বহু পুরনো প্রশ্নকেও। সেটা বড় তর্ক। আপাতত বলা যায়, এটা প্রেক্ষিত-নির্ভর। যেমন, আগামাথাপিছু কেটে পরিবেশন করলে অনেক কিছুরই মানে বদলে যেতে পারে। এটিও মিথ্যাচার। মিথ্যা অবশ্যবর্জ্য।
অন্যটি, দাঙ্গাবাজ জনতাকে খোঁচাখুঁচি। হ্যাঁ, জনতা আর দাঙ্গাবাজ জনতা— দুটিকে আলাদা করাই ভাল। দাঙ্গাবাজদের দাঙ্গা ছড়ানোর জন্য লাগে অজুহাতমাত্র। তারা সুযোগের অপেক্ষাতেই থাকে। তাই, এই ‘মিম’-এর মতো যা দিয়ে খোঁচানো হচ্ছে তাকে নিষিদ্ধ করে বা সেই ব্যক্তিকে হাজতে পুরে কি লাভ আছে বিশেষ? ইচ্ছাকৃত খোঁচাখুঁচি যদি হয়েই থাকে, তা হলে সেটাও এসেছে অপর ধর্মের দাঙ্গাবাজদের উসকানিতেই। আসল দোষী দু’তরফের দাঙ্গাবাজরা। এদের শাস্তি হোক।
কিন্তু তা না করে যদি এই ছবি আঁকা বা এই লেখার জন্যই দাঙ্গাবাজরা খেপল বলে সব কিছু বন্ধের দাবি তোলা হয়, তবে তা বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছতে পারে। দাঙ্গাবাজরা খেপতই, আর এদের খেপা(নো)র কারণটি রাজনৈতিক, ধর্ম অছিলামাত্র। তার জন্য বারণের লিস্ট পর্বতসমান করতে থাকলে চলাফেরাই দায় হয়ে উঠবে। তা হলে তো গরু, শুয়োর খাওয়াও বন্ধ করে দিতে হয়, খাজুরাহো, কোনার্ক, মুঘল মিনিয়েচার পেন্টিংকে ঘোমটা বা বোরখা পরিয়ে দিতে হয়, কুমারসম্ভবের পাতায় দেবদেবীদের রমণদৃশ্য বর্ণনায় কালো কালি ফেলতে হয়। তা হলে তো এই ধর্মানুভূতিকে ফুলের ঘা-টুকুও লাগানো যাবে না। এই আতুপুতু দাবি স্ববিরোধী, এবং অযৌক্তিক। আজ গরুর মাংস খেলে দাঙ্গা করার মতো সমস্যা তৈরি হলে, কাল গরুকে ‘মা’ না বলে ‘গরু’ ডাকা নিয়েও সমস্যা তৈরি হতে পারে।
ঠিক সে রকমই সমস্যাজনক ধর্মকে বর্জনের দাবিটিও। ধর্ম বা ধার্মিক মানেই সমস্যার, ফলে এই বাঁশটি না থাকলে আর কোনও বেসুরো বাঁশি বাজার সমস্যাই থাকছে না— এ কথা যাঁদের, তাঁরা কিন্তু মাথাব্যথার রোগে মাথা কাটার নিদানটিই হাঁকছেন। যেটা অবাস্তব এবং ভুল। কারণ এই ভারতে আছে এক অন্য ভারত। বিভিন্ন শ্রেণিতে, জীবনে ধর্ম আছে ওতপ্রোত ভাবে। আচারবিচার, পালাপার্বণের লোকায়ত ধর্ম, যাপন আর সংস্কৃতির তিন গাছি মিলে যে বিনুনি বাঁধা, তার একটি গাছি উপড়ানো কি সহজ? প্রয়োজনও কি আছে? সেখানে কতটা আছে মেলামেশা নিয়ে গোঁড়ামি আর ভিন্নের প্রতি বিদ্বেষ? যদি না খুঁচিয়ে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়? সে ক্ষেত্রেও এর প্রতিষেধক আছে এই লোকায়ত জীবনচর্যার মধ্যেই। যিনি এখান থেকে বেরোতে চান না, তাঁকে কেন ছিন্নমূল করা?
আর, এঁদের আরাধ্য তো সর্বশক্তিমান। তাই অবিশ্বাসী বা ভিন্নধর্মে বিশ্বাসীদের অপমানে তাঁদের যে কিছু যায় আসে না বা এলেও তাঁরা নিজেরাই তার প্রতিকার করতে পারবেন— বিশ্বাসীদের এটা বোঝানো দরকার। তবে এ সবের চেয়েও বেশি দরকার এই নিয়ে সবার মধ্যে কথাবার্তা আর ভাবের আদানপ্রদানের সুতো বুনে যাওয়া।
সব জনতা যেমন দাঙ্গাবাজ হন না, তেমনই সব ধার্মিক, ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু মানুষই মৌলবাদী হন না, সে তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন। এটা ঠিক যে, এই ধর্মভীরু মানুষদেরই দাঙ্গাবাজ বা মৌলবাদীরা খেপিয়ে তোলেন। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও ঠিক, এই উসকে দেওয়া লোকজন না থাকলে এই ধার্মিক মানুষজনই এক বৃন্তে দুটি কুসুম হয়ে বাস করেন। কবিকল্পনা নয়, বাস্তব। যে বাস্তব ছিল এক সময় আখলাকের গ্রামে। মাত্র দুটি সংখ্যালঘু পরিবার নিয়েও সেখানে কোনও হিংসার ঘটনা স্মৃতিতে ছিল না গ্রামবাসীদের। যে বাস্তব ছিল বাদুড়িয়াতেও ক’দিন আগে অবধি। ওই গ্রামেরই লোকজন জানিয়েছেন, সেখানে আগে কখনও এ রকম সাম্প্রদায়িক ঝামেলা হয়নি। এমন ঘটনার দিনও পাড়ার মুসলমান চাচারাই আগলে রেখে বাঁচিয়েছিলেন শৌভিককে। হাতে হাত রেখে এখনও জাগছেন আমজাদ-গণেশ, খলিল-নির্মলের মতো অনেকেই।