প্রণব বর্ধন
প্রশ্ন: ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (ইউবিআই) প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে আপনার মতপার্থক্য হল সম্প্রতি। আপনার অবস্থান কোথায় আলাদা?
প্রণব বর্ধন: ইউবিআই হচ্ছে দেশের সব নাগরিককে নিঃশর্তে কিছু সরকারি অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা। অমর্ত্যদা এবং জঁ দ্রেজ়, দু’জনেরই মূল আপত্তি দুটো। এক, ভারতে এত দিনের চেষ্টায় সাধারণ মানুষের জন্য যে অধিকারগুলো আদায় করা গিয়েছে— খাদ্য, মিড ডে মিল, গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিরাপত্তা যোজনা (এনরেগা) ইত্যাদি। ইউবিআই চালু করলে এই প্রকল্পগুলোতে সরকারের উৎসাহ কমে যাবে। আমি বলতে চাই, ওই প্রকল্পগুলো যদি মার খায়, তবে আমি ইউবিআই চাই না। এই প্রকল্পগুলোকে একেবারে না ছুঁয়ে ইউবিআই করতে ঠিক কত টাকা লাগতে পারে, সেই হিসেব আমি কষেছি, এই কারণেই। আমার মনে হয়, অমর্ত্যদা-জঁ দ্রেজ়ের আপত্তিটা মূলগত নয়, কৌশলগত।
ওঁদের দ্বিতীয় আপত্তি হল, লোকের হাতে যদি আমরা টাকা দিয়ে দিই, তবে লোকে ওটা বেসরকারি ক্ষেত্রে খরচ করবে। সরকার ঠিকমতো পরিষেবা না দিতে পারলেও গরিবকে সেই সরকারি পরিষেবা কিনতেই বাধ্য করা হবে, এটা তো ঠিক নয়। আমি মনে করি, গরিব মানুষের একটা স্বাধিকার থাকা দরকার। তাঁকে টাকা দেওয়া হলে সেই টাকা তিনি কী ভাবে খরচ করবেন, সে বিষয়ে তাঁর স্বাধীনতা থাকা দরকার। অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁদের পুয়োর ইকনমিকস বইয়ে এই কথা বলেছেন। জঁ এবং অমর্ত্যদারা তো এনরেগা চান। সেখানে তো মানুষের হাতে টাকা দেওয়া হয়। ফারাক হল, এনরেগায় শুধু দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষরা টাকা পান, ইউবিআই-তে সবাইকে টাকা দেওয়া হবে; আর, এনরেগায় কাজ করলে টাকা পাওয়া যায়, ইউবিআই-তে নিঃশর্তে টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু, মূল কথা নগদ দেওয়া। এনরেগায় সেই টাকা তাঁরা কোথায় খরচ করবেন, সেই সিদ্ধান্ত তাঁদের। এনরেগার ক্ষেত্রে টাকা দেওয়ায় আপত্তি না থাকলে ইউবিআই-তেই বা থাকবে কেন?
আরও পড়ুন: কথা বলতেন ধীরে ধীরে, যুক্তির পরে যুক্তি সাজিয়ে
মুশকিল হল, অনেক লোকের পক্ষেই এনরেগায় খাটা সম্ভব নয়। বয়স্ক, বাচ্চা, শারীরিক প্রতিবন্ধী। ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম যে হেতু নিঃশর্তে টাকা দেবে, ফলে তাঁরাও পাবেন। আবার, ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের তিন-চতুর্থাংশই এখনও বাইরের কাজ করেন না। ফলে, তাঁদের কোনও রোজগার নেই। বাড়িতে তাঁদের অবস্থান সবার নীচে। তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যদি নিয়মিত একটা টাকা জমা পড়ে, ক্ষমতায়নের পথে সেটা অনেক দূর যেতে পারে। এ ছাড়া, যে সব পেশা এখনও সামাজিক ভাবে প্রান্তিক— নোংরা পরিষ্কারের কাজ, জন্তু-জানোয়ারের ছাল ছাড়ানোর কাজ, যৌনকর্মী— তাঁদের বেশির ভাগই স্বেচ্ছায় এই পেশায় থাকেন না, বিকল্প নেই বলে বাধ্য হন। তাঁদের জন্য যদি একটা নিয়মিত অনুদানের ব্যবস্থা হয়, তবে হয়তো অনেকেই ভিন্নতর পেশা বেছে নিতে পারবেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে কোনও পেনশন নেই, সেখানেও এই টাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। আমি ইউবিআই-কে বিভিন্ন ধরনের প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের অস্ত্র হিসেবেই দেখি। অমর্ত্যদারা প্রধানত দারিদ্র দূরীকরণের মাধ্যম হিসেবে দেখেন। দেখায় ফারাক আছে।
প্র: অন্যান্য উন্নয়ননীতির সঙ্গে ইউবিআই-এর সম্পর্ক ঠিক কী রকম?
উ: একটা উদাহরণ দিই। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস। এতে যে গরিব চাষির লাভ হচ্ছে না, বরং ফড়েরা সুবিধা পাচ্ছে, সেটা তো বটেই, এতে চাষের স্বাভাবিক ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। ধান চাষ করতে প্রচুর জল লাগে। পঞ্জাবে ধান চাষ করার কোনও যুক্তি হয় না, কারণ সেখানে বৃষ্টি কম। কিন্তু এমএসপি-র টানে চাষিরা ধান ফলাচ্ছেন, ভূগর্ভস্থ জল তুলে। তাতে জলস্তর ক্রমে নেমে যাচ্ছে। তেলঙ্গানায় এমএসপি-র পরিবর্তে ‘রায়তু বন্ধু’ নামে একটা ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যাতে চাষের গোড়ায় প্রত্যেক কৃষককে একরপিছু চার হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় এখন কৃষিতে সহায়ক মূল্যের পরিবর্তে এই রকম ইনকাম সাপোর্ট বা সহায়ক আয় অনুদানের ব্যবস্থা করেছে। এটা ভাল, কিন্তু যার জমি যত বেশি, সরকারের থেকে সে তত বেশি টাকা পাচ্ছে। ফলে, গরিবের তুলনায় ধনী কৃষকের লাভ। আর ভূমিহীন কৃষকদের জন্য কিছুই নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সম্প্রতি একই ধরনের প্রকল্প ঘোষণা করল। ইউবিআই চালু হলে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে এই বিভেদ থাকবে না। সবাই সমান অঙ্কের টাকা পাবেন।
আরও পড়ুন: নেতাজির প্রখর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা কি মোদী-শাহ জুটি
প্র: আপনার হিসেব অনুযায়ী, ইউবিআই-এ প্রতি বছর প্রত্যেক পরিবার ১৬,০০০ টাকা পাবে। এই টাকা আসবে কোথা থেকে?
উ: আমি আরও বেশি টাকা দেওয়ার পক্ষপাতী। গরিবের জন্য অন্যান্য সামাজিক প্রকল্পের গায়ে যেন আঁচ না লাগে, তা নিশ্চিত করতে গিয়েই টাকার অঙ্কটা কমে যাচ্ছে। এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসেব অনুযায়ী, জিডিপি-র ৬% নন-মেরিট সাবসিডি, অর্থাৎ যে ভর্তুকি বড়লোকের জন্য। কিন্তু, তাঁদের তো খরচ করার সামর্থ্য আছে। কাজেই, এই টাকা ইউবিআই-তে যেতে পারে। তার পর, প্রতি বছর বাজেটে দেখবে, ‘রেভিনিউ ফোরগন’ বলে একটা হিসেব দেওয়া থাকে। মানে, সরকার যত টাকার কর ছাড় দিল। এটাও মোটামুটি জিডিপির ৬%। কিছু কর ছাড়ের নিশ্চয় প্রয়োজন আছে। এই ছাড়ের এক-তৃতীয়াংশ ইউবিআই-এর জন্য নাও। এ ছাড়া ভারতে কর বাড়ানোর বহু সুযোগ আছে। কৃষির আয় এখনও করহীন। বড় কৃষকদের আয়ে কর বসানো যায়। ভারতে বিত্ত কর তুলে দেওয়া হল। ইনহেরিট্যান্স ট্যাক্স নেই। আমেরিকার মতো ধনতান্ত্রিক দেশেও এই উত্তরাধিকার কর আছে। আমাদেরও থাকা দরকার। শেয়ার বাজারে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী আয়ের ওপর করের হার কম। এগুলো তো সবই বড়লোককে সুবিধা করে দেওয়া। বন্ধ করা প্রয়োজন। এর থেকেও জিডিপি-র দুই শতাংশ টাকা তুলে নেওয়া যায়। সব মিলিয়ে, জিডিপি-র ১০% টাকা আসবে।
কেউ আপত্তি করতে পারেন, ইউবিআই-ই তো একমাত্র নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোরও গুরুত্ব আছে। সেই দাবিটা মেনে নেওয়া যায়। জিডিপি-র যে ১০% টাকার হিসেব দিলাম, এটাকে চার ভাগ করে ইউবিআই, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোতে সমান ভাগে দেওয়া যায়। তাতে ইউবিআই-এর ভাগে যে টাকা পড়বে, তাতে প্রত্যেক পরিবারকে বছরে ১৬,০০০ টাকা দেওয়া যায়। এই টাকাটা না দিতে পারার কোনও কারণ নেই। প্রশ্ন হল, বড়লোকদের ভর্তুকি কমিয়ে দিলে, তাঁদের ওপর করের চাপ বাড়ালে তাঁরা হয়তো চেঁচামেচি করবেন। সেটা বন্ধ করার জন্য নীচের তলা থেকে উঠে আসা রাজনীতি প্রয়োজন।
সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত
প্রণব বর্ধন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া (বার্কলে)-র অর্থনীতির প্রফেসর এমেরিটাস