পরীক্ষার ফল নিয়ে মাতামাতি বিকারের পর্যায়ে পৌঁছেছে

দোহাই, ওদের রেহাই দিন

এটা নিশ্চয় দুঃখের কারণ, দুশ্চিন্তার কারণ, কিন্তু ভেঙে পড়ার কারণ নয়। জীবনে উন্নতি করার অনেক রাস্তা আছে, পরীক্ষা পাশ তার একটা মাত্র। আমি কিন্তু এমন ছেলেমেয়ের কথা বলছি না।

Advertisement

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৮ ০০:০০
Share:

দশ-বারো ক্লাসের বড় বড় পরীক্ষাগুলির ফল প্রকাশ হতে শুরু করেছে। এই পর্ব বেশ কয়েক সপ্তাহ জুড়ে চলতে থাকবে। সেই সঙ্গে হাজার হাজার গৃহে নেমে আসবে বিষাদের ছায়া। অনেক বাড়ির ছেলে বা মেয়ে হয়তো সত্যি খারাপ ফল করেছে, পাশ করতেই পারেনি। এটা নিশ্চয় দুঃখের কারণ, দুশ্চিন্তার কারণ, কিন্তু ভেঙে পড়ার কারণ নয়। জীবনে উন্নতি করার অনেক রাস্তা আছে, পরীক্ষা পাশ তার একটা মাত্র। আমি কিন্তু এমন ছেলেমেয়ের কথা বলছি না। বলছি তাদের কথা যারা দুর্দান্ত ফল করেছে, অন্যেরা এত নম্বর পেলে বর্তে যেত। তবু তাদের মন ভীষণ খারাপ, হয়তো কোনও দুর্যোগ বাধিয়ে বসছে। বাপ-মা খুড়ো-জ্যাঠারা তাদের উপর চোটপাট করছেন, বোর্ড-কাউন্সিল শিক্ষক-পরীক্ষকদের শাপান্ত করছেন।

Advertisement

কারণটা কী? দুর্দৈবে ছেলেটি বা মেয়েটি অমুক অঙ্কটা গুলিয়ে ফেলেছিল, ইতিহাসের তমুক প্রশ্নে জুত করতে পারেনি; বা গন্ডগোলটা ধরাই গেল না, কিন্তু কী ভাবে তিন নম্বর কম পাওয়ায় প্রথম বিশ জনের মধ্যে নাম উঠল না। কৈশোরের আকাশে সূর্যগ্রহণের মতো অন্ধকার নেমে এল।

পরীক্ষাব্যবস্থায় বিস্তর দোষত্রুটি আছে, তাতে কিছু ছেলেমেয়ে সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে প্রায়ই কোনও গন্ডগোল হয়নি; পরীক্ষার্থী ও তাদের আপনজনের আশাটাই ছিল অবাস্তব।

Advertisement

এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে এগারো লাখের উপর পরীক্ষার্থী। যদি তর্কের খাতিরে ধরি তাদের মধ্যে মেধাবীরাই সবচেয়ে ভাল ফল করবে, তাদের সর্বোচ্চ এক শতাংশের সংখ্যা এগারো হাজার, তারও এক দশমাংশ এগারোশো। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে, এর মধ্যে কার স্থান হবে প্রথম আর কার ৫০০তম, তা নেহাত ভাগ্যের ব্যাপার। গ্রহরত্ন তাগাতাবিজের ভাগ্য নয়, অসংখ্য ছোট ছোট বাস্তব পরিস্থিতি: ঠিক কী প্রশ্ন এসেছিল, পরীক্ষা কেন্দ্রের পরিবেশ কেমন ছিল, পরীক্ষার্থীর শরীর-মনের সূক্ষ্ম রসায়ন কী ছিল, পরীক্ষকেরই বা নম্বর দেওয়ার মুহূর্তে শরীর-মনের অবস্থায় কী সামান্য হেরফের ঘটেছিল। সার কথা, মেধাতালিকার প্রথম কয়েকশো ছেলেমেয়ে সকলেই ভাল, মোটামুটি সমান মাপে ভাল। এদের মধ্যে নম্বরের চুলচেরা তফাত করা এক ধরনের পাগলামি।

এটাও শেষ কথা নয়, কারণ প্রচুর মেধাবী ছেলেমেয়ে প্রথম সারিতে আদৌ স্থান পায় না। সব রকম মেধা স্কুল পাশের পরীক্ষায়, বা যে কোনও পরীক্ষায়, ধরা পড়ে না, ফুটে ওঠে পরবর্তী কালে। আমরা যারা কলেজ স্তরে পড়াই, জানি মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বর একটা মোটা দাগের মূল্যায়ন বই নয়। সেখানে যে প্রথম, পরেও সে সচরাচর যথেষ্ট ভাল করে, কিন্তু একনাগাড়ে প্রথম হয় না। যার আগের পরীক্ষার নম্বর ভাল কিন্তু আহামরি নয়, হয়তো সে-ই উঠে আসে সবার উপরে— তা-ও কোনও অমোঘ বিচারে নয়। আর কর্মজীবনে কে কেমন করে, তার সঙ্গে পরীক্ষা পাশের যোগ প্রায়ই বেশ ক্ষীণ। এই অসঙ্গতিগুলো যে কোনও পাইকারি পরীক্ষা ব্যবস্থার স্বাভাবিক ধারা। ব্যাপক হারে দ্রুত মূল্যায়নের জন্য এর চেয়ে ভাল উপায় আবিষ্কার হয়নি, তাই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করতেই হয়, কিন্তু সত্যিকারের গুণের বিচারে মাত্রাধিক গুরুত্ব দেওয়া চলে না।

পরীক্ষার ফল নিয়ে মাতামাতি আমাদের সমাজে বিকারের পর্যায়ে পৌঁছেছে। সৃষ্টি হয়েছে এক পরিভাষা যা বাকি দুনিয়ায় অজানা— বিশেষত সেই দেশগুলিতে, যাদের আমরা মানদণ্ড হিসাবে নিই, আমাদের কৃতী ছেলেমেয়েরা যেখানে জীবন কাটাতে ব্যাকুল। এক সাহেব আমাকে সরল মনে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আচ্ছা, শুনলাম অমুক ছেলেটি পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছে, তার মানে কী? ওদের কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরীক্ষায় লিখতে হয়?’’

অসুখটাকে মহামারিতে পরিণত করেছে সংবাদমাধ্যম। শুধু যে নম্বর-তালিকার খুঁটিনাটি সবিস্তারে প্রচার হয় তা-ই নয়; হিড়িক পড়ে যায় ওই দণ্ডায়মান ছেলেমেয়েদের সাক্ষাৎকার নিতে, কোন জাদুবলে এমন সাফল্য সম্ভব তা খুঁটিয়ে জানতে, মায়ের হাতে তাদের সন্দেশভক্ষণের ছবি তুলতে, যার বেফাঁস অ্যাঙ্গল কখনও বা মনে আনে হাল্লার রাজার সেই পরিচিত শটটি।

বাবা-মায়েদের সংবিৎ ফেরানো দুষ্কর, কিন্তু আশা হয় এই বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেমেয়েরা এখনও তারুণ্যের আত্মাভিমান হারিয়ে ফেলেনি। তাদের বড় বলতে ইচ্ছা করে, এই আদিখ্যেতার ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের খেলো করবে কেন? তোমরা লেখাপড়ায় ভাল তার প্রমাণ রেখেছ, উন্নত উচ্চশিক্ষার চাবিকাঠি অর্জন করেছ; এ বার নিজের মতো চলো, নিজের মতো ভাবো, নিজের মতো পড়ো, উটকো ব্যাপারে পাত্তা দিয়ো না। আরও বলতে ইচ্ছা করে, পরীক্ষা পাশের কৃতিত্ব সব সময় সীমিত মাপের কৃতিত্ব, সে যত বিশাল যত জমকালো পরীক্ষা হোক না কেন। সব পরীক্ষাই আদতে প্রবেশিকা পরীক্ষা, পাশ করে কর্মজীবনে আসল পাঠ নিতে হয়। অন্যান্য ক্ষেত্র ছেড়ে দিলাম, লেখাপড়া গবেষণার পেশাতেও তখন পাঞ্জা কষতে হয় এমন লোকের সঙ্গে যাদের ট্রান্সক্রিপ্ট পাঁচমিশেলি, কিন্তু মেধায় তোমাদের নাস্তানাবুদ করতে পারে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লম্বা দৌড়ের প্রস্তুতিটাই আসল চ্যালেঞ্জ; উচ্চ মাধ্যমিকে দু’দশ নম্বর বেশি-কম ফালতু ব্যাপার, পেলে ভাল, না পেলে ক্ষতি নেই।

হয়তো দশটা ছেলেমেয়ের এক জন এই কথাগুলো একটু ভেবে দেখবে। দশটা সংবাদসংস্থার একটাও দেখবে ভরসা নেই, তবু বলি: এ বছর দয়া করে ছেলেমেয়েগুলিকে রেহাই দিন, সমাজের এই ব্যাধি একটু প্রশমিত করুন। যাদের দিকে ক্যামেরা-কলম তাক করছেন না, তাদের মেধা অনাদৃত, এমন ভাবার অবকাশ দেবেন না; যাদের নিয়ে স্টোরি করছেন, তাদের খাঁটি মেধা খেলো করবেন না।

একটা ঘটনা বলি। এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকাবাসী ব্রিটেনের উচ্চ আদালতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ক্ষতিপূরণের মামলা ঠোকেন। অভিযোগ, জায়গাটা গোল্লায় গিয়েছে, কিচ্ছু লেখাপড়া হয় না, সেখানে পড়তে গিয়ে তাঁর কেরিয়ারের সর্বনাশ হয়েছে।

অক্সফোর্ডের নামে মোহগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই, সেখানে নানা দোষত্রুটি অনাচার থাকতে পারে; তবু বিশ্বের এই অগ্রগণ্য বিদ্যায়তনটি নিয়ে এমন নালিশ অবাক করে বইকি। জানা গেল মামলাকারীর বয়স যখন আট, তাঁর মা তাঁকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়ে সেখানকার বিখ্যাত আইনশাস্ত্র কেন্দ্রটি দেখিয়ে বলেন, ‘‘বড় হয়ে এখানেই তোমাকে পড়তে হবে, ভুলো না কিন্তু।’’ মাতৃ-আজ্ঞা শিরোধার্য করে, প্রস্তুতি হিসাবে তিনি যথাকালে অক্সফোর্ডে পড়তে যান; হার্ভার্ড ল স্কুলে কিন্তু শেষতক ঢুকতে পারেননি। সেখানে আদৌ মার্কশিটের ভিত্তিতে ভর্তি হয় না; কিন্তু অসাফল্যের আর কোনও কারণ ভদ্রলোকের মাথায় আসেনি, অবশ্যই আসেনি নিজের মেধার ঘাটতি বা অন্যদের আরও মেধাবী হওয়ার সম্ভাবনা। অতএব মামলা।

গুরুগম্ভীর আলোচনার চেয়ে কার্টুনের মাধ্যমে অনেক জিনিস বেশি স্পষ্ট হয়। ঘটনাটার কথা সেই উদ্দেশ্যেই বললাম। অভিভাবকতন্ত্রের দোর্দণ্ড শাসনে, মার্কশিট আর ডিগ্রির ভারে লেখাপড়ার আসল ব্যাপারটা কী ভাবে চাপা পড়তে পারে, এটা বোঝা বড় জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে যে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় সবচেয়ে ভাল করছে, তাদেরই ভবিষ্যৎ বিকাশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement