জয়পুরের মাঠে আইপিএল-এর এক ম্যাচে ওভারের পঞ্চম বলে রাজস্থান রয়্যালস-এর ওপেনার জস বাটলারকে মাঁকড় আউট করে বিতর্কের জন্ম দিয়াছেন কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন। মাঁকড় আউট কী? বল করিতে আসিয়া বোলার যদি দেখেন, নন-স্ট্রাইকার ব্যাটসম্যান ক্রিজ়ের বাহিরে আছেন, তাহা হইলে বল উইকেটে লাগাইয়া ব্যাটসম্যানকে আউট করিয়া দিতে পারেন বোলার। ১৯৪৭ সালে সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিল ব্রাউনকে এই রূপে আউট করিয়াছিলেন ভারতের বিনু মাঁকড়। তৎসূত্রেই ইহা মাঁকড় আউট বলিয়া পরিচিত। ইহাকে কেন্দ্র করিয়া বিতর্ক, কারণ আউটের আইনগত যাথার্থ্য থাকিলেও নৈতিক যাথার্থ্য লইয়া সকলে নিশ্চিত নহেন। চলতি কথায় বলে, ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা— ব্যাটসম্যান-বোলার দ্বৈরথ হইতেছে না, বস্তুত না-খেলা ব্যাটসম্যান কেবল খেলার উত্তেজনার বশে কিঞ্চিত গণ্ডি লঙ্ঘন করিয়াছেন, সেই স্থলে অতর্কিতে পিছন হইতে উইকেট ফেলিয়া দেওয়া সৌজন্যের পরিচয় নহে।
আইন বলিবে, ব্যাটসম্যান স্বস্থানে নাই, অতএব তাহাকে আউট করা চলিতে পারে— ইহাতে বেনিয়ম নাই। তবে আইনের সীমানা অতিক্রম করিয়া চলাই ক্রিকেটীয় ভদ্রতা। ১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়-পাকিস্তান ম্যাচে বল করিতে গিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বোলার কোর্টনি ওয়ালশ লক্ষ করিয়াছিলেন, রানের তাড়ায় ব্যাটসম্যান সেলিম জাফর প্রায় ক্রিজ়ের মাঝখানে চলিয়া গিয়াছেন। নিরস্ত্র প্রতিপক্ষকে বধ না করিয়া জাফরকে ডাকিয়া ক্রিজ়ে ফেরান ওয়ালশ, এবং ফের বল করিতে যান। ঘটনাটি এতই জোরালো যে বত্রিশ বৎসর বাদেও অশ্বিনের সমালোচকরা ওয়ালশের উদাহরণ স্মরণ করাইতেছেন। বস্তুত, আইনের প্রসঙ্গেই বিপদটি সর্বাধিক। কারণ আইনের বাধ্যতা না থাকিলে কি ভদ্রতা করিবার দায়ও থাকিবে না! প্রশ্ন উঠিতেছে, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলি কি তবে কেবল আইন দ্বারাই নিবৃত্ত হইবে? ভীতি বিনা শিষ্টতার স্থান নাই? প্রসঙ্গত, ক্রিকেটের যে সংস্থা আইন তৈয়ারি করে, সেই মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব বা এমসিসি-ও প্রথমে ‘আইন এই রূপ’ বলিলেও পরে জানাইয়াছে ইহা ‘ক্রিকেটীয় স্পিরিটের বিপ্রতীপ’।
তবে, স্বীকার করিতে হয়, যাহাকে অখেলোয়াড়সুলভ বলিয়া ক্রিকেটপ্রেমীরা নিন্দায় মুখর, বর্তমান বিশ্বে তাহাই দস্তুর। এবং নিয়ম দেখাইয়াই সকলে প্রতিপক্ষকে মাত করিতে চাহিতেছে। কোনও দেশে যুদ্ধ চলিতেছে, সেই স্থলের অসহায় মানুষ সমৃদ্ধ দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছেন। আইন অনুসারে সমৃদ্ধ দেশ বলিতেছে, অনুপ্রবেশ চলিবে না। কিন্তু মানবিক খাতির এবং নীতিগত প্রশ্নে প্রতিবেশীকে রক্ষা করিবার দায় যে সমাজবদ্ধ জীবের উপর বর্তায়, আত্মগরিমার হুঙ্কারে সেই যুক্তি চাপা পড়িতেছে। পুরাণে ফিরিলে বলিতে হয়, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগল্ভে প্রবেশ করিবার ভিতরে এক আপাত নায়কোচিত ভঙ্গি আছে। তাহা দ্বিগুণ হইয়া যায় মনোবলের জোরে। কারণ তখন যোদ্ধা জানেন, প্রতিপক্ষ দুর্বল ও অপ্রস্তুত। সুতরাং, লড়াই সমানে-সমানে হইবে না। আমারই জয়ের সম্ভাবনা অধিক। কিন্তু সেই জয়ে অগৌরব বিনা কিছু নাই। প্রশ্নটি সরল, কোনটি অধিক প্রয়োজনীয়— হারজিত না সৌহার্দ্য।