Covid 19

চোখের সামনে রোজ মৃত্যু দেখছি, তাই অনুরোধ, টিকা নিন, করোনাবিধি মেনে চলুন

আমার একমাত্র আশা টিকা, আর অবশ্যই পিপিই কিট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব-সহ বাকি সমস্ত বিধি, যা আমাকে করোনা থেকে রক্ষা করবে।

Advertisement

দেবপ্রিয় দেব, এমআরসিপি (লন্ডন) এমডি (ইউকে)

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৬:৩৬
Share:

প্রতীকী ছবি

কয়েক সপ্তাহ আগে, আমার পরিচিত এক বন্ধু, সহকর্মীকে করোনা আক্রান্ত হতে দেখে আমার সত্যিই আতঙ্কে দিন কেটেছে। দেখেছি কী ভয়ানক এই ভাইরাস। আমার বন্ধুটি বেশ কয়েক সপ্তাহ আইসিইউ-তে ভর্তি ছিলেন। তার পর তাঁর নিউমনিয়া ধরা পড়ে। একাধিক অঙ্গ বিকল হওয়া শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের কাছে পরাস্ত হতে হয় তাঁকে। ব্রিটেনের টেলফোর্ডের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড। কোভিড ওয়ার্ড সেটি। ওই ওয়ার্ডে কাজ করতে গিয়ে আমাকে বারবার আতঙ্ক গ্রাস করেছে, কাজ করেছে ভয়। পরিবারের মুখোমুখি হতেও আমার ভয় করত। মনে হত, আমি মারা গেল ওঁদের কী হবে? সবসময় তাড়া করত এই প্রশ্ন। আমাকে কি সত্যিই প্রথম সারির করোনা যোদ্ধা হয়ে লড়তে হবে? পরে আমি বুঝতে পারি আসল কথাটা। আমার অন্তর আর মূল্যবোধ আমাকে মনের জোর দেয় সে দিন, যে দিন আমি বুঝতে পারি রোগীর সেবার্থে আমি এক ঐতিহাসিক শপথ নিয়েছিলাম। আমার দায়িত্ব ব্যক্তিগত সমস্ত দ্বন্দ্ব ও নিজের প্রতি ভালবাসা কাটিয়ে বড় কাজের স্বার্থে আমাকে লড়াই করতে হবে। করোনা নামের সুনামি সারা পৃথিবীর সঙ্গে ব্রিটেনের হৃদয়েও আঘাত করেছে। ভাইরাসের নতুন দু’টি স্ট্রেন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানুষের শরীরে আগের থেকে দ্রুত সংক্রমিত হয় আর আরও বেশি অসুস্থ করে তোলে। আমার নিজের শহর কলকাতাও এর থেকে মুক্ত নয়। আমার পরিবার, বযস্ক মা করোনা নামক মারণ ভাইরাসের সামনে উন্মুক্ত। প্রতি সপ্তাহে আমি খবর পাই কোনও পরিচিত, বন্ধু বা আত্নীয় হয় করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রবল শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন, নয়ত তাঁদের প্রাণ গিয়েছে। কয়েক দিন আগে আমার শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের আইটিইউ-য়ে ভর্তি থাকার খবর আমাকে বেদনাহত করেছে।

Advertisement

আমার একমাত্র আশা টিকা, আর অবশ্যই পিপিই কিট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব-সহ বাকি সমস্ত বিধি, যা আমাকে করোনা থেকে রক্ষা করবে। আমি শেষ ন’মাস ধরে অসংখ্য কোভিড আক্রান্তের চিকিৎসা করেছি। তার পরেও আমার করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে। এর অর্থ এখনও আমার করোনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ষোলো আনা। আর এই মারণ ভাইরাস থেকে আমাকে একমাত্র রক্ষা করতে পারে করোনার টিকা।

শেষ এক যুগ ধরে এই গোত্রের ভাইরাসের টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে। মূলত শীতকালে এই রোগের প্রাধান্য দেখা দিত। সার্স কোভ-১, ইবোলা, টিবি, ম্যালেরিয়া-সহ একাধিক রোগের টিকা তৈরির কাজ করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। এই রোগগুলিও দীর্ঘ দিন ধরে বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে আসছে। সাধারণত টিকা তৈরিতে অনেক দিন সময় লাগে। কখনও কখনও ১৫-২০ বছরও লেগে যায়। এদের মধ্যে সার্স কোভ ২ বা কোভিড ১৯ ভাইরাস একটু আলাদা। একই সঙ্গে পৃথিবী জুড়ে এই ভাইরাস তাণ্ডব চালাতে শুরু করেছিল। কিন্তু এই অন্ধকার রাতের পর যেন একটু একটু আলো দেখা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি সংস্থা সফল ভাবে করোনা টিকা তৈরির ঘোষণা করেছে। কয়েক দিন পরেই হয়ত এর সবগুলির বিতরণ শুরু হযে য়াবে।

Advertisement

পৃথিবীতে প্রথম বার দেখতে পাচ্ছি, টিকা তৈরি হয়েছে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ। কারণ জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করতে হবে টিকা। এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ফলে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা নিজেদের অর্থ ও গবেষণাকে যৌথ ভাবে ব্যবহার করে টিকা তৈরি করতে চাইছে। ১২ মাসের মধ্যে এর আগে কোনওদিনই টিকা তৈরি হয়নি, যা এ ক্ষেত্রে হতে চলেছে। ব্রিটেন এই টিকা তৈরির কাজে প্রথম সারিতে রয়েছে। এক দিকে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা, অন্য দিকে ইম্পিরিয়াল কলেজের টিকার গবেষণা, দু’টিই চলছে একসঙ্গে। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কার্যকরিতা পাওয়া ফাইজার-বায়োটেকে টিকার জন্যও আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তবে এ ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত একটি সমস্যা রয়েছে, কারণ এটিকে হিমাঙ্কের ৭০ ডিগ্রি নীচের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয় এবং ৫ দিনের মধ্যে ব্যবহার করে ফেলতে হয়।

নভেম্বরের শেষ দিকে, ব্রিটেনের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (এমএইচআরএ) পৃথিবীতে প্রথম টিকা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। আমরা ঘোষণার পর থেকে উত্তেজিত তো বটেই, তবে জানি না কবে আমার টিকা নেওয়ার সময় আসবে। ডিসেম্বরের শুরুতে খবর পাই, হাসপাতালে টিকা আসছে। কিন্তু সেগুলি শুধু দেওয়া হবে আক্রান্ত ও কেয়ার হোমের বাসিন্দাদের, যাঁদের বয়স ৮০ বছরের বেশি। কিন্তু প্রথম সারির করোনা যোদ্ধা হিসাবে আমাকে রোজ আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসতে হয়। সেই কারণেই আমরা ও জরুরিকালীন বিভাগের চিকিৎসকরা আগে টিকা পাওয়ার দাবি তুলি। সবচেয়ে বড় কথা, ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যসোসিয়েশনের একটি গবেষণায় ভিত্তিতে দাবি করি, ইন্দো-ভারতীয় হওয়ায় আমার করোনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমাদের হাসপাতালে টিকা দেওয়া শুরু হলেও আমাকে কম করে দু’সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয় টিকার জন্য। আমাকে বলা হয়, আমার জন্য দু’ঘণ্টা সময় আছে। আমি গাড়ি চালিয়ে রয়্যাল স্রুসবারি হাসপাতালে যাই যা প্রায় ৩২ কিমি দূরে। পুরো ব্যবস্থাপনা দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের কনফারেন্স কেন্দ্রটিকে পুরোপুরি একটি টিকা কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে। পুরো পার্কিংয়ের জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে, যাঁরা টিকা নিতে আসবেন, তাঁদের জন্য। এই ভবনে একটিই প্রবেশপথ। সেখানে মেনে চলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব। প্রথমে নাম নথিভুক্ত করা হচ্ছে। তার পর যেতে হচ্ছে অন্য আরেক জনের কাছে। সেখানে ফের দেখা হচ্ছে ওই ব্যক্তির চিকিৎসার ইতিহাস, অ্যালার্জি আছে কি না ইত্যাদি। তার পর ১০ মিনিটের মধ্যে নার্সের সামনে উপস্থিত হতে হচ্ছে। এক বার আমার বিস্তারিত তথ্য যাচাই করে দীর্ঘ দিনের অপেক্ষার পর করোনার টিকা দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে সময় লাগছে ২০ মিনিটের মতো। টিকা নেওয়ার পর আরও ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হচ্ছে শরীরে কোনও রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য। তার পর বুস্টার ডোজ দেওয়ার দিন ক্ষণ বলে দেওয়া হচ্ছে। আমার ক্ষেত্রে সেটি ছিল ১১ জানুয়ারি ২০২১।

আমাকে যখন টিকা দেওয়া হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল এ বড় মধুর সময়। জীবন পাল্টে দিয়েছে যে সময়, চোখ খুলে দিয়েছে যে অধ্যায়, এ যেন তার মধুর পরিসমাপ্তি... নাকি নয়? এখানেই শেষ নয়, সবে শুরু। ভাইরাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন লড়াইয়ের সূত্রপাত হিসাবে থেকে যাবে এই টিকা নেওয়ার দিনটি। আমার মনে উত্তরের থেকে প্রশ্ন বেশি ভিড় করছে এই টিকা নিয়ে।

ফাইজারের টিকা কী অক্সফোর্ডের টিকার থেকে বেশি কার্যকর?

প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, দু’টি টিকাই কার্যকরা। ফাইজারের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, এটি ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর। অন্য দিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রজেনেকার টিকায় দেখা গিয়েছে, এটি ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ কার্যকর।

কত দিন করোনার হাত থেকে বাঁচা যাবে?

এক জনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কত দিন থাকে সেটা এ ভাবে বলা মুশকিল। হতে পারে এটি কয়েক মাস, হতে পারে কয়েক বছর। এখনও বিস্তারিত ভাবে এ নিয়ে কিছু বলার সময় আসেনি। সবেমাত্র টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ভিত্তিতে এর উত্তর দেওয়া উচিত না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ছ’মাসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গ্রহণযোগ্য। তবে সময় পেরিয়ে গেলে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত বোঝা যাবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, হতে পারে এই টিকার দৌলতে মানুষের শরীরে কয়েক মাসের জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হল। হতে পারে সেটি এক বছর অবধি রইল। যদি দেখা যায় শরীরে অ্যান্টিবডি বা টি সেল কম সংখ্যায় থাকলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে, তা হলে বুঝতে হবে, এটি দীর্ঘ দিনের জন্য কার্যকর। যদি প্রথমেই অত্যাধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তা হলে বুঝতে হবে এটি দীর্ঘ দিন থাকবে না।

আমার কি কোভিড ১৯ টিকা থেকে করোনা হতে পারে?

ভাইরাসের টিকা সাধারণত শরীরে একটি বিশেষ বার্তা পাঠায়, যেটিতে একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসের সন্ধান চালাতে বলা হয়। যেমন, সার্স কোভ ২। প্রথাগত টিকায় মৃত বা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করিয়ে সেটিকে চেনানো হয়। যার ফলে শরীর অ্যন্টিবডি তৈরি করে। সেই কারণেই টিকা তৈরিতে অনেক বছর সময় লাগে।

কিন্তু ফাইজারের টিকায় কোনও দুর্বল বা মৃত ভাইরাস নেই। এই টিকা শরীরে ক্ষতিকর নয় এমন করোনা ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরিতে সাহায্য করে। সেখান থেকেই শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি-ও নন রেপ্লিকেশন ভাইরাল ভেক্টর তৈরি করে। এর থেকেই শরীর করোনা থেকে মুক্তি পায়।

এত তাড়াতাড়ি টিকা তৈরি করা কী ভাবে সম্ভব হল?

আগে টিকা তৈরি করতে অনেকটা সময় লাগত। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দ্রুত টিকা তৈরি হয়েছে, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। অনেকগুলি কারণ আছে, যার জন্য দ্রুত তৈরি হয়েছে করোনা টিকা।

ফাইজারের টিকা করোনায় ব্যবহার করা হবে, সেটি দীর্ঘ দিন ধরে ফাইজারের গবেষণায় রয়েছে। তবে সেটি অন্য সংক্রামক ব্যাধির জন্য। চিনে যখন করোনা ছড়িয়ে পড়ে, তখন এটি প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্ত সেই সময় চিন সার্স কোভ-২ ভাইরাসের কথা ঘোষণা করে। তার আগে সার্স কোভ-১ ভাইরাসেরও তথ্য প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে টিকা প্রস্তুতকারকরা অনেকটা সময় পেয়েছিলেন টিকা তৈরির জন্য। তৈরি হয়েছিল এমআরএনএ টিকা, নতুন একটি প্রযুক্তি। যার সাহায্যে অগের থেকে দ্রুত কাজ করবে টিকাটি।

· সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের ভিত্তিতে হাজার হাজার মানুষ গবেষণায় সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। তাই বলা চলে, করোনার টিকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ মানব শরীরে গবেষণা করা হয়েছে।

· করোনাভাইরাস যেমন ছোঁয়াচে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সেই কারণেই টিকার ফল সন্ধান করতেও দ্রুততা আনা হয়েছে। যাঁরা টিকা পেয়েছেন, তাঁরা করোনার সামনে উন্মুক্ত হলেও আক্রান্ত হচ্ছেন কি না, সেটি দেখা হয়েছে।

· সংস্থাগুলি অনুমতি পাওয়ার আগে থেকেই টিকা তৈরির কাজ শুরু করেছিল, যাতে অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকা সরবরাহ শুরু করা যায়।

· টিকা পরীক্ষার একাধিক ধাপ, একসঙ্গে চলেছে। একটি চলতে চলতে, অন্যটি চালানো হয়েছে। একটির পর আরেকটি শুরু করলে অনেকটা সময় লাগে। এমন পদ্ধতিতে আগে টিকার পরীক্ষা হত।

· এত বড় গবেষণার জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন, যা জুগিয়েছে সরকার ও ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলি।

টিকা নেওয়া কতটা নিরাপদ?

সমস্তরকম পরীক্ষার ফল ও সাম্প্রতিক খবর থেকে যা জানা গিয়েছে, তাতে মানব শরীরে ব্যবহারের জন্য এই টিকা নিরাপদ। তবে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে হতে পারে মাথা, গায়ে ব্যথা। তবে তা যদি দু’দিনের বেশি থাকে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎকের পরামর্শ দেওয়া দরকার।

আমাদের কি এর পরেও মাস্ক পরতে হবে?

হ্যাঁ, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সেই ৫ বা ১০ শতাংশ মানুষ য়াঁদের শরীরে টিকা কাজ করবে না তাঁদের করোনা হতে পারে বা তাঁরা রোগ ছড়াতে পারেন।

এমআরএনএ টিকা বলতে কী বোঝায়?

এমআরএনএ টিকা হল অনেকটা ফটোকপি বা জেরক্স মেশিনের মতো। এটি শরীরে ঢুকে স্পাইক প্রোটিনের প্রতিলিপি তৈরির কাজ শুরু করে। তার পর কোষের সঙ্গে যখন এই স্পাইক প্রোটিনের সংযোগ হয়, তার পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সেই রোগটিকে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু শরীরে এই ভাইরাসকে চিনিয়ে দেওয়ার দরকার পরে। টিকার ফলে শরীর অ্যান্টিবডি বি ও টি সেল করোনাভাইরাসকে চিনে রাখে। পরে শরীরে যদি একাদিক সম্পূর্ণ করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে, তখনই শরীর সেইগুলির প্রোটিন সেল চিনে নিয়ে সেগুলিকে ধ্বংস করে দেয়।

টিকা: ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি

ভারতে সিরাম ইনস্টিটিউটের হাত ধরে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি হচ্ছে। এক মাসে ৫ কোটি টিকা তৈরি করবে বলে জানিয়েছে সংস্থা। ২০২১ সালের মধ্যে ৩০ কোটি টিকা তৈরি করবে সিরাম।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ভারতে কোভিশিল্ড নামে পরিচিত। ৪ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে এটির দু’টি ডোজ প্রয়োগ করতে হবে। এটি নিরাপদে ২ ডিগ্রি থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নিরাপদে সঞ্চয় করা সম্ভব। সাধারণ হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্রেও এটি থাকতে পারে। এটি ভারতে অনুমতি পাওয়া প্রথম টিকা।

ভারত বায়োটেক যে টিকা তৈরি করেছে, সেটির নাম কোভ্যাক্সিন। ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোল জেনারেলে ভিজি সোমানি জানিয়েছেন, ভারত বায়োটেকের টিকা অত্যন্ত কার্যকর এবং এটি সর্বদা অত্যধিক শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সাহায্য করে। তবে এটি কেবল জরুরি ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ছাড়পত্র পেয়েছে, ফেজ থ্রি-তে রয়েছে এটির ট্রায়াল, তার ফলাফল নজরে রাখা হবে।

প্রাথমিক ভাবে ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা থাবা বসানোর পর, সেটি ভারতেও তার জাল বিস্তার করে। এর পর শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ (যার মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন থেকে প্রাপ্ত নতুন স্ট্রেন)। এই ঢেউ আগে থেকে বেশি ছোঁয়াচে, সহজে সংক্রমিত হয় ও বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমার হাসপাতালে এখনও করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উপচে পড়ছে। বেশির ভাগেরই অক্সিজেন সাপোর্ট দরকার। প্রয়োজন ভেন্টিলেশন। সঙ্গে বেশির ভাগ রোগীকেই স্থানান্তরিত করা হচ্ছে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। মনে করা হচ্ছে, ব্রিটেন ও আমেরিকার বেশির ভাগ মানুষ টিকা না পাওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আমার চিন্তা কলকাতাকে নিয়ে। আর কিছু দিনের মধ্যেই সেখানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পৌঁছে যাবে। তখন আরও অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হবেন। অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, কারণ অনেকেই লকডাউনের নিয়ম ঠিক করে মানেননি বা মানছেন না। এক দল মানুষ আছেন, যাঁরা করোনা সংক্রমণ আটকাতে তৈরি করা স্বাস্থ্য বিধি মানছেন না। তাঁরা না মানায়, শেষ পর্যন্ত প্রভাবিত হতে চলেছেন দেশের বড় সংখ্যক মানুষ। সামান্য একটা অংশের মানুষের জন্য তাঁদের ভুগতে হচ্ছে, মৃত্যুর মুখে দাঁড়াতে হচ্ছে। আমি প্রতি দিন কোভিড ওয়ার্ডে চিকিৎসা করি আর দেখি কী ভয়ানক অবস্থা। কমবয়সি রোগীদের ক্ষেত্রে কী ভাবে করোনাভাইরাস নতুন করে মারণ ক্ষমতা নিয়ে আক্রমণ করছে তা দেখছি রোজ। আমার রোগীদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের কম, আর ১০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের কম।

এক দল লোক আছেন, যাঁরা বিশ্বাস করেন করোনার প্রকোপ কমছে, আর তাই তাঁদের কিছু হবে না। আবার আরও এক দল লোক আছেন, যাঁরা মনে করেন করোনার টিকা ক্ষতিকারক। আমি রোজ দেখছি অনেক স্বাস্থ্যবান, কমবয়সি মানুষ চোখের সামনে মারা যাচ্ছেন। পরিবারের লোক শেষ দেখাটুকুও দেখতে পাচ্ছেন না। আমাদের হাসপাতালে আর আইটিইউ বেড খালি থাকছে না, রোজ বাড়ছে রোগীর চাপ। ইউরোপ, আমেরিকায় রোজ হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। আক্রান্ত হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ। করোনাভাইরাস নির্দয় ও মারাত্মক। কম করে আরও এক বছর সে পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াবে। তাই আমার অনুরোধ নিয়ম মেনে চলুন।

তবু এই অন্ধকারের পর একটা আলোর রেখা আমরা দেখতে পাচ্ছি। জীবনদায়ী টিকা আসছে, ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের দরজায়। আমরা যদি নিয়ম মেনে চলি তা হলে এই সঙ্কটের সময় কাটিয়ে উঠবই। আশা করি, ২০২১-এর সূর্যোদয় আমাদের স্বাস্থ্যকর, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ এক পৃথিবী উপহার দেবে।

কনসালট্যান্ট র‌্যাসপেরোটরি ফিজিসিয়ান, প্রিন্সেস রয়্যাল হসপিটাল, টেলফোর্ড, ইউকে

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement