২০ জুন, ২০২২: গৌরকিশোর ঘোষের জন্মশতবর্ষের সূচনা
Personality

আমরা চিনতে চাইনি, চাই না

জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রেম নেই, প্রতিবেশী কি গৌরকিশোরের অন্যান্য সাহিত্যের তুলনায় পাঠকের কম অপরিচিত?

Advertisement

রুশতী সেন

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২২ ০৫:১৭
Share:

গৌরকিশোর ঘোষের সাংবাদিক সত্তাটি অত্যন্ত জোরালো। তার আড়ালে সচরাচর চাপা পড়ে যায় তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রসঙ্গ। কিন্তু সাংবাদিকতার মতো তাঁর আখ্যানসাহিত্যেরও মস্ত বড় বৈশিষ্ট্য— জোরালো সাহস আর তীক্ষ্ণ অথচ আপাত নৈর্ব্যক্তিক বয়ান। ‘বাঘবন্দী’ আর ‘তলিয়ে যাবার আগে’ গল্প নিয়ে আমরা যেখানে নামে যে গল্প সঙ্কলন হয় (১৯৭০), তাতে আমরা দেখি রাজনীতির অছিলায় বানিয়ে তোলা মারাত্মক সন্ত্রাস আর সমাজমনের মর্মান্তিক অপচয়ের পর্যবেক্ষণ। সমাজবিরোধীর সংজ্ঞা খুঁজতে খুঁজতে লেখক তাঁর ভদ্রবেশী পাঠককে ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে দেন দর্পণের সামনে। পাঠকের ভিতর-বাইরের নিশ্ছিদ্র আঁধারের বিন্যাসে লেখকের প্রস্তুতি দীর্ঘ। সাগিনা মাহাতো (১৯৬৯) সঙ্কলনে নামগল্পটিতে বঞ্চিতের প্রতিরোধকে কী ভয়ানক পদ্ধতিতে বঞ্চনাকারী নিয়ে আসে নিজের দখলে! অন্য গল্পগুলো অর্থাৎ ‘বসন্দা’, ‘দিন্দা’, ‘করবীদি’ ‘শরৎদা’, ‘কমরেড নির্মলা সেন’ এঁরা কি পুরোপুরি হারিয়ে গেছেন পাঠকের মন থেকে? ‘শরৎদা’-র গ্রন্থনাতেই কিন্তু ছিল লেখকের সেই উচ্চারণ, “পার্টি পলিটিক্সের মধ্যে কি এমন রহস্য আছে, যা মানুষকে মানুষ রাখে না, আজ্ঞাবহ পুতুল করে তোলে।” গৌরকিশোরের জীবনের সর্বশেষ গল্পসঙ্কলন পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদতরণী, হা হা (১৯৭১)-র নামগল্পে অন্যায্যের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্র-অনুমোদিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাজ্জব প্রতিরোধহীনতা শরীরে-মনে বহন করতে করতে মানুষ নিজের অঙ্গহানি টের পায়, বলে, “আমি হিজড়ে হলাম কখন!” তার পরেই কাহিনির বয়ান বদলে যায় চলিত থেকে সাধুভাষায়। অরাজকতা-অনাচারের যে চরম স্বাভাবিক চলনে গল্প শুরু হয়েছিল, গল্প শেষেও তা জারি রইল। আসলে এ-গল্পের শেষ নেই। লেখা হওয়ার পাঁচ দশক পার করেও রাষ্ট্রে, সমাজে, সংসারে অঘটন ও বীভৎসতা বেড়েছে বই কমেনি। অথচ কোনও রকম প্রতিবাদের আবর্ত থেকে যথাসম্ভব নিরাপদ দূরত্বেই আমাদের স্বস্তি। পরীক্ষা নিয়ে ভয়, রুজির অনিশ্চয়তা নিয়ে ভয়, কর্মক্ষেত্রে প্রতিকূলতা নিয়ে ভয়, ঘরবাড়ি-সঞ্চয়-সুখ-সম্পদ হারানোর ভয়, ছেলেপুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়, জান-বাঁচানোর ভয়— এত রকম ভয় পেতে পেতে কেমন ‘নেই’ হয়ে বেঁচে থাকা আমাদের! গৌরকিশোর ঘোষের শতবর্ষে তাঁর জবরদস্ত বয়ানের জন্য সত্যিই কি অভাব বোধ করি? না কি নিশ্চিন্ত থাকি— আমাদের শরীর-মনের অমানুষিক নির্বিকারত্বে তেমন তেমন টান দেওয়ার মতো কলমের মোচড় আজ অনুপস্থিত বলে?

Advertisement

নিজের দ্বিতীয়, তৃতীয় আর চতুর্থ উপন্যাস মনের বাঘ (১৯৬৩), লোকটা (১৯৬৬) আর গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে (১৯৭২) প্রসঙ্গে গৌরকিশোর বলেছিলেন, আপাতমিল চোখে না পড়লেও এরা ট্রিলজি, “একই আত্ম-উন্মোচন— আমি আমাকেই উলটে-পালটে দেখার চেষ্টা করেছি।” ঘটনার ক্রমকে ভেঙে-চুরে, একই সময়কার বিভিন্ন বিনিময়ের বিভিন্ন সংলাপকে যেন কোলাজের বিন্যাসে বুনে (বিভিন্ন বিনিময়কে বিনিসুতোয় গেঁথে চলার এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেক পরের উপন্যাস, ১৯৮৫-তে গ্রন্থিত কমলা কেমন আছে-তেও চোখে পড়ার মতো), কে বা কারা কাহিিনর মুখ্য চরিত্র, সে-প্রসঙ্গে পাঠককে যথেষ্ট ধন্দে ফেলে আখ্যান তিনটিতে ঘটনা বা ঘটনাহীনতার চলন। আজ তাঁর জীবনের শেষ গল্প ‘বুড়োর অন্তিম স্বপ্ন, বড় অগোছাল’ (১৯৯০) পড়তে পড়তে ভাবা যায়, সুযোগ পেলে কি লেখক ‘…অন্তিম স্বপ্ন…’-র রেশ ধরে তাঁর আত্ম-উন্মোচন-ট্রিলজির নাম বদলে রাখতেন ‘যুবকের/মাঝবয়সির রোজকার বাস্তব, বড় পরিপাটি’? আপাত গোছহীনতার তলায় তলায় আত্ম-উন্মোচনের যে পারিপাট্য ছিল, তাকে ভাঙতে ভাঙতেই কি ‘বুড়োর অন্তিম স্বপ্ন…’ দর্শন? সমুদ্রের এমন ব্যাপ্তি গৌরকিশোরের পূর্বতন কোনও সৃজনে মেলেনি কখনও। সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে স্বপ্নদর্শী বুড়ো বোঝে, তার রাঙাদিদিমার দুরূহ জীবনপথ, দিদিমার মুখের জলকন্যার গল্প, দিদিমার শেখানো খেলা যে কেবল বুড়োর প্রথম আর দ্বিতীয় শৈশবকে লালন দিয়েছে, এমন নয়; লালন করেছে তার বার্ধক্যপূর্ব জোয়ান জীবনকে, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭২-এ লেখা গৌরকিশোরের আত্ম-উন্মোচনের ট্রিলজিকেও! সর্বাঙ্গে ঢেউ-এর স্পর্শ নিতে নিতে রাঙাদিদিমার বুড়ো নাতি জলকন্যার স্পর্শ অর্জন করে। জীবনভর যত না-পাওয়া, সবেরই যেন উপশম ওই অর্জনে। ‘বুড়োর অন্তিম স্বপ্ন…’-র তিন বছর আগে লেখা ‘বুড়োবুড়ির গপ্পো’, এক বছর আগের ‘বাবার বিনুমামার বাড়ী’-ও তো আশ্চর্য দু’টি যাত্রার প্রতিবেদন— যেন নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যসাধন!

আদতে একটি আখ্যানই কি জীবনভর লিখেছেন গৌরকিশোর, কথকের অবস্থান বদলে-বদলে? যশোর-শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপ, নবদ্বীপ থেকে কলকাতার যাত্রাপথ যখন নিকট স্মৃতি, তখন বেরিয়েছিল তাঁর প্রথম গল্প-সঙ্কলন এই কলকাতায়। জীবিকা থেকে জীবনযাত্রা, না কি জীবন থেকে জীবিকাযাত্রা— এই কি বইটির কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা? সত্যযুগ পত্রিকায় ১৯৪৮-৪৯’এ প্রকাশিত লেখাগুলি যে বছরে গ্রন্থিত হল গৌরকিশোরের এই প্রথম বইতে, সেই ১৯৫২-তেই লেখা হয় ‘কান্তলালের চাকরি গেল’ আর ‘কোনও একজন কাউকে লিখেছিলুম’ নামের দু’টি জীবিকাজীবনের (অথবা জীবনজীবিকার) গল্প। রুজির যে দুরূহ বৈচিত্রে লেখক জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন, তার সুবাদেই কি প্রতিকূলকে নিয়েও তাঁর তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ? দু’টি গল্পই নিতান্ত হালকা চালে কঠিন যাপনের কথা বলে। একুশ বছর পরে জীবনে স্থিতির অভাব হয়তো কমেছে, কিন্তু ও-সব কথার গুরুত্ব থেকে গেছে অবিচল। ১৯৭৩-এ লিখছেন ‘মানুষজন ও অন্যান্য উপসর্গ’, কেরানিজীবনের মলিনতা, কর্মহীনতার দুর্বিপাক যার ভরকেন্দ্র। তাঁর দ্বিতীয় গল্পসঙ্কলন মন মানে না (১৯৫৯)-তে ‘শিকার’-এর মতো নির্মম গল্পে দেশভাগের ইতিহাস বিছিয়ে আছে ছিন্নমূল মানুষের নিরুদ্দেশযাত্রায়। ওই মর্মান্তিক যাত্রার কার্যকারণকে, প্রাক্-দেশভাগ জীবনের সঞ্চয়-অপচয়কে আখ্যানে গাঁথার ভাবনা কি তখন থেকেই? ১৯৫৯-এর চার বছর পরে গ্রন্থিত মনের বাঘ-এ নমশূদ্র দুলু নিজের হাত দু’টি তুলে ধরে যেন পাঠককেই প্রশ্ন করেছিল, এ-হাত ডোল নেওয়া ছাড়া আর কোন কাজেই বা লাগবে! জটিল বুনোটে পাঠক দুলুকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। আঠেরো বছর পরে প্রেম নেই উপন্যাসে নিরক্ষর চাষা সাজ্জাদ যখন বলে, ‘গরিবির আবার কথা, গরিবির আবার কথার খেলাপ’, পাঠকের স্মৃতিতে কি ফিরে আসে না দুলু?

Advertisement

জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রেম নেই, প্রতিবেশী কি গৌরকিশোরের অন্যান্য সাহিত্যের তুলনায় পাঠকের কম অপরিচিত? পরাধীন অবিভক্ত বাংলার গ্রামে নিরক্ষর মুসলমান কৃষকের শিক্ষিত উকিল পুত্র শফিকুল দেওয়ানবাড়ির হিন্দু মেজোকর্তাকে বলতে শুনেছিল, “হুজুগটা তাড়াতাড়ি চলে যায়। কিন্তু দেশটা চিরকাল থাকে।” শফিকুলের চোখের সামনে নিরুপায় ফজলুল হক অবস্থান বদলেছেন, কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ-এর সম্মিলন হয়েছে। বাল্য জুড়ে তাদের কৃষিজীবী অস্তিত্বের স্তরে তো কই হিন্দু গয়ার সঙ্গে মুসলমান শফিকুলের বিভেদ বড় হয়ে ওঠেনি! তখনকার বিভেদের ব্যক্তিগত রূপটা লোপাট করে সম্প্রদায় মস্ত হয়ে উঠল। প্রান্তিক দৈনন্দিনের যে অনটনক্লিষ্ট অর্থনীতিতে শফিকুল-গয়ার বেড়ে ওঠা, তা যেন এক বড়সড় উদ্বৃত্তেরও উৎস ছিল। স্বীকৃত রাজনীতির প্রশ্রয়ে যে অর্থনীতি লালিত হল, সে ওই উদ্বৃত্তকে চিনল না। তাই লাঙলা চাষার শিক্ষিত পুত্র প্রেম নেই জুড়ে কেবলই হারুয়া। সেই হারের করুণ মার প্রেম নেই পেরিয়ে প্রতিবেশী-রও ছত্রে ছত্রে মিশে থাকে।

এই উপন্যাসত্রয়ীও তেমন মনোযোগে পড়িনি আমরা। এক হুজুগ থেকে আরও জবরদস্ত হুজুগ দেশের উপর থেকে আরও উপরে পাকাপোক্ত ঘাঁটি গেড়েছে। দেশের বদলে সেই হুজুগের বন্দনাতেই আমরা মাতোয়ারা! এই উপলব্ধির বিষাদেই কি গৌরকিশোরের সাহিত্যিক সৃজনের উৎসমুখ শনাক্ত করা যায়? আমরা চিনতে চাইনি। আজ যখন অমন একটা কলমের বড় প্রয়োজন, তখন তো আরও চিনতে চাই না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement