অন্তর্বিহীন: অসমে এনআরসি-র বিরুদ্ধে বাঙালি জয়েন্ট কোঅর্ডিনেশেন কমিটির আহ্বানে প্রতিবাদ, গুয়াহাটি, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
এক জন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। অন্য জন অসমের। দু’জনেরই রাজনৈতিক পূর্বাশ্রম যদিও কংগ্রেস দল, বর্তমানের মতাদর্শগত অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। দু’টি রাজ্যের ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতা একেবারেই মেলে না। ভোটের রাজনীতির পাটিগণিতেও দুই রাজ্যের বিন্যাস ও রসায়নে বিস্তর অমিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! অতি সম্প্রতি জারি হওয়া নাগরিকত্ব বিধি নিয়ে দু’জনের মতামতে চমকে যাওয়ার মতো মিল। গত মঙ্গলবার উত্তর চব্বিশ পরগনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, সিএএ-র মাধ্যমে কেউ আবেদন করলে নাগরিকত্ব পাওয়ার তো প্রশ্নই নেই, উল্টে অনুপ্রবেশকারীর তকমা জুটবে কপালে। হিমন্তবিশ্ব শর্মা একই দিনে গুয়াহাটিতে জানাচ্ছেন যে, নাগরিক পঞ্জিতে নাম তুলতে আবেদন জানাননি এমন কেউই নাকি ভুলেও সিএএ বিধির মাধ্যমে ভারতীয়ত্ব অর্জনের দুঃসাহস করবেন না। কথায় বাড়তি জোর আনতে তিনি এ-ও বলেছেন, এক জনও তেমন আবেদনকারী যদি পাওয়া যায় যিনি এনআরসি এড়িয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সুবিধা পেয়েছেন, তা হলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি থেকে সরে দাঁড়াবেন।
এই দু’জন দাপুটে রাজনীতিবিদের সিএএ-প্রতিক্রিয়া যদি পাশাপাশি রাখি, তা হলে তো এই ধারণাই দানা বাঁধে যে, ওই সর্বনাশা আইন থেকে শত হস্ত দূরে থাকাই ৭১-পরবর্তী দেশান্তরি হিন্দু বাঙালিদের জন্য মঙ্গল। তবে তো আমার কথাটি ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো। কিন্তু না। আসলে এই বিন্দু থেকেই শুরু হচ্ছে আসল কথা।
আমরা অসমের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়াই প্রথমে নেড়েচেড়ে দেখি। তাঁর মতে ২০১৫ সালের পর কোনও অনুপ্রবেশকারীর পক্ষেই নতুন করে অসমে নাগরিক হওয়া সম্ভব নয়। হক কথা। কারণটা হচ্ছে এই যে, ২০১৫ সালের ৩১ অগস্ট ছিল এনআরসিতে নাম অন্তর্ভুক্তির শেষ দিন। অন্য দিকে, সিএএ পোর্টালে নাগরিকত্ব পেতে যাঁরা আবেদন জানাবেন তাঁদের জন্য প্রাথমিক শর্ত— ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বা তার আগে আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে ভারতের মাটিতে পা ফেলতে হবে। সহজ কথা তা হলে এটাই যে, এনআরসির জাল কেটে ঘুসপেটিয়া’রা কিছুতেই ভারতের নাগরিক হতে পারবে না। কিন্তু প্রশ্নটা যে আরও গভীরে।
এনআরসিতে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল, ৩ কোটি ৩০ লক্ষ। অনুমান করা যায় যে, জনসংখ্যার নিরিখে রাজ্যের প্রায় সবাই আবেদন করেছেন। নগণ্য সংখ্যার যে-ক’জন আবেদন জানাননি তাঁরা নিশ্চয়ই ভয়েই ও-পথ মাড়াননি। কারণও সহজেই অনুমেয়। আবেদনকারী হিসাবে যোগ্যতা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় কোনও নথি তাঁদের হাতে ছিল না। ফলে এখন নতুন ব্যবস্থায়ও এঁরা ধরা দেবেন না। কিন্তু যে উনিশ লক্ষ চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ গেছেন তাঁদের বেলা কী হতে পারে? এ বার আর উত্তর মোটেই সহজ নয়।
মৃণাল সেনের কোরাস ছবির ৩০,০০০-এর মতোই এনআরসি-নির্বাসিত উনিশ লক্ষও এখন এক প্রতীকী ব্যঞ্জনা পেয়েছে। বৈষম্য, বঞ্চনা আর প্রতিনিয়ত সরকারি যন্ত্রের নিগ্রহে ক্লিষ্ট এই ‘পরবাসী’রাই এখন এই সিএএ পর্বে যাবতীয় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।
এনআরসি-অন্তর্ভুক্তরা নাগরিকত্বের শংসাপত্র পাননি, কারণ নাগরিক পঞ্জিতে রেজিস্ট্রার জেনারেলের সিলমোহর পড়েনি। এ বিষয়ে আগে বিস্তারিত আলোচনা করেছি (আবাপ, ‘এই বিলে নাগরিকত্ব কোথায়’, ৯/১২/২০১৯, আর ‘নাগরিকত্ব সঙ্কটটা বানানো হচ্ছে’, ১০/১২/২০১৯)। কিন্তু যাঁরা বাদ পড়লেন তাঁদের তো না ঘরকা না ঘাটকা দশা। করদাতাদের পকেটের ১৬০০ কোটি টাকা খরচে চার বছর ঘাম ঝরিয়ে যে নাগরিক পঞ্জি তৈরি হল তা বৈধ না অবৈধ, আজ অবধি সরকার, আইনসভা, ন্যায়ালয় কেউই ঠাহর করতে পারল না। অথচ যাঁদের বাইরে ঠেলে দেওয়া হল তাঁরা এখন সমাজ-সংসারে অপাঙ্ক্তেয়দের দলে।
সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভাবে অচ্ছুতকরণ মানব সভ্যতার পুরনো বদভ্যাস। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সমাজে ও রাষ্ট্রে কেমন করে গ্রহণ ও বর্জন করে এ নিয়ে সমাজতত্ত্বে উল্লেখযোগ্য ও বিস্তৃত গবেষণা রয়েছে। লেভি-স্ট্রস, ডগলাস কিংবা র্যাডক্লিফ-ব্রাউনদের গবেষণায় দেশ-কাল-সমাজ নির্বিশেষে ক্ষমতাতন্ত্র যে একটি বর্গকে সুয়োরানি করে অপর বর্গকে দুয়োরানি করে রেখে দেয়, এর হাতেনাতে প্রমাণ আমরা দেখেছি। এই উনিশ লক্ষও তেমনই এক হতভাগ্য গোষ্ঠী। নাগরিকত্ব (নাগরিকদের পঞ্জিকরণ ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান) বিধি, ২০০৩-এর এনআরসি প্রস্তুতি-প্রণালীতে সন্নিবিষ্ট অনুসূচির ৮ নম্বর ধারায় চূড়ান্ত তালিকা জারি হওয়ার ষাট দিনের মধ্যে এনআরসি-ব্রাত্যরা বিদেশি ট্রাইবুনালে তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্তি চেয়ে আবেদন জানাতে পারেন। কিন্তু যে-হেতু এনআরসি-ই আইনের চোখে আজও সরকারি নথির মর্যাদা পায়নি, এঁরা বিচারালয়েও যেতে পারছেন না। এ বার সিএএ-তেও, বলা বাহুল্য, দেখা যাবে এঁদের বিধি বাম। প্রকাশিত বিধিতে আবেদন জমা পড়ার পর জোড়া কমিটির চৌকাঠ ডিঙিয়ে কবে নাগরিকত্বের মহার্ঘ শংসাপত্রটি হস্তগত হবে, এই মর্মে কোনও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। ফলে এঁদের ঝুলতে হবে অনির্দিষ্ট কাল।
এ তো গেল এক সমস্যা। সঙ্কট রয়েছে অন্যত্রও। ওই উনিশ লক্ষের অমুসলমানরা সবাই তাঁদের এনআরসি আবেদনে নিজেদের ভারতীয় নাগরিক হিসাবে দাবি করেছিলেন। আজ এঁরাই আবার সিএএ-র বেলা কী করে বিদেশি বা অনুপ্রবেশকারী ঘোষণা করে হলফনামা জমা দেবেন? তথ্য গোপন করা কিংবা জ্ঞানত ভ্রান্ত তথ্য পরিবেশন করা তো নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র সংশ্লিষ্ট ধারা এবং ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ফৌজদারি অপরাধ। এ তো দেখছি, ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারার গোসাঁই!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাবধানবাণী তা হলে নেহাত অমূলক নয়! তবে তাঁর রাজ্যের পরিস্থিতির সঙ্গে অসমের অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনৈতিক চিত্র তেমন মেলে না, এ আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। প্রধান পার্থক্যটি হচ্ছে, ওখানে কোনও এনআরসি নেই। বাংলায় কথা বলার জন্য কাউকে বিদেশি বা বহিরাগত বলে দেগে দেওয়া হয় না। তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে ‘ঠাকুরবাড়ি’ না সিএএ-বিধির অভিঘাতে সদলবলে পদ্মবনে চলে যায়। নদিয়া ও দুই চব্বিশ পরগনার অন্তত ত্রিশটি বিধানসভা এলাকাতে মতুয়া ভোট ফলাফলে এ-দিক ও-দিক মাত করে দিতে পারে। এই সরল সত্যটি বুঝতে মমতার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দেরি করেনি।
কিন্তু বিশ্লেষকদের কাছে যে-বিষয়টি কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ দাবি করে, তা হল অসমের মুখ্যমন্ত্রী কেন সঙ্ঘ পরিবার এবং তাঁর দলের এই ‘ঐতিহাসিক’ সাফল্যকে তেমন গুরুত্ব দিতে গররাজি। এর জবাব রয়েছে তাঁর এবং বিজেপি’র নির্বাচনী বাধ্যবাধকতায়। অসমে প্রধান বিরোধী শক্তি কংগ্রেস দলত্যাগের হিড়িকে এবং দুর্বল প্রাদেশিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় যেমন হতোদ্যম অবস্থায় রয়েছে, তাতে বিজেপির পাতে যে ভাষা এবং উপত্যকা বিভাজনের বেড়া টপকে হিন্দু ভোটের প্রায় সবটাই পড়বে, এ নিয়ে এই মুহূর্তে অন্তত কোনও পক্ষেই সন্দেহের অবকাশ নেই। ১৯৯১ থেকেই অসমে ছিন্নমূল এবং স্থানীয় হিন্দু বাঙালিরাই বিজেপির বিজয়রথের চালিকা শক্তি। মোদীর উত্থানপর্বে পিলপিল করে হিন্দু বাঙালিরা বিজেপিকেই ভোট দিচ্ছে। ফলে, এই রাজ্যে হিন্দু বাঙালিকে আলাদা করে তুষ্ট করার জন্য আইনি সংশোধনী প্রণয়নের চার বছরেরও বেশি সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর আকস্মিক তড়িঘড়ি করে লোকসভা নির্বাচনের দোরগোড়ায় সিএএ বিধি জারি করার কোনও রাজনৈতিক যুক্তি থাকে না।
আবার উজান থেকে মধ্য অসম— অসমিয়ারাও বিজেপিকে ঢেলেই ভোট দিয়েছেন গত বিধানসভা নির্বাচনে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে পাশ হওয়ার পর হিংস্র ও উন্মত্ত প্রতিবাদ এবং পুলিশের গুলিতে পাঁচ জন প্রতিবাদকারীর মৃত্যু সত্ত্বেও অসমিয়া জাতীয়তাবাদ কিন্তু বিজেপির পাশেই গ্যাঁট হয়ে বসেছে। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে এটাই যে, তারা বুঝতে পেরেছে রাজ্যে আসু কিংবা অগপ নয়, হিমন্তবিশ্ব শর্মার বিজেপিই হচ্ছে ‘খিলঞ্জিয়া’ স্বার্থরক্ষার গ্যারান্টি। ডিলিমিটেশনের পর এই ভরসা শতগুণ বেড়েছে। সিএএ পোর্টাল গলে যে একটি মাছিও ঢুকবে না, এই সারসত্যটি অসমিয়া জাতীয়তাবাদের মর্মমূলে পৌঁছে গেছে।
এই যুক্তিশৃঙ্খলা থেকে যে-সিদ্ধান্তটি অনায়াস ও অনিবার্য ভাবে বেরিয়ে আসে তা হল ‘এ বার চারশো পার’ করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে আঠারো আসনকে আটাশে ওঠাতে হবে। মতুয়াদের কাছে টানতে সিএএ-ই তাই মোদীর ব্রহ্মাস্ত্র।
অর্থনীতি বিভাগ। কাছাড় কলেজ, শিলচর