এই মুহূর্তে বেশ কিছু দেশের সরকার কোটি কোটি টাকা চিপ উৎপাদনের পিছনে খরচ করে চলেছে। প্রতীকী ছবি।
মাইক্রোচিপ উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় ভারতের যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে বিগত দীর্ঘকালের মধ্যে দেশের ‘শিল্পনীতি’র সব চেয়ে বড় চাল বলে মনে হতে পারে। বহুকাল আগেই এমন সরকার-নির্দেশিত বা নির্ধারিত নীতিগত হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে মুক্ত বাণিজ্যের হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় কৌশলগত দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন প্রায় সব বড় অর্থনীতির দেশেই এমন সরকার-নির্দেশিত পন্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। সব থেকে বড় দুর্ভাবনার বিষয় এই যে, বিশ্বের মাইক্রোচিপ সরবরাহের অর্ধাংশ যে দেশটি থেকে আসে, সেই তাইওয়ান যদি চিনের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তা হলে কী হবে?
মাইক্রোচিপ বা বিশদ ভাবে বললে, সিলিকনের উপর খোদাই করে বসানো ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট এখন মোটর গাড়ি থেকে টেলি-যোগাযোগের যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ, প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম থেকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্র— যাবতীয় নির্মাণ শিল্পের কাছে অপরিহার্য এক বস্তু। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা বিদ্যুৎচালিত গাড়ির পৃথিবীতে দিনে দিনে তা আরও অপরিহার্য হয়ে উঠছে। পেট্রল বা প্রাকৃতিক জ্বালানিচালিত যন্ত্র থেকে যত বেশি সরে আসছে শিল্পজগৎ, ততই বেড়ে চলেছে চিপের চাহিদা। চিপ প্রস্তুতকারক শিল্পে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে আধুনিকতম গবেষণা এবং অবশ্যই উৎপাদনের বিপুল ব্যয়। আর সেই কারণেই বিশ্বে চিপ উৎপাদনের বিষয়টি সীমিত রয়েছে মাত্র আধ ডজন সংস্থার মধ্যে। আর তারাই এই শিল্প ও তার বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এই মুহূর্তে বেশ কিছু দেশের সরকার কোটি কোটি টাকা চিপ উৎপাদনের পিছনে খরচ করে চলেছে। উদ্দেশ্য, যদি চিপ উৎপাদনের বাজারে তাদের পক্ষে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ সম্ভব হয়। আমেরিকা এই খাতে ‘ইনসেন্টিভ’ হিসেবেই ৫২ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব রেখেছে। জানা যায়, চিন তার চিপ উৎপাদন বাণিজ্যে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। স্যামসাং তাদের নতুন চিপ কারখানায় ২০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য চিন্তাভাবনা করছে। আগামী এক দশকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ার পথে আগুয়ান, চিপ-ভিত্তিক উৎপাদনের অন্যতম বৃহৎ বাজার ভারত কি এমন অবস্থায় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? এই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজিতে ভর্তুকি হিসাবে ভারত অপ্রত্যাশিত ভাবেই ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এই অঙ্কটি কি যথেষ্ট বলে মনে হয়? এই বিপুলায়তন খেলায় আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন দেখা কি তার পক্ষে উচিত, নাকি একটি বিশেষ ব্যবস্থার অংশ হয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ, এই প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত উঠছেই।
চিপ উৎপাদনের জন্য এক ভিন্নতর পরিবেশের প্রয়োজন। এমন কিছু ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন, যা কারখানাগুলিতে শ্রম সরবরাহকে সম্ভব রাখবে (এমন ক্ষেত্রে জাপান অগ্রগণ্য), দরকার ফোটোলিথোগ্রাফি সংক্রান্ত যন্ত্রের সুবিধা, যা সিলিকন পাতের উপরে সার্কিটের ফোটো প্রিন্ট বসাবে (এখানে আবার একান্ত ভাবে নেদারল্যান্ডস অগ্রগণ্য) এবং পরিশেষে দরকার উৎপাদিত পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। যেমন, নিয়ন গ্যাস এবং প্যালাডিয়াম সরবরাহের মূল ক্ষেত্র ছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন। এই সংক্রান্ত দুর্লভ মাটি ও খনিজের উপর অধিকার কায়েম করতে চিন অনেক দিন ধরেই তৎপর। তার বিপরীতে আমেরিকা আবার খনিজ নিরাপত্তা বিষয়ক অংশীদারিত্বের বন্ধনে ১০টি দেশকে আটকে তাদের উপর খবরদারি চালাতে শু্রু করেছে। ভারত কিন্তু এই সব খেলার বাইরেই থেকে গিয়েছে।
এ সবের ফলে যা দাঁড়ায়, তা হল— এমন ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার অপরিহার্য হয়ে ওঠা। আমেরিকা যদি ‘লজিক চিপ’ ডিজাইনে অগ্রণী হয়ে থাকে, তা হলে দক্ষিণ কোরিয়া ‘মেমরি চিপ’ বানানোয় এগিয়ে রয়েছে। ইনটেল বা তার মতো অন্যান্য সংস্থা তাইওয়ান থেকে সিলিকন ওয়েফার বরাত দিয়ে তৈরি করে নেয়। জাপানের চিপ শিল্প এখনও পুরনো প্রযুক্তিকে আঁকড়ে রয়েছে (এরও এক গুরুত্বপূর্ণ বাজার আছে)। আমেরিকায় ইনটেল যেখানে ১০ ন্যানোমিটারের (এক মিলিমিটারের ১০০,০০০ ভাগের এক ভাগ) থেকে সূক্ষ্ম চিপ তৈরি করতে পারেনি, সেখানে তাইওয়ান সেমি কন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি এবং স্যামসাং ৩ ন্যানোমিটার মাপের চিপ তৈরি করতে সমর্থ। চিন আটকে আছে ৭ ন্যানোমিটারে। অন্য দিকে, আমেরিকা ও জাপান যৌথ ভাবে ২ ন্যানোমিটারের চিপ তৈরি করার জন্য জোট বেঁধেছে। এমন জোট আরও তৈরি হবে, আশা করা যায়।
এখন প্রশ্ন, ভারত কী করতে চাইছে? এ দেশে চিপ তৈরির বিষয়টিকে বৈদ্যুতিন শিল্পের ক্ষেত্রে এক বৃহত্তর, ইনসেন্টিভ-ভিত্তিক অনুপ্রবেশ বলে মনে হতে পারে। মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরির ক্ষেত্রে প্রাথমিক সাফল্য এ বিষয়ে খানিক আশার আলো দেখিয়েছে। এখন ডিসপ্লে ইউনিট (যা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র) নির্মাণের ক্ষেত্রে (ল্যাপটপ, হ্যান্ডসেট ইত্যাদি) এ দেশ কতখানি সফল হয়, তা দেখার। চিপ উৎপাদকরা ভারতকে মাঝারিমাপের চিপ (২৮ ন্যানোমিটার) প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে দেখতে চাইছেন। এমন মাপের চিপ গাড়ি তৈরি এবং স্মার্ট ফোন নির্মাণে কাজে লাগে।
অবধারিত ভাবে, বিশেষায়নের বিপরীতে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনের স্বপক্ষেও বেশ কিছু যুক্তি রয়েছে। চিপ ডিজাইনিংয়ের ক্ষেত্রে ভারতের দক্ষতা রয়েছে এবং চিপ প্রস্তুতের ব্যাপারে শ্রমনিবিড় পরিবেশের সুবিধাও এখানে রয়েছে (অ্যাসেম্বলিং, টেস্টিং এবং প্যাকেজিংয়ের)। ডাউনস্ট্রিম প্রোডাকশন (উৎপাদন প্রক্রিয়ার শেষ ধাপের কাজগুলি, যেমন বাজারজাত করা, বিক্রয়, বরাতমাফিক পণ্য সরবরাহ, ইনভয়েস তৈরি ইত্যাদি)-এর ক্ষেত্রেও ভারত দক্ষতার সঙ্গেই কাজ করতে পারবে। অ্যাসেম্বলিং ও মোবাইল হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে সে কথা প্রমাণিতও। কোনও কোনও যন্ত্রাংশ নির্মাণকারী সংস্থা বা সাব-অ্যাসেম্বলিং সংস্থা এখানে বিনিয়োগও করতে পারে। তেমন ক্ষেত্রে বিশ্বব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে চিপ উৎপাদনের উপযোগী পরিবেশ এ দেশে ক্রমশ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরকার যা চায়, তা এক সর্বাঙ্গীন এবং সম্পূর্ণ স্বনির্ভর ক্ষেত্রের বিকাশ। যার দ্বারা চিপ এবং ডাউনস্ট্রিম পণ্য, উভয়ের আমদানিই বন্ধ করা যাবে। যদিও উপাদান আর উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রের ব্যাপারে আপস্ট্রিম (উৎপাদনের প্রাথমিক স্তরের বিষয়) বিষয়গুলির আমদানি-নির্ভরতা থেকেই যাবে। আর যে হেতু সিলিকন ওয়েফার নির্মাণের বিষয়টি অতিরিক্ত মাত্রায় পুঁজি-নির্ভর এবং তা প্রযুক্তির ক্রমাগত বদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় বদল ঘটানো দাবি করে, সে হেতু এমন ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের বিষয়টি থেকেই যায়। এখন সরকার আপাত ভাবে মনে করে, ভারতের তরফে এই খেলায় অংশ নেওয়া একান্তই প্রয়োজন। কয়েক বছরের মধ্যে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তার উচ্চাশাই তার উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, নাকি এটি এমন এক পন্থার জন্ম দেবে যা ভারতীয় অর্থনীতিকে এক নতুন দিশা দেখাতে পারে।