প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
দূরপাল্লার সাইকেল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত ‘পেলোটন’ নামে এক বিশেষ ছকে এগোতে থাকেন। ছকটি অনেকটা উড়ন্ত হাঁসেদের সারির মতো। সকলের আগে একজন সাইকেলচালক থাকেন, যিনি একটি বিশেষ পঙ্ক্তি তৈরি করেন। তাঁর পিছনে থাকা চালকেরা একটি বিশেষ কোণ থেকে তাঁকে অনুসরণ করেন। মাঝে মধ্যেই অগ্রবর্তী চালক বদল হন। পিছনের কেউ সামনে চলে আসেন।
অর্থনীতিরদীর্ঘমেয়াদিবৃদ্ধিরক্ষেত্রেওএই‘পেলোটন’আকৃতি লক্ষ করা যায়। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতির অগ্রবর্তী বর্গ একটি বিশেষ গতিছন্দ বজায় রাখে এবং তার অনুসরণকারীদের সেই ছন্দটি বজায় রাখতে সাহায্য করে। সময় বিশেষে অগ্রবর্তী বর্গে অন্য ক্ষেত্রকে দেখা যায়। এই ভাবেই গত তিন থেকে চার দশকে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির ছবি দেখা গিয়েছে।
সত্তরের দশকের সঙ্কটময় কালে ২.৫ শতাংশ থেকে আশির দশকে ৫.৫ শতাংশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতিতে উঠে আসারফলে এক নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়। এর ফলে বিভিন্ন রকমের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। যার মধ্যে তাৎক্ষণিক ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি ভোগ্যপণ্যসবই পড়ে। সেই সময় থেকেই মোটরগাড়ি নির্মাণ শিল্পে অগ্রগতি দেখা দেয়। মারুতির মতো ছোট গাড়ি এবং দু’চাকার গাড়ির চাহিদা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়তে শুরু করে।
পরবর্তী পর্যায়ে, অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকে ভারতের তুলনামূলক ভাবে কম পারিশ্রমিকেরপ্রযুক্তিবিদেরা বিদেশের তরফ থেকে আউটসোর্সিংয়ের বরাত পেতে শুরু করলে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রবল উন্নতি দেখা যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন পেটেন্ট নেওয়ার ব্যাপারে পরিবর্তন এই দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক শিল্পগুলিকে দ্রুত আমেরিকার বাজারে প্রবেশের ছাড়পত্র দেয়। এটিও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। নব্বইয়ের দশকের আর্থিক সংস্কারগুলির অঙ্গ হিসাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পথ প্রশস্ত হলে ব্যাঙ্কিং বা ফিন্যান্সের মতো সহায়ক ক্ষেত্রগুলি ছাড়াও বিমান পরিবহণের মতো ক্ষেত্রে বৃদ্ধির লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাশাপাশিবাড়ি, গাড়ি ও পর্যটনের বাজারে চাহিদা বাড়তে শুরু করে।
যদি সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়, তবে তার পিছনে রয়েছে পূর্বোল্লিখিত সাইকেল রেসের সব থেকে অগ্রবর্তী প্রতিযোগীর স্থান দখলের ব্যাপারে কোনও শিল্পক্ষেত্রেরই সে জায়গায় উঠে না আসা। ইতিমধ্যে ওষুধ তৈরির শিল্পে গতিহীনতা দেখা দেয়। এর পিছনে শিল্প পরিচালনার ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি এবং নিয়ন্ত্রণগত ব্যর্থতাই দায়ী। এই মুহূর্তে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির গতি কমে এসেছে। তার কারণ, এই ক্ষেত্রটি তার পরিণত দশায় গিয়ে পৌঁছেছে। এবং নোটবন্দি ও কোভিড অতিমারির মতো পর পর কিছু ঘটনায় দেশজ ভোক্তা-চাহিদায় হ্রাস ঘটেছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দু’চাকার গাড়ি বিক্রির বাজারে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, ভারতীয়দের আয়স্তরের নিরিখে ভোগ্যপণ্য কেনার ব্যাপারে ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া। বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রে ভারতের ঝুলিতে একটি মাত্র উল্লেখযোগ্য সংস্থা (আর একটি সম্ভাব্য সংস্থা) পড়ে রয়েছে, যেখানে বৃদ্ধির উপযোগী বিনিয়োগ সম্ভব। এর মধ্যেই গত দশকে পণ্য রফতানির পরিমাণ বেশ কমে এসেছে। মূলত ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের মতো প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে পণ্য উৎপাদনে সমকক্ষতা অর্জনে ব্যর্থতাই এর পিছনে কাজ করেছে।
এখন প্রশ্ন হল, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির পরবর্তী পর্যায়ে কোন ক্ষেত্রটি বা কোন কোন ক্ষেত্রগুলি অগ্রণীর ভূমিকা নিতে পারে।সরকার পণ্য উৎপাদনের মতো ব্যর্থতার জায়গাগুলিতে জোরদার পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে। ‘মেকইনইন্ডিয়া’ প্রাথমিক অবস্থায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি। সুতরাংবিনিয়োগএবংউৎপাদন— বিশেষত ইলেক্ট্রনিক্স শিল্পে সরকারকে আর্থিক ইনসেন্টিভ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ করতে দেখা যাচ্ছে। আমদানি ক্ষেত্রে এই বিকল্প সন্ধানের সময়ে বৃদ্ধির গতি অব্যাহত রাখতে বৃহত্তর পরিকাঠামোযুক্ত শিল্পে নজর রাখতে হয়েছে। এর ফলে ধাতু ও সিমেন্টের মতো শিল্পে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে।
পরিকাঠামোগত এবং উৎপাদনগত ক্ষেত্রে ইনসেন্টিভ দেওয়ার ফলে সরকারি তহবিলের উপর চাপ পড়তে পারে। বিশদে দেখলে, অধিকাংশ (সব ক’টি নয়) নতুন উদ্যোগই পুঁজি-নিবিড় চরিত্রের। এর অর্থ, ‘আউটপুট গ্রোথ’ (কোনও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য বা পরিষেবার বৃদ্ধি)-এর প্রতিটি ক্ষেত্রে আরও বেশিমাত্রায় পুঁজি বিনিয়োগ। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে না। তার বদলেভোগের গতিছন্দ ধীর হয়ে আসবে। এবং শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক বৃদ্ধিও ধীরগতি প্রাপ্ত হবে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিই যেখানে ধীরগতির, সেখানে ভারতের তরফে মোটামুটি ভাবে ৫.৫-৬ শতাংশ বৃদ্ধির হার বৈদেশিক বিনিয়োগকে সচল রাখতে পারবে।
এবং এ ভাবেইপ্রধানমন্ত্রীর ‘গ্যারান্টি’র বিষয়টির দিকে তাকালে আশা জাগে, আগামী পাঁচ বছরে ভারত স্থবির জাপান বা ধীরগতির জার্মানির অর্থনীতিকে অতিক্রম করে যেতে পারবে। সে দিক থেকে দেখলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হয়ে ওঠা এক লক্ষণীয় ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। এবং তার জন্য যে ভারতকে বিপুল পরিশ্রম করতে হবে, এমনও নয়।
কিন্তু এই মুহূর্তে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল, ভারত কি তার ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র’ কাটিয়ে উঠতে পারবে? জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম আয়, শিক্ষা এবং জীবনযাপনের সামান্যতম উন্নতি (পরিশ্রুত পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ পরিষেবাটুকু পাওয়ার মতো দশা) কি সম্ভব হবে? এ বিষয়ে যখনই প্রকৃত চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা প্রস্তুত হই, দেখা যায় যে সে বিষয়ে উত্তর দেওয়ার মতো কাউকেই আর দেখা যাচ্ছে না।