১৯৯০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করে তফসিলি জাতি এবং জনজাতিদের পাশাপাশি সামাজিক এবং শিক্ষাগত ভাবে অনগ্রসর শ্রেণিদের জন্যও সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ চালু করার পর থেকে দেশে সামাজিক ন্যায় নিয়ে বহু বাগ্বিতণ্ডা চলে আসছে। এই বিতর্কে অধিকাংশ মতামতই আসে নানাবিধ পক্ষপাতদুষ্ট পূর্বধারণা এবং জাতিগত বিদ্বেষের ভিত্তিতে।
১৯৩১ সালের জনগণনার পর ভারতে আর কখনও পূর্ণাঙ্গ জাতিভিত্তিক জনগণনা না হওয়ায় তফসিলি জাতি ও জনজাতি ব্যতীত অন্য জাতিগুলির জনসংখ্যা এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির প্রকৃত তথ্য নেই। মণ্ডল কমিশনও ১৯৩১ সালে জনগণনার তথ্যের ভিত্তিতেই তার বিশ্লেষণ এবং সুপারিশ পেশ করেছিল। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা ও দেশভাগ এবং বিগত সাত দশকে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বড় মাত্রায় অভিবাসন হওয়ার ফলে ১৯৩১ সালের জাতিভিত্তিক জনগণনার তথ্যের বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা ক্ষীণ।
২০১১ সালে জাতীয় জনগণনার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক এবং জাতিভিত্তিক জনগণনা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে মোদী সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর সেই জনগণনার জাতিভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করতে অস্বীকার করে। ২০২১ সালের জনগণনা কোভিড অতিমারির সময় থেকেই স্থগিত হয়ে রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, ২০২৫-২৬ নাগাদ হয়তো জাতীয় জনগণনা শুরু হবে। এই আসন্ন জনগণনায় তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানবোন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ জাতিভিত্তিক জনগণনা সুনিশ্চিত করা সারা দেশের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ও প্রশিক্ষণ দফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ৭৫টি কেন্দ্রীয় মন্ত্রক এবং দফতর মিলিয়ে ১৮.৯ লক্ষ কর্মচারীর মধ্যে তফসিলি জাতির কর্মচারী ছিল ১৬.৮%, জনজাতির ৭.৩% এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) ২২%। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মক্ষেত্রে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব সরকার নির্ধারিত ২৭% সংরক্ষিত আসনের থেকে অনেক কম। সব থেকে উঁচু সরকারি পদ অর্থাৎ গ্রুপ-এ কর্মীদের মধ্যে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির কর্মীদের সংখ্যা মোট কর্মী-সংখ্যার মাত্র ১৮%, গ্রুপ-বি পদে ১৭.৫%।
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মক্ষেত্রে সর্বশেষ স্টাফ সেন্সাসের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে। তার পরের তথ্য কেন প্রকাশিত হয়নি, তা রাজ্য সরকারের জবাবদিহি করা উচিত। ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে মোট সরকারি কর্মচারী ছিল ৩০৫৫২৫, অর্থাৎ ৩ লক্ষের একটু বেশি (এই হিসাবে সরকারি স্কুলশিক্ষকদের ধরা হয়নি)। এর মধ্যে তফসিলি জাতির কর্মচারী ছিল ১৭%, জনজাতির ৫% আর অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মাত্র ৪.৩%। গ্রুপ-এ এবং গ্রুপ-বি পদে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির অংশীদারি আরও কম।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর কল্যাণ নীতি অনুযায়ী রাজ্যে সরকারি চাকরির ২২% তফসিলি জাতির জন্য আর ৬% জনজাতির জন্য সংরক্ষিত হওয়ার কথা। বাস্তবে এই কোটা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। সাচার কমিটি রিপোর্ট এবং রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ আসার পর ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষিত কোটা ৭% থেকে বাড়িয়ে ১৭% করা হয়েছিল, এবং ৪১টি অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অনগ্রসর শ্রেণির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ২০১২ সালে রাজ্য বিধানসভায় অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের জন্য নতুন আইন পাশ হওয়ার পর তালিকায় আরও ৬৫টি অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজ্য সরকার দাবি করেছিল যে, এর ফলে রাজ্যের মুসলমান সমাজের বহুলাংশই অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের আওতায় এসে গেছে। কিন্তু ২০১৪-১৫ সালের পর থেকে স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়ায় আদতে কত অনগ্রসর শ্রেণির মুসলমান এই সংরক্ষণের মাধ্যমে সরকারি চাকরি পেয়েছে সেটা আজ অবধি জানা যায়নি।
গত মে মাসে কলকাতা হাই কোর্ট ২০১২-র আইন-সহ রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ১০% বাড়তি সংরক্ষণ বাতিল করার পর সুপ্রিম কোর্ট গত সোমবার এ বিষয়ে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে। তবে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে সরকারি নিয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে আছে এই কারণেই।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জাতিভিত্তিক জনগণনার পক্ষেই অবস্থান নেওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় সরকার না করলে বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো এখানেও রাজ্যস্তরে জাতিভিত্তিক সমীক্ষা হোক। সেই পথে অনগ্রসর শ্রেণির হিন্দু এবং মুসলমানদের সংরক্ষণের ন্যায্য কোটা যুক্তিসঙ্গত ভাবে নির্ণয় করা যাবে। ১৯৮০-র মণ্ডল কমিশন বা ২০০৬-এর সাচার কমিটি রিপোর্ট দেখিয়েছিল যে তফসিলি জাতি, জনজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও বহুবিধ বৈষম্য, বঞ্চনা এবং শোষণের শিকার। এই অন্যায্য স্থিতাবস্থার অবসান ঘটাতে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি প্রয়োজন। জাতিভিত্তিক আর্থ-সামাজিক জনগণনা তার প্রথম ধাপ।