Violence

ওঁরা মূল্যায়ন করে নিয়েছেন

হাইডেলবার্গে ইটালীয় তরুণী অ্যালিস বললেন, “আমরা একটি পডকাস্ট প্রোগ্রাম তৈরি করছি। বিষয়: ভারতে গণতন্ত্র কতটা বিপন্ন?”

Advertisement

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৪ ০৬:৪২
Share:

অস্ট্রিয়ার সুরম্য রাজধানী ভিয়েনাতে রাত সাড়ে এগারোটা। টিভির পর্দায় প্রদর্শিত হচ্ছে বিবিসি-র অতীব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘হার্ড টক’ বা ‘কঠিন কথোপকথন’। ডাকসাইটে সাংবাদিক, স্টিফেন সাকুর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছেন তরুণ কংগ্রেস নেতা সচিন পাইলটকে। তাঁদের সংলাপের বিষয় ‘নির্বাচন-পরবর্তী ভারতে পরিবর্তিত রাজনীতির চিত্র’। সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে ঘোড়েল প্রশ্নকর্তা একটি বিস্ফোরক প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, কমিউনিস্টরা তো ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের সদস্য। রাহুল গান্ধীও হুমকি দিয়েছেন যে বিরোধীরা সংসদের চার দেওয়ালের মধ্যেই তাঁদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সীমিত রাখবেন না। এর ফলে কি দেশের স্থিতিশীলতা (স্টেবিলিটি) এবং শৃঙ্খলা (অর্ডার) বিপর্যস্ত হতে পারে?”

Advertisement

উত্তরে সচিন পাইলট কী বললেন, তা ঊহ্য থাক। সংলাপটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল ফোন। ও দিক থেকে কথা বলছেন ইউক্রেন থেকে আগত রাজনীতি-বিজ্ঞানী য়ুলিয়া উরিয়োচেঙ্কো। ভিয়েনায় কর্মরত এই গবেষক তখন যারপরনাই ক্রুদ্ধ, বললেন, “সবজান্তা সাকুর কী মনে করেছেন? ‘স্টেবিলিটি’ এবং ‘অর্ডার’ বলতে উনি কী বোঝাচ্ছেন? গত আট মাস ধরে মণিপুরে যে অভূতপূর্ব ‘শান্তি’ এবং ‘শৃঙ্খলা’ আমরা দেখেছি, তার কথা কে বলবে? বিরুদ্ধবাদী বহু সাংবাদিক, অধ্যাপক, গবেষক, সমাজকর্মীকে বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাগারে শৃঙ্খলিত করে রাখা, এর নামই কি ‘শৃঙ্খলা’? আমদাবাদের একটি ছাত্রাবাসে সম্পূর্ণ বিনা কারণে বিদেশ থেকে আগত মুসলিম ছাত্রদের উপর পরিচালিত নির্বিচারে আক্রমণ। গৈরিক বাহিনীর দুর্বৃত্তদের এই ভয়ঙ্কর হামলা কি সামাজিক স্থিতিশীলতার নিদর্শন?” ক্ষুব্ধ গবেষকের এই প্রতিক্রিয়া শোনা গেল ছাত্র, গবেষক, শিক্ষক, এনজিও কর্মী, ধর্মীয় প্রতিনিধি, নানা জনের কথায়। এও শোনা গেল, “এ বারে নিশ্চয়ই আপনারা ঘোর সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন!”

অস্ট্রিয়ার নাগরিক, গবেষক কাস্পার নোভাক ফলাফল প্রচারের পর দিনই কম্পিউটার খুলে বললেন, “দেখুন, জনপ্রিয় অস্ট্রিয়ার ইন্টারনেট পত্রিকা আলোচ্য প্রতিবেদনের কী শিরোনাম দিয়েছে, ‘ভারতে ঘৃণার মতাদর্শের পরাজয় ঘটেছে’।” তিনি বললেন, “আপনাদের প্রধানমন্ত্রী রাজস্থানের এক নির্বাচনী সভায় ভারতের তামাম সংখ্যালঘুগোষ্ঠীকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলেছেন। একাধিক জার্মান সংবাদপত্রে এই উক্তি ছাপা হয়েছে। রিয়ালপলিটিক ও ভারতের বিপুল বাজারকে স্মরণে রেখে নেতারা যে যা-ই বলুন, আমরা সাধারণ মানুষ আমাদের মূল্যায়ন করে নিয়েছি।”

Advertisement

হাইডেলবার্গে ইটালীয় তরুণী অ্যালিস বললেন, “আমরা একটি পডকাস্ট প্রোগ্রাম তৈরি করছি। বিষয়: ভারতে গণতন্ত্র কতটা বিপন্ন?” সেখানকার দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটে সহযোগী গবেষকের ভূমিকায় তিনি ও তাঁর জার্মান বন্ধু এই রিপোর্টটি প্রস্তুত করছেন। তাতে ‘বিশ্বগুরু’র বন্দনার ছিটেফোঁটা কোথাও নেই। যাঁরা মতামত দিয়েছেন সকলেই বলেছেন যে, ভারতে নিখাদ স্বৈরাচার চলেছে, এবং আশা প্রকাশ করেছেন যে নির্বাচনের পরিণতি যেন এই পরিস্থিতি রুখে দিতে সক্ষম হয়। রাজনীতি বিজ্ঞানের নামী অধ্যাপকেরাও এই পডকাস্টে সরবে গত দশ বছরের ঘটনাবলির জোর সমালোচনা করেছেন।

এক শিক্ষক মুক্তকণ্ঠে বললেন, “ভারতকে বুঝবার-জানবার জন্য আমরা যে যে বই পড়ি, অমর্ত্য সেনের দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান এবং অরুন্ধতীর আজ়াদি— আমাদের মনোভাব এঁরাই তৈরি করে দিয়েছেন।” প্রতিবাদী অঙ্গীকারে নিবেদিত ফরাসি তরুণ জঁ পল দুসোঁ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ছাত্র। রোমাঁ রোল্যাঁর হাত ধরে তিনি আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দকে। অন্য দিকে, ফরাসি পণ্ডিত ক্রিস্তোফ জাফ্রেলো-র বই পড়ে তিনি হিন্দুত্বকে বুঝেছেন। ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন তাঁদের প্রেসিডেন্ট মাকরঁ (যিনি এই মুহূর্তে প্রাক্তন) “নিজের দেশের বর্ণবাদী দক্ষিণপন্থীদের সমালোচনায় মুখর, অথচ এই কিছু দিন আগেই তিনি মোদীকে বাস্তিল দিবসের মুখ্য অতিথি হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তখন ল্য মঁদ-এর মতো প্রভাবশালী পত্রিকা থেকে শুরু করে ফরাসি টেলিভিশন তাঁকে বারংবার সতর্ক করে বলেছিল যে, এই মানুষটির সঙ্গে বাস্তিল দিবসের আদর্শ স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব-র কণামাত্র যোগ নেই। রাফায়েল জেট কিনলেই তুমি ‘উত্তম পুরুষ’, এই বিচার অশ্লীল, অসহনীয়।”

দুসোঁর ব্যঙ্গোক্তি: “আমাদের প্রেসিডেন্ট আপনাদের প্রধানমন্ত্রীকে ভালবেসে আমাদের পরমসম্পদ মার্সেল প্রুস্তের অনবদ্য সাহিত্যকীর্তি অতীতের স্মৃতিমন্থন বইটি উপহার দেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর পূর্বসূরি নেহরুর মতো বিদ্বান কি না জানি না। তবে স্মৃতিচয়নের অধিকার তাঁর নিঃসন্দেহে আছে— কিন্তু স্মৃতিচয়নের বিষয়টি কী হবে? গুজরাতে সংখ্যালঘুদের গণহত্যা?”

হাইডেলবার্গে ‘ভারতের গণতন্ত্র নতুন পরিক্রমা’ নামে আন্তর্জাতিক সেমিনারে ভারত থেকে যোগ দিয়েছিলেন প্রখ্যাত বিরুদ্ধবাদী হর্ষ মন্দার, বিরোধী রাজনীতিবিদ মণিশঙ্কর আইয়ার, আরও অনেক প্রতিবাদী। ঘটনা হল, এক বছর আগেও পশ্চিম ইউরোপের বুকে এমন আলোচনার আয়োজন করা সহজ ছিল না। সময় কি তা হলে বদলাচ্ছে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement