দ্রোহকাল: আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে জুনিয়র চিকিৎসকদের অনশন মঞ্চের সামনে সাধারণ মানুষের ভিড়, ২০ অক্টোবর। ছবি পিটিআই।
কম বয়সের এক বন্ধু ছিল, কম বয়সেই দুম করে চলে গেছে। তার একটা অভ্যাস ছিল, কোনও ব্যাপারে কিছু ক্ষণ কথাবার্তা চলার পরে সে বলত, “তা হলে আমরা এখন কোথায় এসে দাঁড়ালাম?” আমরা হাসতাম, পিছনে লাগতাম, কিন্তু ওই অভ্যাসটি সে ছাড়েনি। ইদানীং ওই কথাটা খুব মনে পড়ছে। শারদোৎসব শেষ হয়েছে, অন্তত ক্যালেন্ডারের মতে। এ-বারের শারদীয় পরিবেশ একটু অন্য রকম ছিল। প্রতিবাদের জনজাগরণ থামানোর তাগিদে ক্ষমতার আসন থেকে ‘উৎসবে ফিরুন’ মার্কা আহ্বান জারি হওয়ার পরেও নাগরিকদের একটি বড় অংশ উৎসবে ফেরেননি, বরং শাসকের মুখের উপর ছুড়ে দিয়েছেন প্রতিস্পর্ধার ধারাবাহিক কার্যক্রম। উৎসব দিয়ে প্রতিবাদ থামানোর অস্ত্রটিকে ব্যুমেরাংয়ে পরিণত করে জন্ম নিয়েছে নতুন শব্দবন্ধ: দ্রোহের উৎসব। সরকারি ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত নৃত্যগীতমুখর গঙ্গাযাত্রার পথেও কার্নিভাল-ধন্য প্রতিমাগণ রাজপথের ও-পারে জমজমাট বিক্ষোভ সমাবেশ দর্শন করেছেন, শুনেছেন সহস্রকণ্ঠে ঘোষিত ‘বিচার চাই’ আওয়াজ। দেখেশুনে মহিষমর্দিনী ও তাঁর পুত্রকন্যারা হয়তো ঈষৎ ভরসা নিয়েই রাজ্য ছেড়েছেন— এই ভরসা যে সমাজটা তবে একেবারে ফুরিয়ে যায়নি, ক্ষমতার মুখের উপর সত্য ভাষণের তাগিদ আজও অবশিষ্ট আছে। বিসর্জনের পরেও, দেবীপক্ষের শেষ অবধি, দেখা গিয়েছে প্রতিবাদের জোয়ার। তার পর এক দিন শুরু হয়েছে ভাটার টান, তরুণ চিকিৎসকদের অনশন-পর্বের অবসান হতেই প্রতিবাদের পারদ দ্রুত নেমে এসেছে, মুষলধার শেষ হয়ে যেমন বিক্ষিপ্ত বর্ষণ। এই বর্ষণ সম্ভবত ক্রমশ ক্ষীণ হবে, হয়তো অচিরেই বিলীন হবে। আর তাই ইতিমধ্যেই অমোঘ, অনিবার্য হয়ে উঠেছে ওই প্রশ্নটি: আমরা তবে কোথায় এসে দাঁড়ালাম?
একটা প্রতিপ্রশ্ন উঠতে পারে: কোথাও এসে কি দাঁড়াতেই হবে? দাঁড়াতে হবেই? কেন? বিশেষ করে এই আপনবেগে পাগলপারা বিরামহীন ছুটে চলার যুগে? যখন মোবাইলের পর্দায় রিলের পরে রিল চলতেই থাকে, চোখের পলক পড়ার আগেই একটার জায়গায় আর একটা শুরু হয়, দাঁড়ানোর ফুরসত কোথায়, দাঁড়ানোর প্রশ্নই বা উঠছে কেন? কিন্তু ঠিক এই কারণেই, আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় এখন সতত সঞ্চরমাণ বলেই তো আরও বেশি করে ভাবা দরকার কোথায় এসে দাঁড়ালাম। কথা তো ছিল এই যে, ক্ষমতার দুরাচারের বিরুদ্ধে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ এই নাগরিক আন্দোলন অনেক দিন ধরে জমে ওঠা পঙ্কিল অন্ধকার সরিয়ে নতুন আলোর সন্ধান দেবে, আমরা সেই আলোর পথযাত্রী হয়ে এগিয়ে যাব। তা, এগিয়ে যাওয়ার পথেও দাঁড়াতে হয় বইকি, সামনের পথটাকে ভাল করে দেখে নেওয়ার, বুঝে নেওয়ার জন্য দাঁড়াতে হয়। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকা নয়, দিশাহারা চরকিপাক খাওয়াও নয়, সেই স্থিতি আসলে অগ্রগতির পরিপূরক, তার শর্ত। আড়াই মাসের উত্তাল আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার পরে, এখনই সেই শর্ত পূরণের সময়। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে অতীত এবং ভবিষ্যৎকে দেখে নেওয়ার সময়। ভাবার সময়, অতীত আমাদের যেখানে এনেছে, সেখান থেকে কোন ভবিষ্যতের পথে রওনা হতে পারি? যদি না ভাবি, তা হলে ফের ওই চরকিপাকের কবলে পড়ে যেতে হবে, রিলের পরে রিল ঘুরতে থাকবে, আমরাও নির্নিমেষ নয়নে সে দিকে তাকিয়ে থাকব, কোনটা রিল আর কোনটা আমি সেটাও ক্রমে ক্রমে আর খেয়াল থাকবে না, আলোয় আর বাজিতে আর হ্যাপি দিওয়ালিতে মেতে ওঠার মৌতাত ভাঙতে না ভাঙতেই বাতাসে হিমের পরশ পেয়ে জমবে ভাল, জমবে আবার মধুবংশীর গলি— যত ক্ষণ না নতুন কোনও প্রতিবাদের মরসুম আসে, আরও একবার উত্তেজনার আগুন জ্বালানো যায়।
প্রতিপ্রশ্ন পিছু ছাড়ে না, সে বলে: যদি প্রতিবাদ থেমেই যায় আপাতত, তা হলেও কি তা মূল্যবান নয়? অবশ্যই মূল্যবান। এত মানুষ এত দিন ধরে একযোগে সচল এবং সরব হয়েছেন বলেই তো ক্ষমতার অচলায়তনে অল্পবিস্তর নড়াচড়া দেখেছি আমরা, তার অধিপতিদের নানা বিষয়ে জবাবদিহির সুরে কথা বলতে শুনেছি, ইতস্তত জঞ্জাল সাফাই এবং ঘরদোর মেরামতির কিছু কিছু সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, নাগরিকের মনে একটা পুরনো এবং হারানো আত্মবিশ্বাস অল্প হলেও ফিরে এসেছে। আমরা নতুন করে ভাবতে শিখেছি যে অনেক অনেক ভোট পেয়ে বড় বড় চেয়ারে বসলেই যা খুশি করা যায় না, কেউ প্রশ্ন তুললে তাকে চোখ রাঙিয়ে, ধমক দিয়ে বা গালিগালাজ করে চুপ করিয়ে দেওয়া যায় না, সমবেত প্রত্যয়ে বৃহত্তম বা উচ্চতম চেয়ারের উদ্দেশেও প্রতিবাদ ছুড়ে দেওয়া যায়, বলা যায়: মানছি না। আড়াই মাস ধরে এই আত্মবিশ্বাসই গড়ে উঠতে দেখেছি আমরা, দেখেছি তার ধারাবাহিক ব্যবহার। এর দাম আছে বইকি।
এবং এ-কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই আন্দোলনের পর্ব শেষ হলেও নাগরিক সমাজের ভান্ডারে, অল্প হোক বা বিস্তর, কিছুটা প্রত্যয় থেকেই যাবে। প্লাবনের জল সরে যাওয়ার পরে যেমন পলি পড়ে থাকে। বস্তুত, রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা উপলক্ষে তার কিছু সুলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় অথবা ঊর্ধ্বতর স্তরে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষ ক্রমাগত সরব হয়েছেন, আবাস যোজনা সংক্রান্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভ তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। এই ধরনের প্রতিবাদ আগেও হয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সাম্প্রতিক জনজাগরণ দৃশ্যত সেই প্রতিবাদে বাড়তি শক্তি জোগান দিয়েছে, ক্ষমতাধারীদের মুখের উপর কথা বলার সাহস এবং তাগিদ বেড়েছে অনেক মানুষেরই। এটা কম কথা নয়। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে জনসাধারণের কণ্ঠস্বর এক অতি শক্তিশালী অস্ত্র। গণতন্ত্রকে ‘আলোচনার মাধ্যমে শাসন’ বলা হয়ে থাকে বটে, তবে সচরাচর সেই আলোচনা চলে উপরতলায়। সেই আধিপত্যের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে মাথা উঁচু করে উপরমহলকে দু’কথা শুনিয়ে দিতে পারার মূল্য কতখানি, সে-কথা নীচে থাকা মানুষজন বিলক্ষণ জানেন।
কিন্তু, সাধু সাবধান। উপরমহলও ইতিমধ্যে আত্মরক্ষার এবং পাল্টা আক্রমণের অস্ত্রগুলিতে পূর্ণ উদ্যমে শাণ দিয়ে নিয়েছেন, এ ব্যাপারে তাঁদের ভূরিপরিমাণ অভিজ্ঞতা আছে, তার চেয়েও বেশি পরিমাণে আছে পাটোয়ারি বুদ্ধি, যার অন্য নাম কৌশলী চতুরতা। তাঁরা জানেন, আকণ্ঠ দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত (হ্যাঁ, অভিযুক্তকে অভিযুক্ত বলাই ব্যাকরণসম্মত এবং নীতিসম্মত) হয়েও কী করে ‘জনতার আদালতে’ ক্রমাগত জয়লাভ করে চলা যায়। রাজনীতি নিশ্চয়তার খেলা নয়। কিন্তু নাগরিক চেতনার একটা প্রতিবাদী জাগরণ ঘটেছে বলেই, সেই প্রতিবাদের তরঙ্গ শহর ছাড়িয়ে গ্রামে এবং সরকারি হাসপাতালের পরিসর ছাড়িয়ে দুর্নীতির অন্য পরিসরগুলিতেও কিছুটা প্রসারিত হয়েছে বলেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির চরিত্র বদলাবে, এমন প্রত্যাশার একেবারেই কোনও কারণ নেই। শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমবেত এবং সরব হওয়াই যদি প্রতিস্পর্ধার শেষ লক্ষ্য হিসেবে গণ্য হয়, সেই লক্ষ্য পূরণ করেই যদি নাগরিক চেতনা সন্তুষ্ট ও কৃতার্থ বোধ করে, তবে বড়জোর পোশাকের রং এবং মুখোশের ঢং বদলাতে পারে, তার বেশি প্রত্যাশা করা বাতুলতামাত্র। প্রতিবাদ যত জরুরিই হোক, কখনওই যথেষ্ট হতে পারে না।
যথেষ্ট কী, তা আগে থেকে জানা সম্ভব নয়, কিন্তু তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার কাজটি শুরু করার পক্ষে এখনই বোধ হয় মাহেন্দ্রক্ষণ। অনেক দিন পরে নাগরিক সমাজের একটি অংশের চেতনায় কিছুটা প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। তার বাইরে যে বিপুল জনসমষ্টি, সেই অগণিত শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও সঙ্কটের সঙ্গে এই জাগ্রত নাগরিক সমাজের সংযোগ ক্ষীণ। এই সংযোগ তৈরি করাই এখন সংগ্রামী রাজনীতির প্রথম লক্ষ্য হওয়া দরকার। বিভিন্ন বর্গের জনসাধারণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, যথার্থ কাজের সুযোগ, বেঁচে থাকার পরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার মতো সমস্ত মৌলিক প্রয়োজন পূরণের দাবি হবে সেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ভোটের রাজনীতি এই প্রশ্নটিকে টাকার অঙ্কে মাপবার ছক বেঁধে দিয়েছে। এই ছক ভাঙাই এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ। কে সেই প্রয়োজন পূরণে কত টাকা দিচ্ছে এবং কারা সেই বরাদ্দের ক’আনা আত্মসাৎ করছে, তার অনুসন্ধান ও প্রতিবাদে সীমিত থাকলে চলবে না, ‘প্রয়োজন’ কাকে বলে তার ধারণাটিকেই নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে বহুকাল আমরা সেই নবনির্মাণের রাজনীতি দেখিনি। তার প্রথম শর্ত হল শ্রমজীবী মানুষের কাছে যাওয়া, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের সঙ্গে একযোগে তাঁদের বাস্তবকে বোঝা। সেই কাজটি শুরু করতে পারলে তবেই হয়তো কানাগলি থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে একটা নতুন পথের সামনে এসে দাঁড়ানো যাবে। অগ্রগতির পথ।