লড়াই: কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচনী প্রচারে বিনেশ ফোগত। ৩০ সেপ্টেম্বর, হরিয়ানা। পিটিআই।
আজ হরিয়ানার জুলানা কেন্দ্রে ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে কুস্তিগির বিনেশ ফোগতের। কংগ্রেসে যোগ দিয়ে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হলেন তিনি। তার আগে অবশ্য সদ্যসমাপ্ত প্যারিস অলিম্পিক্সের ৫০ কেজি ফ্রিস্টাইল বিভাগে ফাইনালে পৌঁছে যান। ফাইনালের দিন সকালে ওজন একশো গ্রাম বেশি থাকায় নিশ্চিত পদক হারান তিনি। বিনেশ এই অলিম্পিক্সে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর পছন্দের ৫৩ কেজি বিভাগের বদলে ৫০ কেজি বিভাগে নামতে। ৫৩ কেজি বিভাগে ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন অন্তিম পঙ্গাল, যখন বিনেশ লড়ছিলেন একাধিক মহিলা কুস্তিগিরের শ্লীলতাহানিতে অভিযুক্ত জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের পদত্যাগ ও বিচারের দাবিতে।
প্রথম রাউন্ডেই তাঁর সামনে পড়েন জাপানের শীর্ষবাছাই য়ুই সুসাকি— মেয়েদের কুস্তির এক জীবন্ত কিংবদন্তি। বিনেশের বিরুদ্ধে নামার আগে প্রায় দুশোটি খেলায় তিনি হেরেছিলেন মাত্র তিন বার, বিদেশি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এক বারও নয়। আন্তর্জাতিক কুস্তির ৮২টি খেলায় এক বারও হারেননি। এ-হেন অপরাজেয় সুসাকিকে বিনেশ পরাস্ত করেন, যা কপিল দেবের ভারতের ১৯৮৩-র ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের মতোই অবিশ্বাস্য। এই একটি জয়ই বিনেশকে অমরত্ব দিতে পারত। তাঁর স্বর্ণপদকের স্বপ্ন ভেঙে দিল অতিরিক্ত ১০০ গ্রাম।
অলিম্পিক্স ও বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে কুস্তিগিরদের দু’বার ওজন নেওয়া হয়— এক বার প্রথম দিন সকালে, যে দিন সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলা হয়। দ্বিতীয় বার দ্বিতীয় দিন সকালে, যে দিন শুধু পদকের দাবিদাররা খেলেন। কোনও এক দিন ওজন পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেই প্রতিযোগী ছিটকে যান গোটা প্রতিযোগিতা থেকে। অর্থাৎ, দ্বিতীয় দিন ওজন পরীক্ষায় বিনেশের ব্যর্থতা তাঁর প্রথম দিনের তিনটি জয়কেও অর্থহীন করে দেয়— যদিও প্রথম দিন তিনি ওজন পরীক্ষায় পাশ করেই খেলাগুলো জিতেছিলেন। কুস্তির অন্যান্য প্রতিযোগিতায় কিন্তু এই নিয়ম নেই। সেগুলিতে যে দিন এক জন খেলোয়াড় ওজন পরীক্ষায় ব্যর্থ হন, সে দিনের খেলা থেকেই তিনি বাতিল হন। অলিম্পিক্স-এর নিয়মটি যে যুক্তিহীন, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতের রায়ে তার উল্লেখ থাকলেও নিয়ম পূর্বনির্ধারিত হওয়ায় বিনেশের রুপোর পদকের আবেদন খারিজ হয়। এই নিয়ম হয়তো অচিরেই বদলাবে, কিন্তু বিনেশ থেকে যাবেন পদকহীন।
একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত কুস্তিতে অগ্রগণ্য। পরাধীন ভারতের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া-কৃতিত্বগুলির মধ্যে পড়ে ১৯১০ সালে গুলাম মহম্মদ বক্শ বাট (গ্রেট গামা) ও ১৯২১ সালে যতীন্দ্রচরণ (গোবর) গুহ-র পেশাদার কুস্তিতে বিশ্বখেতাব জয়। স্বাধীন ভারতের প্রথম ব্যক্তিগত অলিম্পিক পদক ছিল কাসাবা দাদাসাহেব যাদবের ১৯৫২-র হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্স-এ পুরুষদের ফ্রিস্টাইল কুস্তিতে ৫৭ কেজি বিভাগে ব্রোঞ্জ। ১৯৬০-এর অলিম্পিক্স-এ ৬০ কেজি বিভাগে পাকিস্তানের প্রথম ব্যক্তিগত অলিম্পিক পদক (ব্রোঞ্জ) জেতেন অবিভক্ত ভারতে জন্মানো মহম্মদ বশির। ২০০৮ থেকে ফ্রিস্টাইল কুস্তিতে ভারত কখনও খালি হাতে ফেরেনি। ২০০৮-এ সুশীল কুমার (পুরুষদের ৬৬ কেজি) ব্রোঞ্জ; ২০১২-তে সুশীল রুপো ও যোগেশ্বর দত্ত (পুরুষদের ৬০ কেজি) ব্রোঞ্জ; ২০১৬-তে সাক্ষী মালিক (মেয়েদের ৫৮ কেজি) ব্রোঞ্জ; ২০২০-তে রবি দাহিয়া (পুরুষদের ৫৭ কেজি) রুপো ও বজরং পুনিয়া (পুরুষদের ৬৫ কেজি) ব্রোঞ্জ; ২০২৪-এ আমন সেহরাওয়াত (পুরুষদের ৫৭ কেজি) ব্রোঞ্জ জেতেন। গত দুই দশকে ভারতীয় কুস্তির এই সাফল্যের কেন্দ্র হরিয়ানা, যে রাজ্য লিঙ্গবৈষম্যমূলক অপরাধের জন্য প্রায়শই শিরোনামে আসে।
আয়তন ও জনসংখ্যায় ছোট হয়েও, এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২-এ নারীদের উপর হিংসার ঘটনায় প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে ছিল হরিয়ানা। সাম্প্রতিক কালেও হরিয়ানার অনেক গ্রামে, এমনকি বিনেশের গ্রামেও, মেয়েদের খেলাধুলা তো দূরস্থান, প্রকাশ্যে বেরোনোকেও দেখা হত বাঁকা নজরে। সেই প্রতিকূলতার মধ্যে কী ভাবে বিনেশের কাকা এবং প্রথম কোচ মহাবীর সিংহ ফোগত তাঁর দুই মেয়ে গীতা ও ববিতাকে আন্তর্জাতিক কুস্তিগির তৈরি করেছিলেন, সে গল্প আমির খানের দঙ্গল সিনেমার উপজীব্য। সাক্ষী-বিনেশদের উত্থানের নেপথ্যেও সেই দুরূহ লড়াই। তার পরেও হরিয়ানায় মহিলা কুস্তিগিররা কি নিরাপদ? প্রশ্ন তোলে বিজেপি নেতা ব্রিজভূষণের নামে যৌন হেনস্থার একের পর এক অভিযোগ। সুবিচারের দাবিতে দিল্লির রাজপথে নামেন সাক্ষী-বিনেশ-বজরংরা। এই কুস্তিগিরদের অনেকেই একদা ছিলেন ঘোষিত বিজেপি-সমর্থক। বিনেশ নিজেও ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর গুণগ্রাহী। সরকারি অসংবেদনশীলতা, পুলিশি নির্যাতন বদলাতে থাকে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান। পছন্দের বিভাগে অলিম্পিক্স-এ যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হলেও বিনেশ সরে আসেননি লড়াই থেকে।
কুস্তির সঙ্গে রাজনীতির ঘনিষ্ঠতা সুপ্রাচীন। বহু প্রাচীন ভারতীয় কুস্তিগিরই ছিলেন রাজসভার প্রতিপালিত। জৈন পরম্পরায় খ্যাত উজ্জয়িনীর রাজসভার কুস্তিগির অট্টন যেমন হারিয়েছিলেন কৌশাম্বীর রাজসভার কুস্তিগিরকে। ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, জৈন পরম্পরার কৃষ্ণকাহিনি একমত যে, মথুরারাজ কংস কৃষ্ণ-বলরামকে হত্যার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর রাজসভার দুই কুস্তিগির চাণুর ও মুষ্টিককে। আবার কুস্তির নৈপুণ্যেই বিজয়ী হন কৃষ্ণ-বলরাম। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী গুপ্ত সমিতিগুলিতেও হত কুস্তিচর্চা। কুস্তি তাই হতে পারে শাসকের হাত বা প্রতিরোধের হাতিয়ার। বিনেশ-বজরংরা যখন লড়াই করছেন ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে, দাঁড়াচ্ছেন আন্দোলনরত কৃষকদের পাশে, যোগেশ্বর-ববিতারা তখন পক্ষ নিয়েছেন শাসক দলের।
গত লোকসভা নির্বাচনে হরিয়ানায় বিজেপি ও কংগ্রেসের সমসংখ্যক আসনে জয় আঘাত করেছে বিজেপির দুর্গে। বিধানসভা নির্বাচনের মুখে ফিরছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেনা ছবি। গোমাংস খাওয়ার সন্দেহে গোরক্ষকদের হাতে বাঙালি শ্রমিক সাবির মালিকের মৃত্যুর পরেও তাই হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর মুখে গোরক্ষার পক্ষে সাফাইয়ের সুর। কিন্তু হরিয়ানা বদলাচ্ছে। সম্প্রতি গোরক্ষকরা হিন্দু কিশোর আরিয়ান মিশ্রকে হত্যা করার পর, মুসলমান ভেবে ভুলবশত ‘ভাইকে হত্যা’র জন্য যখন ক্ষমা চায় আততায়ী, আরিয়ানের মা প্রশ্ন তোলেন, মুসলমান হলেই কি মেরে ফেলা যায়? প্যারিস অলিম্পিক্স-এ পাকিস্তানের আরশাদ নাদিমের কাছে জ্যাভলিন থ্রোতে নীরজ চোপড়া সোনার পদক খোয়ানোর পর সাংবাদিকদের উস্কানিমূলক প্রশ্নের উত্তরে নীরজের মা জানিয়েছেন, আরশাদ ও নীরজ দু’জনেই তাঁর সন্তানতুল্য। খেলার মাঠ সাহায্য করছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, রক্ষণশীলতার শিকল ভাঙতে। এক কালে মেয়েদের বাইরে বেরোনোর বিরুদ্ধেও বিরূপ অবস্থান নেওয়া হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতগুলিই সম্মিলিত ভাবে বিনেশের গলায় পরিয়ে দিয়েছে সোনার পদক!
তবে এই বৃহত্তর জয় বা জনগণের সাময়িক প্রশংসাও অলিম্পিক্স-এর পদক নয়। নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মঞ্চ থেকে উঠে, নিজের পছন্দের বিভাগ বদলে, সুসাকিকে হারানো বিনেশ সোনা জিতলে তা হত বক্সিংয়ে প্রতিবাদী মহম্মদ আলির উত্থান বা ১৯৩৬-এর মিউনিখ অলিম্পিক্স-এ হিটলারের আর্যশ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ ভেঙে কৃষ্ণাঙ্গ জেসি ওয়েন্সের চারটি সোনা জয়ের মতোই স্মরণীয়। কিন্তু, বাস্তব এটাই যে, বিনেশের পরিসংখ্যানে থাকবে শুধু বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে দু’টি ব্রোঞ্জ, কোনও অলিম্পিক্স পদক নয়। বিনেশ যদি রাজনীতির লড়াই সেরে, অবসর ভেঙে লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক্স-এ ফেরেনও, তাঁর বয়স হবে ৩৩। তখন পদকের আশা হয়তো অসাধ্যসাধনের চেষ্টা। কিন্তু, বিনেশ ফোগত তো হয়ে উঠেছেন অসাধ্যসাধনেরই সমার্থক।