ডন নিকোলাস এক ব্যতিক্রমী আমেরিকান সেনা। ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগনের পতনের পরে মেরিন গার্ড হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। কয়েক দশক পরে আবার পদাতিক সেনা হিসেবে টহল দিয়েছেন আফগানিস্তানের পাহাড়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলের সবুজ আর হিন্দুকুশের বাদামি রূপ তাঁর স্মৃতিতে তাই কোথায় যেন মিলেমিশে এক হয়ে যায়। ভিয়েতনামেরই যে পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে আফগানিস্তানে, সেই কথাই সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন নিকোলাস।
ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। আমরা স্মরণ করব ভিয়েতনামের প্রতিবেশী কাম্বোডিয়ার ইতিবৃত্ত। হয়তো ১৯৭৫-এর কম্বোডিয়ার চিত্রনাট্যের অমোঘ, অলঙ্ঘনীয় পুনরভিনয় হতে চলেছে ২০২১-এর আফগানিস্তানে। বছর পাঁচেক ব্যর্থ চেষ্টার পরে ১৯৭৫-এর এপ্রিলে প্রবল শক্তিধর আমেরিকা কাম্বোডিয়াকে “পরিত্যাগ করে তুলে দেয় কসাইয়ের হাতে”, বলেছেন কম্বোডিয়ায় আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জন গুন্টার ডিন। পাঁচ দিন পরেই আমেরিকা-সমর্থিত সরকারের পতন হয় কমিউনিস্ট খ্মের রুজ গেরিলাদের হাতে। নমপেনের ২০ লক্ষ বাসিন্দাকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের বাইরে। মৃত্যুদণ্ড, অনাহার, অত্যাচারে মারা যান প্রায় ২০ লক্ষ কাম্বোডিয়ান, দেশবাসীর এক-চতুর্থাংশ।
আর আজ? আফগানিস্তানের চক্রব্যূহ থেকে বেরোনো আমেরিকার কৌশলগত এবং রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। আবার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও সুর চড়িয়েছেন অনেকে। সৈন্য প্রত্যাহারের পরেই যে আফগান সরকারের পতন ঘটবে আর দেশটা তালিবানদের দখলে যাবে, সকলেই জানত। তবে তালিবানরা খ্মের রুজের মতো বর্বর হবে কি না, তা আপাতত জল্পনাতেই সীমাবদ্ধ। যদিও ১৯৯৬-২০০১ এই পাঁচ বছরের শাসনকালে নারীদের দমন করে রাখা, যৌন-দাসত্বের জন্য বিক্রি, মৃত্যুদণ্ড, সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে ধ্বংস করা, বিরোধীদের হত্যা, ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই আগামী তালিবান শাসনের রূপরেখার একটা ধারণা করা সম্ভব।
আমেরিকা অনেক আগেই যুদ্ধটা শেষ করে ‘জয়’ ঘোষণা করতে পারত, অন্তত এক দশক আগে, ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর। কিন্তু ক্রমে তালিবানদের ঠেকানো আর দেশটার পুনর্গঠনকে উদ্দেশ্য করে তুলে আমেরিকা নিজেরাই জড়িয়ে পড়েছে দায়বদ্ধতার জাঁতাকলে। এবং পরাজয় ডেকে এনেছে তাদের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে।
“রাজনীতির প্রথম নিয়ম: কখনও আফগানিস্তান আক্রমণ করতে নেই,” এমনটাই বলেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান, সেই ১৯৬৩ সালে। আসলে আফগানিস্তানের ঊষর পার্বত্য প্রদেশে যুদ্ধ আর পাঁচটা যুদ্ধের থেকে অনেক আলাদা। ঐতিহাসিক ভাবেই পাশতুনরা কখনও তাদের ভূমির বিদেশি অধিগ্রহণ সহ্য করেনি। দীর্ঘ দিন আফগানিস্তানে কাটানো এক সাংবাদিক ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব তাঁর বই ফেয়ারওয়েল কাবুল: ফ্রম আফগানিস্তান টু আ মোর ডেঞ্জারাস ওয়ার্ল্ড-এর প্রথম পরিচ্ছদে বর্ণনা দিয়েছেন ১৮৪২-এর প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের সময়কার এক ঘটনার। এক আফগান জনজাতি-প্রধানকে এক ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ জিজ্ঞেস করেন তাঁর হাসির কারণ। জনজাতি-প্রধান উত্তর দেন, “কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি কত সহজে তোমরা সেনাদল নিয়ে চলে এসেছ এখানে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তোমরা এখান থেকে বেরোনোর কী পরিকল্পনা করবে।” আফগানিস্তানে যুদ্ধে যাওয়া আর অভিমন্যুর মতো চক্রব্যূহে আটকে পড়া সমার্থক। এই যুগসঞ্চিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে উপেক্ষা করে আফগান যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সামরিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কাটাছেঁড়া তাই চলতেই থাকবে।
এমনিতেই আজকের আফগানিস্তান ‘লেট নিয়োলিবারালিজ়ম’-এর ধ্বংসস্তূপ। যুদ্ধ-ক্লান্ত, আইনের শাসনহীন— ভয়াবহ অবিশ্বাস, নিরাপত্তাহীনতার পরিমণ্ডল। কতটা ভয়ানক হতে চলেছে আফগানিস্তানের আসন্ন পরিস্থিতি, আগামী দিনগুলিতে বিশৃঙ্খলতা সমাজের কতটা শিকড়ে ঢুকবে, তা ভাবাও কঠিন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তও কিন্তু বড্ড চেনা ঠেকে ডন নিকোলাসের। এতে যেন প্রতিফলিত হয়েছে ১৯৭৩-এ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটাই। দু’ক্ষেত্রেই আমেরিকা যে কিছুই ‘অর্জন’ করতে পারেনি। ১৯৭৩-এর ২৯ মার্চ শেষ আমেরিকান বাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছেড়ে যাওয়ার আগেই লঙ্ঘিত হয়েছিল যুদ্ধবিরতি। পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭৪ সালের গোড়ার দিকে, যাতে মৃত্যু হয় ৮০,০০০ মানুষের।
অবশ্য সংখ্যার পরও একটা কথা আছে। হত্যার সংখ্যায় যদি নাও হয়, শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে এক ভয়ানক মধ্যযুগীয় সামাজিক পরিস্থিতি তৈরির নিরিখে তালিবানি শাসন ১৯৭৫-এর কাম্বোডিয়ার থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা