খেলা, ভাঙার খেলা
West Bengal Assembly Election 2021

অজানা, অদেখা অনেক কিছুই এই বারের ভোটের প্রাপ্তি

ভোট বিধানসভার হলেও লড়াই এ বার ঘোষিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২১ ০৪:৪১
Share:

আত্মঘাতী: বিজেপির প্রার্থী-তালিকা প্রকাশের পর দলের অফিসের সামনে দলীয় কর্মীদের বিক্ষোভ, কলকাতা, ১৫ মার্চ। পিটিআই।

কাল রাত পোহালেই ভোট শুরু। ভোটের এমন বিস্তার বাংলা আগে কখনও দেখেনি। শুধু আট পর্বে ভোট বলেই নয়, এ বার এমন অনেক কিছু ঘটছে, যা এই রাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনী অভিজ্ঞতাগুলির সঙ্গে মেলে না। বরং কিছুটা অভূতপূর্ব বলা যায়। ফলে এই বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ সবই কিছুটা অন্য রকম।

Advertisement

দশ বছর ক্ষমতাসীন একটি দলের উপর প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার (অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি) চাপ থাকা স্বাভাবিক। বিরোধীদের দিক থেকে সেই চ্যালেঞ্জ শাসক দলকে নিতে হয়। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি আঠারোটি আসন জেতার পরেই রাজ্যে পালাবদলের সম্ভাবনা নিয়ে চর্চাও শুরু হয়। কিন্তু এ বার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এমন আরও কিছু বিষয়, যা এর আগে বাংলার ভোটারেরা দেখেননি। ভোটের বোধন-লগ্নে সেগুলি এক বার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

দেখা যাচ্ছে, ভোট বিধানসভার হলেও লড়াই এ বার ঘোষিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর। আর সেখানে বিজেপির প্রধান কুশলী দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং। তাঁদের দলের রাজ্য নেতৃত্ব কার্যত ঠুঁটো! দেশের দুই শীর্ষ পদাধিকারী যে ভাবে বাংলায় ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করছেন, তাতে এটাও স্পষ্ট যে, তাঁরা ‘সর্বশক্তি’ প্রয়োগে অকৃপণ। কোনও ভোটে কোনও প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এখানে এই ভূমিকায় পাওয়া যায়নি। ‘খেলা’ তাই জমজমাট।

Advertisement

নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন নজিরবিহীন পদক্ষেপ তো আছেই, ঘটনাচক্রে ভোটের ঠিক আগে সিবিআই-ইডি’র তৎপর হয়ে ওঠার মতো কিছু উপসর্গও পর পর সামনে এসে পড়েছে। যার ধাক্কা পৌঁছে গিয়েছে রাজ্যের প্রশাসন থেকে শুরু করে শাসক দলের অন্দরমহল পর্যন্ত। তবে কথায় আছে, প্রেমে এবং রণে ‘বেঠিক’ বলে কিছু নেই।

মুদ্রার অপর দিকে রাজ্যবাসী এ বার প্রথম দেখবেন এক পেশাদার ভোট কুশলীকে। তা-ও আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে! এই নির্বাচন সেই কুশলীরও অগ্নিপরীক্ষা। কারণ, তিনি তৃণমূলকে ফেরানোর চ্যালেঞ্জ ঠুকে বলেছেন, বিজেপি একশো আসনের নীচে না থাকলে তিনি পেশা ছেড়ে দেবেন। এক জন পেশাদারের এই চ্যালেঞ্জ আগ্রহ বাড়ায়।

অন্য দিকে এটাও দেখা যাচ্ছে, বিজেপির মতো একটি ‘রেজিমেন্টেড’ দলের ভিতরের কাঠামো আসলে কত নড়বড়ে। বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে আঠারো আনা ঝাঁপিয়ে পড়া দলটি এখনও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অবস্থাতেই পৌঁছয়নি। তাই দল ভাঙিয়ে লোক জোগাড় তাদের কাছে অন্যতম বিকল্প। আর তাতেই তাদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা শিকেয়। চাওয়া-পাওয়ার দলীয় দ্বন্দ্ব নেমে এসেছে রাস্তায়। এ বার ভোটে এ-ও এক নয়া উপাদান।

মনে পড়ে, বামফ্রন্ট আমলে কংগ্রেসের প্রার্থী-তালিকা বেরোনোর সময় জ্যোতি বসু প্রায়ই কটাক্ষ করে বলতেন, “ওদের (কংগ্রেস) কী সব লিস্ট বেরোচ্ছে শুনছি। আমাকে আবার পুলিশ পাঠাতে হবে!” সত্যিই পুলিশ যেত। কারণ, আইনশৃঙ্খলা প্রায়ই নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকত না।

এমনও দেখেছি, নিজাম প্যালেসের ঘরে সোফার উপর গুটিসুটি মেরে ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছেন পঞ্জাবের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা দরবারা সিংহ। দল সে-বার তাঁকে এখানে পর্যবেক্ষক করে পাঠিয়েছিল। দেখেছি, জনৈক কংগ্রেস প্রার্থী দিল্লি থেকে এসে দমদম বিমানবন্দরে নামা মাত্র এমন ‘অভ্যর্থনা’ পেলেন যে, গাড়ির সিটে ঢাকা তোয়ালে জড়িয়ে তাঁকে লজ্জা নিবারণ করতে হল।

কোনও বিশৃঙ্খলাই সমর্থনযোগ্য নয়, তা সে যে-ই করুক। তবে অনেকেই মনে করেন, সাংগঠনিক বিধিবদ্ধতা বা দলীয় শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কংগ্রেস বা তাদের ঘরানার কোনও দল ঠিক কমিউনিস্ট অথবা বিজেপির মতো ‘রেজিমেন্টেড’ নয়। সিপিএম, বিজেপি উভয়েই দলীয় গঠনতন্ত্র অনুসারে কঠোর শৃঙ্খলার শিকলে বাঁধা। অন্তত সেটাই থাকার কথা। সে দিক থেকে কংগ্রেস এবং তৃণমূলকে ঠিক ওই পঙ্‌ক্তিতে ফেলা যায় না। তাদের সাংগঠনিক শৃঙ্খল তুলনায় শিথিল বলতে হবে।

এটা ভাল বা মন্দ, ঠিক বা ভুল, উচিত বা অনুচিত— সে সব আলোচনাসাপেক্ষ। তবে এ কথা বলব, মানুষ স্রোতের মতো কংগ্রেসে এসে মিশেছে বলেই আবেগ তার একটি বড় জীবনীশক্তি। এখন এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাতেও যার কিঞ্চিৎ অবশিষ্ট আছে। বেশিটাই গিয়েছে তৃণমূলে। ফলে এখনকার তৃণমূলকেও এই ভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কারণ তারও ডিএনএ-তে কংগ্রেস।

কিন্তু সঙ্ঘের অনুশাসনে ঋদ্ধ বিজেপির কাছে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা তো বুনিয়াদি শিক্ষা। অথচ প্রার্থী-তালিকা ঘিরে তার যে মুখচ্ছবি ফুটে উঠেছে, সেটা অন্য যে কোনও প্ল্যাটফর্ম মার্কা আবেগতাড়িত দলের থেকে আলাদা কিছু নয়। কলকাতায় বিজেপির দফতরে প্রায় নিত্য অশান্তি, জেলায় জেলায় মারামারি, পার্টি অফিসে ভাঙচুর, আগুন, পথ-অবরোধ সব মিলিয়ে যেন ‘ফুল প্যাকেজ’! গড়ার আগেই ‘ভাঙার’ খেলা।

আরও বড় কথা, প্রার্থী-বিরোধী এই সব বিক্ষোভের লাগাম বহু ক্ষেত্রেই রয়েছে দলের জেলাস্তরের পদাধিকারীদের হাতে। অর্থাৎ, যাঁরা শৃঙ্খলা মেনে কোনও না কোনও দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁরাই এখন কোমর বেঁধে প্রকাশ্যে নেমে পড়েছেন উচ্চতর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।

এই পরিস্থিতি যে আসতে পারে, তার ইঙ্গিত অবশ্য মিলছিল কিছু দিন ধরে। পদ্ম-দলে আদি ও নব্য দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দেওয়ার অনিবার্যতা নিয়ে চর্চাও হয়েছে বিস্তর। শুধু বোঝা যায়নি, তার মাত্রা কত দূর গড়াতে পারে। অবশেষে জানা গেল, ‘শৃঙ্খলা’ এ বার শৃঙ্খলমুক্ত হচ্ছে।

রাজ্যে ভোটের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢুকে গিয়েছে আগেই। হিসেব কষে সুকৌশলে তা করা হয়েছে। কেন এবং কী ভাবে, সেই সব তর্ক অন্তহীন। তবে ‘তোষণের রাজনীতি’ এবং ‘উগ্র হিন্দুয়ানি’, কেউই এর দায় এড়াতে পারে না। এই বিষ বড় দ্রুত ছড়াতে চায়! বাম-কংগ্রেসের জোটে আব্বাস সিদ্দিকির অনুপ্রবেশ এ বারের ভোটে অঙ্ক মেলানোর ক্ষেত্রে আরও একটি নতুন সংযোজন হবে কি না, সেটাও দেখার।

বাঙালি-অবাঙালি প্রসঙ্গ অবশ্য ভোটের ময়দানে আগে কখনও আসেনি। এ বার শুধু এসেছে নয়, জাঁকিয়ে বসেছে। কে ‘বহিরাগত’, কোন দলের ডিএনএ-তে ‘বাঙালি’ আছে, সেই ভোট-বিবাদে এ বার কি প্রাদেশিকতাও ছায়া ফেলবে?

পরিশেষে আট দফা ভোটের প্রসঙ্গ। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ-বিতর্ক-রাজনীতি অনেক হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এতগুলি দফার দরকার ছিল কি না, সে আলোচনাও অযৌক্তিক বলব না। কিন্তু, যে বিষয়টি প্রধানত ভাবায় তা হল, পশ্চিমবঙ্গে ভোট শান্তিপূর্ণ হয় না কেন? কয়েক দশকের ধারাবাহিকতায় অশান্তি, সংঘর্ষ, রক্তপাত যেন বাংলার ভোটের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। মসনদে পালাবদল হলেও এই মূল ছবি বদলায়নি।

বাহাত্তরের ভোটে রিগিং, বুথ দখল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য মাত্রা পায়। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রিগিং করে ক্ষমতা দখলের অভিযোগ বামেরা আজও তোলে। যদিও বাম-বঙ্গে ভোটে জুলুম, অশান্তি, মারামারি, খুনোখুনি আরও তীব্র আকার নিয়েছিল। দুর্ভাগ্য, রাজ্য সেই আবর্ত থেকে বেরোতে পারেনি।

ষাটের দশকেও মা-ঠাকুমারা ঘটা করে ভোট দিতে যেতেন। বাড়ির কচিকাঁচারা সঙ্গে যেত। রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে থাকত একটা হালকা ছুটির আমেজ। ক্রমশ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা সেখানে জায়গা করে নিল। কিন্তু একহাতে তালি বাজে না। প্রতিটি রাজনৈতিক দল এর জন্য সমান দায়ী। আইনশৃঙ্খলার যুক্তিতে বাংলায় ভোটের দফা যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তা নিয়ে রাজনীতি করার, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ির ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার তাদের নিশ্চয় আছে। তবে রাজ্যের ভাবমূর্তির স্বার্থে কাদা মোছা বেশি জরুরি।

প্রথম দফা ভোটের আগে এটাই হোক সম্মিলিত শপথ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement