বিজয়োল্লাস: লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তৃণমূল সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। ৪ জুন। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
কেন্দ্রে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না-পাওয়া দুর্বল বিজেপি। রাজ্যে একক ভাবে শক্তিশালী তৃণমূল। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পরে এই লোকসভা ভোটেও কংগ্রেস-সিপিএম কার্যত ভ্যানিশ! আর রাজ্যের একমাত্র দৃশ্যমান বিরোধী বিজেপি হারের গুঁতো খেয়ে হতোদ্যম। বাংলার নিরিখে এটাই নির্বাচনী ফলের সারাৎসার।
প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে এর চেয়ে উত্তম পরিস্থিতি আর কী হতে পারে! এক জন অভিজ্ঞ এবং কুশলী রাজনীতিক জানেন, প্রয়োজনীয় কাজ ‘করিয়ে’ নেওয়ার থাকলে এটা তারও ‘সুসময়’। বাংলায় বিপুল জয়ের সুবাদে জাতীয় রাজনীতিতেও মমতার ‘মূল্য’ এখন অনেকটা বেড়ে গেল। রাজ্যে এ বার শাসক তৃণমূলকে প্রবল অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। দু’দফা সরকার চালিয়ে আসার পরে এই প্রথম এ রকম একটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে করতে হল। তার পরেও রাজ্যে তাঁর দলের আধিপত্য তিনি বজায় রাখলেন। এ বার দিল্লির ‘অঙ্ক’ কষতে হবে তাঁকে।
লোকে বলছে, এই জয় মমতার ‘ম্যাজিক’ এবং অভিষেকের সাংগঠনিক দক্ষতার সম্মিলিত ফসল। হিসাবমতো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হতে দু’বছর। তৃণমূল শিবিরের খবর, কালক্ষেপ না করে এই ‘অনুকূল’ হাওয়াতেই বিধানসভা নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি কিছুটা এগিয়ে নিতে চান দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই ভারটিও থাকবে মূলত অভিষেকের উপর।
এরই মধ্যে বিভ্রান্ত রাজ্য বিজেপি-তে বদলের আওয়াজ উঠেছে। গোটা দেশে দল যে ভাবে ধাক্কা খেয়েছে, সেই দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়তো ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে পর্যুদস্ত হওয়ার পর থেকে এই রাজ্যকে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা যে ভাবে বিশেষ নিশানা করে তুলেছিলেন, তাতেই লোকসভায় বাংলার নির্বাচনী ফল বাড়তি মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। অনেকের ধারণা, আরও এক বার এই ভাবে হেরে যাওয়ার কোপ এ বার রাজ্য বিজেপির উপর পড়বে।
বস্তুত ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে দু’শো আসনের আওয়াজ তুলে বিজেপি যতটা পর্যুদস্ত হয়েছিল, এ বার লোকসভার ফল মোটামুটি সেই রকমই। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাদের অভিযান, আদালতের সক্রিয়তা, রাজভবনের রাজনীতি, নেতাদের লম্বা-চওড়া আস্ফালন কিছুতেই কিছু হয়নি! অবশেষে সাংগঠনিক রদবদলের কথা শোনা যাচ্ছে এ বার। সে ক্ষেত্রে নতুন মুখ আসতে পারে। আবার কারও কারও ক্ষমতা কাটছাঁটও হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ফল বেরোনোর পরেই সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রের উদ্দেশে তৃণমূল নেত্রী জানিয়ে দেন, “সিবিআই-ইডি ইত্যাদি এজেন্সি দিয়ে ভয় দেখানো এ বার বন্ধ হোক।” বিজেপি বিপুল গরিষ্ঠতায় ফিরে এলে বিরোধী রাজ্যগুলিকে আরও বেশি ‘হেনস্থা’ করা হতে পারে, এমন একটি আশঙ্কা রাজনৈতিক মহলে ছিল। রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে মমতার বক্তব্যটি তাই এই সময়ে খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
দেশের অধিকাংশ বুথ-সমীক্ষায় বিজেপির নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা এবং এনডিএ-র অনায়াসে তিনশো পেরোনোর বিবিধ সম্ভাবনা নস্যাৎ করে মমতা দাবি করেছিলেন, “এ সব ভুয়ো। বিশ্বাস করি না।” বলেছিলেন, তিনি নিজের ‘ক্যালকুলেশন’ করবেন প্রকৃত ফল দেখার পরে। এখন সেই সময়। এর আগেই তিনি মন্তব্য করেছেন, “এখানে বেশি আসন জিততে পারলে দিল্লিতে আমাদের দর বাড়বে।” ভবিতব্য তাঁকে সেই দিকেই টানছে। তিনি, বলা চলে, নানা রকম আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন। কে বলতে পারে, জানা-অজানা অনেক সমীকরণের ‘সহজ’ সূত্র হয়তো থাকতে পারে তাঁর ঝোলায়!
সবাই জানি, পাঁচ বছর আগের লোকসভা ভোটে বিজেপির ১৮ আসনে জয়ের অগ্রগতি মমতা আগে সে ভাবে আঁচ করতে পারেননি। তার পিছনে কী কী কারণ ছিল, সে সব এই মুহূর্তে খুব প্রাসঙ্গিক নয়। যেটা উল্লেখ করার তা হল, ওই ভোটের পর থেকে তৃণমূলে ভাঙন শুরু হয়। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে যার সম্ভাব্য পরিণাম হতে পারত তৃণমূলের ভরাডুবি। কিন্তু ভোটকুশলী এনে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করে তৃণমূলকে একক শক্তিতে বড় জয় এনে দিতে সে দিন অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিষয়টি ফের মনে করানোর কারণ এটা বোঝানো যে, ওই ভোটে তৃণমূলের সামনে সাংগঠনিক ভাঙনই ছিল প্রধান সমস্যা। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরাও ধরে নিয়েছিলেন, দল ভাঙানোর রাজনীতি তাঁদের বাংলা দখলের পথ প্রশস্ত করে দেবে। সেই আশায় ছাই পড়েছিল।
এই বারের ভোটে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সির সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে একাধিক শাসক নেতা-মন্ত্রী-সরকারি আধিকারিকের বিরুদ্ধে বিপুল টাকার আর্থিক দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ। তারই অনুষঙ্গে এসেছে সিবিআই, ইডি-র অভিযান, আদালতের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি। যার সবই ঘটছে গত দু’-আড়াই বছর ধরে। অর্থাৎ, ঠিক ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের পর থেকে। এ সব দেখতে দেখতে জনমন আলোড়িত হওয়া স্বাভাবিক। জনমনে কিছু ধারণা দানা
বাঁধতে থাকে। যেগুলি থেকে স্থিতাবস্থা-বিরোধিতা তৈরি হয়।
সব মিলিয়ে তাই এ বারের লোকসভা নির্বাচনটি তৃণমূলের কাছে ছিল প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমর্থন আদায়ের কঠিন পরীক্ষা। একা লড়েই তারা বিজেপি-কে সুচারু পরিকল্পনায় ফের কোণঠাসা করে নিজেদের রাজনৈতিক দখল কায়েম রাখতে পারল। মানুষের, বিশেষ করে মহিলাদের, সামনে ছিল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। এ বারের ভোটে তৃণমূলের সাফল্যের পিছনে যার ‘অবদান’ পর্যবেক্ষকরা মানছেন। মমতার পাশে অভিষেক এ বার আরও সংগঠিত।
পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে বাংলা থেকে তৃণমূলের প্রাপ্ত আসন-সংখ্যা এখন ‘ইন্ডিয়া’ জোটে মহার্ঘ। ২৯ আসন নিয়ে সংসদে তৃণমূল সম্ভবত চতুর্থ বৃহত্তম দল হতে চলেছে। তবে ‘ইন্ডিয়া’ জোট সংসদে বিরোধী শক্তি হিসাবে থাকবে, না কি চন্দ্রবাবু নায়ডু, নীতীশ কুমার-দের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ করে ক্ষমতায় বসার রাস্তা খুঁজবে, তার উপর মমতার পরবর্তী পদক্ষেপ অনেকখানি নির্ভর করবে বলে মনে হয়।
বিরোধী জোট গঠনের সূচনা থেকেই মমতা আঞ্চলিক দলগুলির প্রাধান্য বৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে আসছেন। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মধ্যেও তিনি বিভিন্ন রাজ্যের নেতৃবৃন্দ, যেমন, অখিলেশ যাদব, স্ট্যালিন, শরদ পওয়ার, তেজস্বী যাদব, জেলে আটক অরবিন্দ কেজরীওয়ালের স্ত্রী, হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী প্রমুখের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন। এঁদের সবার সম্মিলিত আসন ধরলে তা সংখ্যা শতাধিক হয়ে যায়।
এখন কংগ্রেস যদি উদ্যোগী হয়ে চন্দ্রবাবু, নীতীশদের মতো কারও কারও সঙ্গে কথা বলে অন্য কিছু ভাবতে চায়, তৃণমূল নেত্রীও তখন অখিলেশ, স্ট্যালিন, শরদদের সঙ্গে নিয়ে নিজের কোনও ‘ক্যালকুলেশন’ করার চেষ্টা করবেন না, এমন কথা কি হলফ করে বলা যায়? যদিও মমতা প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোটে আরও দল আসুক। সবাই স্বাগত। তবে কৌশলগত কারণে তাঁর অবস্থান কখন কী হবে, সেটা এ ভাবে অনুমান করা কঠিন।
যদিও এখন পর্যন্ত যা খবর, টানাটানি করে সরকার গড়ার চেয়ে বিরোধী আসনে বসে সরকারকে ‘চাপ’-এ রাখা শ্রেয় বলে মনে করেন ‘ইন্ডিয়া’র কয়েক জন শরিক। এ প্রসঙ্গে সরাসরি কিছু না বললেও মমতার মতে, সংসদে দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা না থাকায় নতুন এনডিএ সরকার ‘ইচ্ছেমতো’ যে কোনও আইন পাশ করাতে পারবে না। সেখানে বিরোধী-জোট ঐক্যবদ্ধ ভাবে অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এর পরেও প্রশ্ন, ‘ইন্ডিয়া’ আদৌ সরকার গড়লে তৃণমূল কি তাতে শামিল হবে? অনুমান, ‘অঙ্ক’ যদি মেলে মমতা তাঁর দলকে সরকারে পাঠাতে অরাজি হবেন না। আর এটাও বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে মোদী-শাহর সঙ্গে মমতার কোনও রকম রাজনৈতিক সখ্যের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।