ব্যবধান: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কি তবে পৌঁছে গেল এমন একটি স্তরে, যেখানে দুর্নীতি সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে? বছরের গোড়ায় রাজ্য তোলপাড় হয়েছিল সন্দেশখালি নিয়ে। অথচ, লোকসভা ভোটের ফলে তার কোনও প্রভাব পড়ল না— এমনকি, সন্দেশখালি যে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেই বসিরহাটে ২০১৯ সালের তুলনায় তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান কার্যত অপরিবর্তিত থাকল। এর পাশাপাশি চলল এসএসসি-র অনশন; রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূলের বাহুবলীদের ভয়ঙ্কর অত্যাচারের খবর উঠে এল সংবাদ শিরোনামে। অগস্ট মাস থেকে আর জি কর-কাণ্ডে কলকাতায় রীতিমতো ‘জনজাগরণ’ হল— অন্তত শহুরে শিক্ষিত নেটনাগরিকরা বললেন, ‘এত বিদ্রোহ কখনও দেখেনি কেউ’— এবং, তার পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত দশটি বিধানসভা উপনির্বাচনের দশটিতেই জয়ী হল তৃণমূল কংগ্রেস।
রেশন দুর্নীতিতে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁদের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে শাসক দলের বাহুবলীদের হাতে অত্যাচারিত মানুষের সামাজিক ওভারল্যাপ থাকতে পারে; অথবা এসএসসি-র চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে আর জি করের ঘটনায় ক্ষুব্ধ উদ্বিগ্ন নাগরিকদের— কিন্তু, প্রতিটি জনগোষ্ঠী কোনও না কোনও অর্থে স্বতন্ত্র। গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র, সামাজিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন অথবা কোনও মতে দিন গুজরান করতে পারলেই চলে, হরেক অক্ষে এই জনগোষ্ঠীগুলিকে ভাগ করা যায়। তাৎপর্যপূর্ণ কথা হল, কোনও আর্থ-সামাজিক পরিসরে তৈরি হওয়া দুর্নীতির আঁচই শেষ অবধি ব্যালট বাক্সে পড়েনি। নিতান্ত শহুরে মধ্যবিত্তদের আন্দোলন বলেই আর জি কর-বিক্ষোভ রাজ্যের বৃহত্তর রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারল না বলে যদি ধরে নিই, তা হলে প্রশ্ন করতেই হবে যে, অন্য বিক্ষোভগুলিও ব্যর্থ হল কেন?
তার একটা কারণ ইতিমধ্যেই বহু-আলোচিত— রাজ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ সরকারি নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের সুবিধাভোগী। সেই সুবিধা শাসক দলের জন্য তৈরি করে দিয়েছে এক ধরনের বর্ম— এক গোষ্ঠীর ক্ষোভ অন্য গোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারছে না তেমন। মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশ এমন সরকারি সুবিধা পান না, ফলে তাঁদের ক্ষোভ অনেক বেশি প্রকট এবং দুর্দম। কিন্তু, তাঁরা সংখ্যায় সীমিত, ফলে তাঁদের ক্ষোভ যতই তীব্র হোক, ভোটের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব তুলনায় কম। সাম্প্রতিক একটি লেখায় আরও একটি কারণ আলোচনা করেছিলাম (‘দল নয়, সরকার’, ২৬-১১), যাতে স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ শাসক দলের অত্যাচার এবং সরকারের কল্যাণনীতিকে আলাদা করে দেখছেন। এবং, দল যা-ই করুক না কেন, সরকারের ভূমিকা মোটের উপরে দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতোই। বছরব্যাপী বিভিন্ন বিক্ষোভ ও অসন্তোষের মধ্যে যে কথাটা চোখ এড়িয়ে যেতে পারে, তা হল, কোনও ক্ষেত্রেই কিন্তু সরকার বা প্রশাসন কঠোর হয়নি। পুলিশ ধারাবাহিক ভাবে সংযত থেকেছে। আর জি করের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বারংবার আলোচনায় বসেছেন। উল্টো দিক থেকে প্রতিরোধ তৈরি হলে তবেই ক্ষোভের গতি বাড়ে। এই এক বছরে পশ্চিমবঙ্গের সরকার ও প্রশাসন সেই প্রতিরোধ তৈরি করেনি, সচেতন ভাবেই। অগস্টের শেষে বিজেপির নবান্ন অভিযানের কথা মনে করা যেতে পারে— শত প্ররোচনাতেও পুলিশ যতখানি সংযত ছিল, তা খুব ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা ছাড়া হতে পারে না।
শাসক দল মানুষের অসন্তোষকে ধামাচাপা দিতে চাইলেই অবশ্য তা চাপা পড়ে না। পশ্চিমবঙ্গে পড়েছে, তার কারণ বিরোধী দলগুলোর ব্যর্থতা। বামপন্থীরা আপাতত সোশ্যাল মিডিয়াসর্বস্ব, ফলে তাঁরা শেষ অবধি বড় মাপের জন-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন, এমন আশা এমনিতেই ছিল না— তাঁরা হতাশও করেননি। অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বিজেপির ভূমিকা। নিতান্ত হাওয়া থেকে রাজনৈতিক বিরোধের প্রশ্ন করে আনার, এবং তাকে কেন্দ্র করে বিপুল বিক্ষোভ কর্মসূচি গড়ে তোলার প্রতিভা যে এই দলটির রয়েছে, প্রাক্-২০১৪ পর্বে গোটা দেশ তা দেখেছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষোভের প্রকৃত কারণ থাকা সত্ত্বেও তাকে রাজনৈতিক মূলধনে পরিণত করতে বিজেপি এখনও অবধি ব্যর্থ কেন? তার একটি কারণ হতে পারে এ রাজ্যে দলের নেতাদের রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির অভাব। অন্য কারণ এটাও হতে পারে যে, মূলত বহিরাগতদের দল, তাই বিজেপি এখনও এই রাজ্যের তৃণমূল স্তরের রাজনীতির চলন ধরতে পারেনি। তবে, সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত এই যে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পৌঁছে গিয়েছে সেই স্তরে, যেখান থেকে সমর্থকসংখ্যা বাড়াতে গেলে রাজনীতির ধাঁচ পাল্টাতে হবে।
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির অস্ত্র দ্বিমুখী— প্রথমটি হল তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধতা; দ্বিতীয়টি, হিন্দুত্ববাদ। দুর্নীতির বিরোধিতার অস্ত্রটি যে খুব কার্যকর নয়, এত দিনে তা স্পষ্ট। হিন্দুত্ববাদের অস্ত্রটি তুলনায় ধারালো। ২০২৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের বিশ্লেষণ করলে অনুমান করা যায়, শহরাঞ্চলে— যেখানে প্রত্যক্ষ সরকারি সুবিধাভোগীর সংখ্যা তুলনায় কম— বিজেপির সমর্থনভিত্তি তুলনায় ভাল; এবং গ্রামাঞ্চলে হিন্দু পুরুষদের মধ্যে বিজেপি ভোটার সম্ভবত তার সর্বোচ্চ স্বাভাবিক সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। অন্য দিকে, অন্তত ৩০ শতাংশ মুসলমান ভোট আছে, এমন লোকসভা কেন্দ্রগুলির ফলাফল দেখলে স্পষ্ট, রাজ্যের মুসলমান জনসংখ্যার একটা বড় অংশ দল হিসাবেই বেছে নিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। পর-পর বেশ কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল দেখলে অনুমান করা যায় যে, বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি যত জোরালো হয়েছে, মুসলমান ভোটও ততই ঘুরেছে তৃণমূলের দিকে। যে রাজ্যে ২৭ শতাংশ মানুষ মুসলমান, এই হিসাবটি সেখানে অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
মাস দুয়েক আগে অবধি নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যেত যে, হিন্দুত্ববাদ দিয়ে এ রাজ্যে যত দূর যাওয়া সম্ভব ছিল, বিজেপি গিয়েছে। এর পরে ভোট টানতে গেলে অন্য কথা বলতে হবে— সরকার নাগরিকের জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে কতটুকু করবে, সে কথা। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পের কথা। মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি সে কথা বলেছে— তার ফলও পেয়েছে— কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে তো সেই খেলায় অনেক দূর এগিয়ে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বিজেপির মতো দলও যেখানে অন্তত লক্ষ্মীর ভান্ডারের নির্বাচনী গুরুত্বের কথা বুঝেছে, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা সম্ভবত সেটুকুও বোঝেননি— তাঁরা এখনও একে ‘ভিক্ষা’ বলছেন, এবং জনসমর্থন হারাচ্ছেন। তাঁদের কথা থাক। এ বারের নির্বাচনের প্রচারপর্বেও বিজেপির নেতারা চোরাগোপ্তা বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে তাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডারের বরাদ্দ তিন গুণ করে দেবেন। কিন্তু, যে কথা কোনও দল প্রকাশ্যে বলতে ভয় পায়, সে কথায় মানুষ সচরাচর বিশ্বাস করে না।
কিন্তু, এই উভয়সঙ্কট দু’মাস আগের কথা। পড়ে-পাওয়া আঠারো আনার মতো বিজেপির সামনে নতুন দরজা খুলে দিয়েছে বাংলাদেশ। সে দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে অত্যাচার যত বেড়েছে, এ পারে ততই বেড়েছে হিন্দু সংহতির রাজনীতি। কলকাতা শহরেই হয়ে গিয়েছে একাধিক মিছিল। সে রাজনীতির সুর আরও চড়বে, ধরেই নেওয়া যায়। তাতে দুটো ঘটনা ঘটছে— এক, বাংলাদেশের অছিলায় উস্কে দেওয়া যাচ্ছে এ পার বাংলার সাম্প্রদায়িকতা, সব পরিসংখ্যানকে অস্বীকার করে জাগিয়ে তোলা যাচ্ছে এ দিকেও মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠে অত্যাচারী হয়ে ওঠার অলীক আশঙ্কা; এবং দুই, আগে যাঁরা এই ধরনের কথাবার্তা এড়িয়ে চলতেন, এমনকি আপত্তি করতেন, তাঁদেরও অনেকেই ‘উদ্বিগ্ন’ হয়ে উঠছেন হিন্দুদের ‘পরিণতি’র কথা ভেবে। অর্থাৎ, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যেখানে ঠেকে গিয়েছিল, তার পরের ধাপে যাওয়ার পথটি খুলে দিচ্ছে বাংলাদেশ।
২০২৫ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের সামনে প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হতে পারত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এই নতুন ধাপটি। আশঙ্কা হচ্ছে, শাসক দলের সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দলের ক্ষমতাকেন্দ্রের দখল কার হাতে থাকবে, সেই লড়াইয়ের কিছু গোলাবারুদের নমুনা এ বছরই মিলেছে। ২০২৫-এ লড়াই তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এবং, সেই দ্বন্দ্ব কেবলমাত্র শীর্ষ স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হয় না। বিধানসভা নির্বাচনের আগে গোটা বছর বলতে শুধু সামনের বছরটুকুই। ঘর গোছানো এবং ঘর ভাঙা, দুই খেলাই চলবে সমান তালে। সব ময়দানেই।