প্রতীকী ছবি।
বহু বছর আগে তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী নিজের সুন্দরবন সফরের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। স্থানীয় মানুষের কাছে জঙ্গল, বাস্তুতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করতেই উঠেছিল সমবেত দাবি— “আমরা বাঘ চাই না, ভাত চাই।”
সরকারি হিসেব বলছে, গত বছরগুলিতে দেশে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। অন্য দিকে, জঙ্গলের উপর ক্রমাগত বেড়েছে জীবন-জীবিকার দাবি। কৃষিকাজ ও পরিকাঠামোর প্রয়োজনে জঙ্গল কমছে, উপরন্তু সুন্দরবনের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা। তাই এক দিকে জঙ্গল কমে আসা এবং পাশাপাশি বাঘের সংখ্যা বাড়ার ফলে বাড়ছে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সংঘর্ষ। নামে সংঘর্ষ হলেও আসলে তা অস্তিত্বরক্ষার জন্য কোণঠাসা বাঘের পরিযায়ীবৃত্তি। এক জায়গায় খাবারের টান পড়লে পেটের টানে অন্যত্র যাওয়া। ঠিক যে ভাবে মানুষ গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দেয় শহরে, ভিন্রাজ্যে, ভিন্দেশে। সেই ভিন্দেশই হল গৃহস্থের গোয়াল। যেখানে সে গরু-বাছুরের লোভে হানা দেয়। সুন্দরবনের জঙ্গলে কাঠুরে বা মউলিরা সাধারণত আক্রান্ত হন বাঘের এলাকায় অনুপ্রেবেশের চেষ্টায়। বাঘের ‘মানুষখেকো’ হওয়ার মিথ রটে, কিন্তু তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থাকে না। আড়ালে চলে যায় জঙ্গলের সামগ্রিক স্বাস্থ্যহানির বৃহত্তর প্রসঙ্গটি।
এই অবস্থার প্রতিবিধানের ইঙ্গিত আছে আমাদের লোকসংস্কৃতির পরিসরে। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সে কাহিনি ‘বনবিবির জহুরানামা’ নামে পরিবেশিত। পির ও সুফিদের প্রভাবে এই কাহিনির আবির্ভাব বলে ধারণা। লিখিত আকারে উনিশ শতকের শেষের দিকে পাওয়া যায় এবং স্থানীয় ভাবে নানা সংস্করণের প্রচলন শুরু হয়। পালার প্রথম অংশে বনবিবি ও তাঁর ভাই শাহ জংলির জন্ম ও বড় হয়ে ওঠার গল্প। দ্বিতীয় ভাগে দক্ষিণ রায়ের মা নারায়ণীর সঙ্গে বনবিবির লড়াইয়ের কথা। যুদ্ধে বনবিবি জয়ী হলে নারায়ণী সম্পূর্ণ বাদাবনের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে রাজি হন। কিন্তু বনবিবি নারায়ণীর সঙ্গে সই পাতিয়ে এক সঙ্গে রাজ্য শাসন করতে থাকেন।
কাহিনির তৃতীয় ভাগ দুখে যাত্রা। দুখে পিতৃহীন গরিব ছেলে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় গ্রামের ধনা মউলি ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে জঙ্গলে যায়। দক্ষিণ রায় মউলিদের বলেন তাঁর কাছে দুখেকে বলি দিলে প্রচুর পরিমাণ মধুর সন্ধান দেবেন। অন্যথায় তাঁদের সর্বনাশ হবে। ধনা রাজি হয়ে যান। ছলনা করে দুখেকে জঙ্গলে ফেলে তাঁরা নৌকা ছেড়ে দেন। দক্ষিণ রায় বাঘ রূপে তাকে মারতে গেলে দুখে বনবিবির কাছে প্রার্থনা জানায়। বনবিবি এবং শাহ জংলি এসে দক্ষিণ রায়কে হারিয়ে দুখেকে বাঁচান। দক্ষিণ রায় বড় খাঁ গাজির কাছে আশ্রয় নেয়। বড় গাজির মধ্যস্থতায় দক্ষিণ রায় ও বনবিবির মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। দুখে দক্ষিণ রায়ের কাছ থেকে সাত ঘড়া মোহর পেয়ে মায়ের কাছে ফেরে। শুরু করে বনবিবির মাহাত্ম্য প্রচার।
নারায়ণীর জং এবং দুখের যাত্রা— দু’টি পর্বেই সহাবস্থানের বার্তাটি খুঁজে পাই। নারায়ণী দক্ষিণ রায় এবং বনবিবি শাহ জংলি— দু’পক্ষই অপর পক্ষের অস্তিত্বকে মেনে নেন। কাঠুরে বা মউলিরা বনবিবির ভরসায় দক্ষিণ রায়ের ডেরায় নিজেদের সুরক্ষিত মনে করেন, দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে জঙ্গলে ঢোকেন।
সহাবস্থান ও সমানুভূতির এই মূল শিক্ষা ভোলার ফলেই মানুষ বার বার পরিস্থিতির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে, বাঘ জঙ্গলের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের সূচক। বাঘ না থাকা মানে জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল জীবিকাগুলিরও ঘোর অনিশ্চয়তা। জঙ্গলের উপর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নির্ভরশীলতা কমাতে সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পগুলিকে স্থায়ী ও স্বনির্ভর করতে হবে। না হলে মানুষের কাছে জঙ্গুলে জীবিকাগুলির গুরুত্ব কমবে না। তা ছাড়াও, দেশের বনভূমিগুলি গুরুত্বপূর্ণ সব নদীর উৎস ও নদীর প্রবাহপথের স্বাস্থ্যরক্ষায় অত্যন্ত জরুরি। বন না থাকলে নদীগুলি বাঁচবে না। টান পড়বে জলের জোগানে। বাড়বে হাহাকার। সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির থেকে আমাদের বিমা স্বয়ং দক্ষিণ রায়।
২০১৮-য় বহু বছর পর বাঁকুড়ার জঙ্গলে খোঁজ মিলেছিল বাঘের। কিন্তু আক্রমণকারী দলের হাতে সেই বাঘ মারা পড়ে। ‘বাঘ চাই না’ দাবির হাতেকলমে রূপায়ণের উদাহরণ রেখেছিল স্থানীয় দুর্বৃত্তরা। আজ আমাদের বোঝার সময় হয়েছে যে, বাঘ আছে বলেই অনেকের পেটে সামান্য ভাতটুকু জুটছে। নয়তো সেটুকুও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।