সূচনা: ভারতের সংবিধানে স্বাক্ষর করছেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। নয়া দিল্লি, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৫০
বিনা বিচারে বিরামহীন বন্দিত্ব ও অত্যাচার আজকাল গা-সওয়া। তবুও জেল হেফাজতে অশীতিপর বৃদ্ধ পাদরির মৃত্যুর বর্বরতা খানিক সাড়া ফেলেছে দেশে-বিদেশে। আমি ইতিহাসের ছাত্র, আইনের প্যাঁচ বিশেষ বুঝি না— কখন কোন কারিকুরিতে জামিন না-মঞ্জুর করা যায়, তাও জানি না। তবে গত কয়েক বছর ভারতের সংবিধান তৈরির নথিপত্র খানিক নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ হয়েছে, এবং আমাদের নাগরিক অধিকার আসলে কতটুকু— তার ইতিহাস পড়ে, সত্যি বলছি, ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি।
সংবিধান ও আদালতের শুভবুদ্ধির উপর দেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজ এখনও অগাধ আস্থা দেখায়। অপছন্দের কিছু ঘটলেই ‘সরকার অসাংবিধানিক কাজ করেছে’, বা ‘আদালত তার যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি’ জাতীয় অভিযোগ অবধিই আমাদের দৌড়। অর্থাৎ আমরা ধরে নিই, বা কল্পনা করতে ভালবাসি যে, রাজনীতি আর আইন দুটো পৃথক বিষয়। হাজার হোক আমাদের সংবিধান আছে, তা আমাদের পছন্দের গুণিজনরা লিখে গিয়েছেন, অতএব আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু অন্তত আইনত সিদ্ধ, সরকার যা-ই করুক না কেন। এমন বিশ্বাস হয়তো কিছুটা মানসিক শান্তি, এমনকি দেশপ্রেমের গর্ববোধও দেয়, কিন্তু ইতিহাস নির্মম। যে আইনে স্ট্যান স্বামীকে বিনা জামিনে বন্দি রাখা গেল, শুধু সেই আইনের ইতিহাসটুকুই সংবিধানের প্রতি এই মোহ চূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ শাসকের শত্রুদের ধরার জন্য ভারতীয় প্রতিরক্ষা আইন তৈরি হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও একটি কমিটির সুপারিশে বিনা বিচারে আটকে রাখার যুদ্ধকালীন আইনটি জারি রাখা হয়। এই আইনটিই রাওলাট আইন— এই আইনের প্রতিবাদেই জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড হয়, এবং শেষ পর্যন্ত আইনটি দেশ জুড়ে বলবৎ হয় না। কিন্তু যে কথাটি ততটা জানা নয় তা হল, ইংরেজ সরকার রাওলাট আইনের বিধিগুলি অন্য নামে বিভিন্ন প্রাদেশিক আইনের ছদ্মবেশে চালু রাখে, বিশেষত বাংলার বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য ১৯২০ এবং ১৯৩০-র দশকে ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল’ আইনের নানাবিধ সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে। ইংরেজ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত এই আইনগুলি বলবৎ ছিল; ভারতীয়দের গ্রেফতার এবং কারারুদ্ধ করার জন্য আর কোনও আইনগত বাধা ছিল না।
ইংরেজরা ভারত ছেড়ে যায় ১৫ অগস্ট ১৯৪৭; কিন্তু ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন সংবিধান রচনা চলে। মাঝের প্রায় আড়াই বছরের গুরুত্ব অসীম, কারণ এই সময়ে দেশভাগ, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, এবং হায়দরাবাদে সামরিক অভিযান দেশের কাঠামো তৈরিতে গভীর প্রভাব ফেলে। এটুকু বলাই যায় যে, দেশভাগের সময়ের এই আড়াই বছর পুরনো ব্রিটিশ আইনগুলি তো থাকেই, উল্টে প্রাদেশিক কংগ্রেসি সরকারগুলি নতুন নতুন আইন এনে বিচারহীন দণ্ডের বিধিকে বাড়িয়ে তোলে। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরেই কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করার জন্য বাংলায় রাওলাট আইনের নবতম সংস্করণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইন পাশ করেন; আর বিধানচন্দ্র রায় ও তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরণশঙ্কর রায় তাকে আরও দৃঢ় করেন। নাগরিক প্রতিবাদ হয় প্রবল: শরৎচন্দ্র বসু এই আইনের প্রতিবাদে ভোটে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ কলকাতা উপনির্বাচনে নেহরুর প্রার্থীকে পর্যন্ত হারিয়ে দেন; বিধানসভার ভিতরে শেষ পর্যন্ত লড়ে যান জ্যোতি বসু— বার বার কংগ্রেসি মন্ত্রীদের মনে করিয়ে দেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের মন্ত্রগুলি কি অবলীলায় ভুলে যাওয়া হচ্ছে। ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে বিধানসভার বিরোধী নেতা হিসেবে জ্যোতিবাবুর নিরাপত্তা বিল-বিরোধী বক্তৃতাগুলি অধুনা বিস্মৃত, কিন্তু তা পুনঃপাঠ করা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য, কারণ আজও তা মতাদর্শ-নির্বিশেষে আমাদের পথ দেখাতে পারে। কিন্তু তখন পুরো বিধানসভাই বিধান রায়ের কব্জায়, সমস্ত প্রতিরোধের বিরুদ্ধে এই আইন ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বরে পাশ হয়ে গেল।
গন্ডগোল বাধল পরের বছর, ১৯৪৯ সালের অগস্ট মাসে, যখন সংবিধান তৈরির সময়ে প্রশ্ন উঠল: যদি প্রকৃত নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়, তা হলে তো এই সমস্ত আইন বাতিল হতে বাধ্য? নাগরিকের নিজের দেহের উপর অধিকার, আইনের ভাষায় হেবিয়াস কর্পাস— প্রথম অধিকার। বেআইনি বন্দিত্বের বিরোধী অধিকার না থাকলে স্বাধীনতার বাকি অধিকারগুলির কোনও অর্থই হয় না। কিন্তু ১৯৪৯ সালের ২ এবং ২০ অগস্টের বিতর্কগুলি থেকে স্পষ্ট যে নেহরু, পটেল বা অাম্বেডকর— কারও সেই অধিকার সম্পূর্ণ সুরক্ষিত করার বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না; বরং অনেক বেশি চিন্তা ছিল পশ্চিমবঙ্গ-হায়দরাবাদ-কাশ্মীর ইত্যাদি অঞ্চলে বিক্ষোভ দমন করা নিয়ে। মানছি, সেই সময়টা ছিল অস্থির— কিন্তু সংবিধানের মূল কাজ তো যুদ্ধের সময়ে নয়, শান্তির সময়ে। কলকাতায় জ্যোতি বসু যে যুক্তিগুলি দিয়েছিলেন, দিল্লিতে তা আবার বললেন হরিবিষ্ণু কামঠ, কে টি শাহ, শিবনলাল সাক্সেনারা। তাঁদের চাপে পড়ে অাম্বেডকর কারাদণ্ডের মেয়াদ ইত্যাদি বিষয়ে কিছু খুঁটিনাটি সংশোধন করেন, হয়তো তাঁর খানিকটা বিবেকদংশনও ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনটির নির্যাস একই থাকে। কিন্তু কংগ্রেসের যাকে আজ বলা হয় ‘নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা’য় পাশ হয়ে গেল যে, অবস্থাবিশেষে সরকার আইন করে হেবিয়াস কর্পাসকে অগ্রাহ্য করতে পারে, এবং আদালতের হাতেও বিচারহীন বন্দিত্ব আটকানোর ক্ষমতা বিশেষ রইল না। রাওলাটের প্রেতাত্মা শেষে ঠাঁই পেল স্বাধীন ভারতের সংবিধানে।
বিচারবিভাগের দৌড় সংবিধানের বিশ্লেষণ করা অবধি, সর্বোচ্চ আদালতের হাতেও সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ, বিচারহীন বন্দিত্ব সংবিধানে স্থান পাওয়া মানে ধরপাকড়ের আইন মানতে আদালত বাধ্য। বল্লভভাই পটেল সময় নষ্ট করার লোক ছিলেন না; ১৯৫০-এর জানুয়ারি মাসে সংবিধান কায়েম হল, পরের মাসেই পটেল সংসদে বললেন, হাই কোর্টগুলো বড় বেয়াড়াপনা করে বন্দিদের ছেড়ে দিচ্ছে, আমরা প্রাদেশিক আইনের ভরসায় না থেকে দেশ জুড়ে প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন আইন জারি করি। এই আইন পাশ হল ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আগে, অর্থাৎ সেই সংসদ সমস্ত নাগরিকের ভোটে নির্বাচিত ছিল না। সেই শুরু, তার পর আফস্পা, মিসা, টাডা নামের অসংখ্য একুশে আইন ঘুরে আজ ইউএপিএ, যে ধারায় স্ট্যান স্বামী-সহ অসংখ্য প্রতিবাদী নাগরিক আজ কারারুদ্ধ। সবেরই গোড়ায় সেই রাষ্ট্রের হাতে নাগরিককে বিনা বিচারে বন্দি রাখার সাংবিধানিক ক্ষমতা, এবং তার ভিত্তিতে তৈরি ১৯৫০ সালের প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন আইন।
এখানে কিন্তু জরুরি অবস্থার কথা বলছি না। জরুরি অবস্থার অন্য আইন আছে, আর তার আলাদা ইতিহাস এবং বিতর্কও হয়েছে, কিন্তু তা ঘটা করে দেশ জুড়ে জারি হয়েছে কতিপয় বার, সবচেয়ে নাটকীয় ভাবে ইন্দিরা গাঁধীর আমলে। ঢের বেশি ভয়ের হল, জরুরি অবস্থা জারি না করেও দেশের নাগরিককে বিনা বিচারে বন্দি করার অধিকার, এবং, হ্যাঁ, ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রের এই অধিকার আছে। এ হল ইতিহাসের নিষ্করুণ পরিণতি, ইংরেজ শাসনের দীর্ঘ ছায়া এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি আমাদের সংবিধান-রচয়িতাদের অবহেলার মাসুল। এই সরল সত্যটি না মেনে নিয়ে উপায় নেই, এবং এই বিষয়ে আইন-আদালত-সংবিধানের বুলি বার বার আওড়েও বিশেষ সুরাহা হবে বলে মনে হয় না।
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে যে রকম আগুন জ্বলেছিল দেশ জুড়ে, আমাদের সংবিধানের নেতিবাচক অংশগুলির বিরুদ্ধে সে রকম গণআন্দোলনের কথা আজ আর ভাবাই যায় না। আমাদের তথাকথিত ‘লিবারাল’ মহল ভারত-রাষ্ট্রের কাঠামোটিকে প্রশ্ন করতে চায় না, নেহরু-অাম্বেডকরের নির্মোহ পর্যালোচনা করাও তাঁদের ধাতে নেই, কেবল মোদী তথা হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ যে, তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে অপমান করেছেন। ধৃষ্টতা মাফ করবেন, কিন্তু গত সাত বছরে মোদী সরকার দেখিয়ে দিয়েছে যে, ভারতের সংবিধান তারা বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীর চেয়ে ঢের ভাল বোঝে, আইনের প্রতিটি ফোকর তাদের খুব চেনা, তাই দিয়ে কাশ্মীর-দখল থেকে অনির্দিষ্ট কাল কারাদণ্ড, সবেতেই তারা পটু। অন্য দিকে, মনে করিয়ে দেওয়া ভাল যে, জরুরি অবস্থার সময় এডিএম জবলপুর মামলায় দেশে হেবিয়াস কর্পাসের অনুপস্থিতি শীর্ষ আদালত কার্যত মেনে নেয়— একমাত্র বিচারপতি হংসরাজ খন্না বিরুদ্ধ মত পোষণ করে বলেছিলেন যে, মুক্তির অধিকার সংবিধানের আইনেরও আগে আসে।
সংবিধানের অন্ধপূজা না করে তার ফাঁক-ফোকরগুলো বন্ধ করার জন্য নাগরিক আন্দোলনই পথ। রাজনীতির স্বার্থে আইনকে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু অধিকারের ভিত আরও দৃঢ়— জ্যোতি বসু থেকে হরিবিষ্ণু কামঠ এই সত্যটিই বুঝেছিলেন। সংবিধান সভায় বিফল হয়েও কামঠ দীর্ঘ দিন রাজনীতি করেন, জয়প্রকাশ নারায়ণের সহযোগী হয়ে জরুরি অবস্থার সময়ে জেলও খাটেন; ১৯৭৭-এ ইন্দিরা পরাস্ত হওয়ার পর কামঠ লেখেন যে, তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য হল অত্যাচারী আইনের জাল কেটে দেশের ‘আসলি’ সংবিধানটি উদ্ধার করা। সেই পথেই মুক্তির আলো এখনও খানিকটা দেখা যায়।