সময়টা এমসিকিউ-এর। কয়েকটা ‘হয়-নয়’, ‘হ্যাঁ-না’-সূচক বিকল্প সমাজ-সংসারে, রাষ্ট্র-ব্যবস্থায়, পরীক্ষার খাতায় প্রশ্ন হিসাবে দেওয়া হচ্ছে। নিশ্চিত ভাবে নাকি একটা বেছে নিলেই কেল্লা ফতে। বেছে নিতে না-পারলে দুর্ভোগ! তবে সবাই তো উন্নতিশীল নন, অনেকেই ক্যাবলরাম বাছতে গিয়ে অসুবিধার মধ্যে পড়েন। হ্যাঁ-না’এর বাইরে নানা কথা মনের মধ্যে ঘাই মারে। অনেকে আবার অসুবিধা যে ভোগ করছেন তা বুঝলেও ভয়ে-দ্বিধায় মুখ ফুটে বলতে চান না। তবে সুকুমার রায়ের মতো সাহসী মানুষজনেরা কথা বলতেন। ‘ভাষার অত্যাচার’ প্রবন্ধে সুকুমার লিখেছিলেন, “মানুষে প্রশ্ন করে, ‘তুমি জাতীয়তা জিনিসটা বিশ্বাস কর কিনা’ ‘তুমি হিন্দুত্বকে মানো কিনা’ আর সঙ্গে-সঙ্গে একটা হাঁ-না গোছের জবাব প্রত্যাশা করে।” প্রশ্নের হ্যাঁ-না গোছের নিশ্চিত উত্তর প্রত্যাশা করা যে অনেক ক্ষেত্রে অত্যাচার আর এ-জাতীয় প্রত্যাশা থেকে উঠে আসা প্রশ্নোত্তর যে ছদ্ম-বিজ্ঞানমনস্কতার অন্যতম লক্ষণ তা সুকুমার রায় মানতেন। আবোল তাবোল-এর পাতায় ফুটোস্কোপধারী, নোটবইধরা, গজাল-মেরে-মাথায়-ঢোকানোপন্থীরা সেই সবজান্তা, ছদ্ম-বিজ্ঞানমনস্ক দলের প্রবল পুরুষ।
আপাতত সুকুমার রায়ের লেখার সূত্রে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটা নিয়ে ভাবা যাক। “তুমি হিন্দুত্ব মানো?” এই প্রশ্ন তো এখন নানা ভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। হিন্দুত্ব লিখে যদি গুগল করেন তা হলে অন্তর্জালের তথ্যপ্রদায়ী সবজান্তারা শুনিয়ে দেবে হিন্দুত্ব শব্দটির ‘হিন্দি’ উচ্চারণ কী। জানাবে, এটি রাজনৈতিক মতবাদ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের সর্বগ্রাসী সাংস্কৃতিকপন্থাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই শব্দটিকে ১৯২২-এ বিনায়ক দামোদর সাভারকার তাঁর হিন্দুত্ব নামের মার্কামারা বইটিতে বিশেষ ভাবে নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করেন। এক দিক থেকে এই তথ্যে কোনও ভুল নেই। কিন্তু এটাই কি শুধু মনে রাখার? এটাকেই শুধু ধরে নিয়ে একটা লড়াইও চোখে পড়ে। ‘হিন্দুধর্ম’ বনাম ‘হিন্দুত্ব’ দুইয়ের লড়াই। সাভারকারের বইটিকে মান্যতা দিয়ে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটিকে সেখানে সাভারকারের অর্থে ছেড়ে দেওয়া হল। এক ভূমি, এক ভাষা, এক ধর্ম নামক সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিকপন্থার ঐক্যচিন্তাই ‘হিন্দুত্ব’ আর এই চিন্তার বাইরে নানাত্ব-বিধায়ক ধর্মবোধ ‘হিন্দুধর্ম’, এ-ভাবে উদারপন্থীরা লড়াই করতে চান।
প্রশ্ন হল, ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটিকে আমরা একটি অর্থের হাতেই ছেড়ে দেব কেন? পদ্মফুল দেখতে চমৎকার। পদ্মমুখী শব্দটি তো রমণীয় মুখের বিবরণে ব্যবহৃত হত। বিশেষ রাজনৈতিক দল, সাভারকারপন্থায় বিশ্বাস করে, পদ্মকে প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেন বলেই কি পদ্মের অপরাপর পূর্ববর্তী অনুষঙ্গ আমরা ভুলে যাব? যদি যাই তা হলে কিন্তু সঙ্কীর্ণবাদীদেরই জয়। তাঁদের অর্থ ও তাৎপর্যকে মেনে নিয়ে পদ্ম নামক রমণীয় ফুলটিকে আমরা দল-বিশেষের প্রতীক হিসাবে মনে রাখছি। পদ্ম তো কেবল রাজনৈতিক পুষ্প নয়। এ রাজনৈতিক দলের আবির্ভাবের ঢের আগে এ ফুল তার শ্রী ও সৌন্দর্য নিয়ে নানা ধর্মের নানা বর্ণের মানুষের মন ভুলিয়েছে।
একই কথা হিন্দুত্ব শব্দটি সম্বন্ধে খাটে। ১৯২২-এর আগে স্বাভাবিক ভাবেই এই ‘তৎসম’ শব্দটির অস্তিত্ব ছিল। গুগল যা বলে তা সব ‘সত্য নহে’— হিন্দুত্ব শব্দের উচ্চারণ বাংলা মতে করলেও শব্দটি জাত খোয়াবে না। মনুষ্য থেকে যেমন মনুষ্যত্ব, হিন্দু থেকে তেমন হিন্দুত্ব। সুকুমার রায় লিখেছিলেন, “হিন্দু বা হিন্দুত্ব বলিতে তুমি কি-কি [কী-কী] জিনিস বুঝিয়া থাক? তবে তো বলিতে পারি তোমার জাতীয়তাকে, তোমার হিন্দুত্বকে আমি স্বীকার করিতে প্রস্তুত কি না।” ‘হিন্দুত্ব’-এর বিশেষ একটি রূপকে সুকুমার রায় একেবারেই স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। ‘সমালোচনা’ নামে তাঁর একটি পদ্য আছে, যা পড়লে বোঝা যাবে হিন্দুত্ববাদের বিশেষ ফুল-চন্দন দিয়ে কবিখ্যাতি লাভ করতে চান যাঁরা তাঁদের প্রতি তিনি কৌতুকপরায়ণ। তার অর্থ এই নয় হিন্দুত্ব মাত্রেই সুকুমারের কাছে বিরক্তিকর, তিনি জানতে চান, “হিন্দুত্ব বলিতে তুমি কি-কি [কী-কী] জিনিস বুঝিয়া থাক?” এই জানতে, বুঝতে চাওয়াই সহনশীল বহুত্ববোধক গণতন্ত্রের শর্ত।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ধর্মতত্ত্ব গ্রন্থে লিখেছিলেন “অচ্ছেদ্য, অভিন্ন, জাগতিক প্রীতি ভিন্ন হিন্দুত্ব নাই।” বঙ্কিমচন্দ্রের ‘হিন্দুত্ব’-এর আদর্শের জাত আর সাভারকারের বইয়ের ‘হিন্দুত্ব’-এর আদর্শের জাত আলাদা। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের যে উপন্যাসটি নিয়ে ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের নানা সমালোচনা, সেই উপন্যাসে সন্তান দল যে ‘হিন্দুত্ব’-এর পরিপোষক সেই হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে কিন্তু ধর্মতত্ত্ব বইয়ের আদর্শ ‘হিন্দুত্ব’-এর মিল নেই। আনন্দমঠ-এ বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “বিশেষ মুসলমানরাজ্যের অরাজকতায় ও অশাসনে সকলে মুসলমানের উপর বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দুধর্মের বিলোপে অনেক হিন্দুই হিন্দুত্ব স্থাপনের জন্য আগ্রহচিত্ত ছিল। অতএব দিনে দিনে সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দিনে দিনে শত শত, মাসে মাসে সহস্র সহস্র সন্তান আসিয়া ভবানন্দ জীবানন্দের পাদপদ্মে প্রণাম করিয়া, দলবদ্ধ হইয়া দিগি্দগন্তরে মুসলমানকে শাসন করিতে বাহির হইতে লাগিল। যেখানে রাজপুরুষ পায়, ধরিয়া মারপিট করে, কখন কখন প্রাণবধ করে, যেখানে সরকারী টাকা পায়, লুঠিয়া লইয়া ঘরে আনে, যেখানে মুসলমানের গ্রাম পায়, দগ্ধ করিয়া ভস্মাবশেষ করে।” এই হিন্দুত্ব কিন্তু ‘জাগতিক প্রীতি’র প্রকাশক নয়। ‘বিশেষ মুসলমানরাজ্যের অরাজকতায়’ ‘যেখানে মুসলমানের গ্রাম পায়’ সেখানেই পুড়িয়ে দেয় এই হিন্দুত্ব অন্যায়কারী, অমানবিক, অনাচারী। আনন্দমঠ সন্তানদলের কাজের সমর্থনে লেখা উপন্যাস নয়। এই উপন্যাস সন্তানদলের কাজের সমালোচনাও করে, আবার সন্তানদের এই অনাচার কোন পরিস্থিতির ফল, সে-কথা জানাতে ভোলে না। সেই পরিস্থিতিকে যেমন সমর্থন করা যায় না, তেমনই দাঙ্গাবাজ সন্তানদলকেও সমর্থন করা অসম্ভব। সুকুমার রায়ের ভাষায় সন্তানদলের জাতীয়তাকে ও সন্তানদলের হিন্দুত্বকে স্বীকার করার পথে বাধা হল— তাদের মধ্যে জাগতিক প্রীতির অভাব।
তাঁকে যাতে কেউ ভুল না বোঝেন, সে জন্য রাজসিংহ উপন্যাসের ‘উপসংহার’-এ গ্রন্থকার বঙ্কিম লিখেছিলেন, “হিন্দু হইলেই ভাল হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না, অথবা হিন্দু হইলেই মন্দ হয় না, মুসলমান হইলেই ভাল হয় না। ভাল মন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্যরূপেই আছে।” আনন্দমঠ উপন্যাসের সন্তানেরা এই বঙ্কিমী নীতির বিরোধী। বিশেষ মুসলমান শাসকের অরাজকতার প্রতিহিংসা নিতে তারা মুসলমান মাত্রকে হত্যা করে, অসহায় গ্রামবাসীদের পুড়িয়ে মারে। এ-হল দাঙ্গার রাজনীতি।
এই দাঙ্গার রাজনীতির চেহারা কী প্রবল হতে পারে, তা পরের শতকে অনেকটাই আঁচ করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দাঙ্গা দেখেওছিলেন। ‘বাস্তব’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “বর্তমান সময়ে কতকগুলি বিশেষ কারণে হিন্দু আপনার হিন্দুত্ব লইয়া ভয়ংকর রুখিয়া উঠিয়াছে। সেটা সম্বন্ধে তাহার মনের ভাব বেশ সহজ অবস্থায় নাই। বিশ্বরচনায় এই হিন্দুত্বই বিধাতার চরম কীর্তি এবং এই সৃষ্টিতেই তিনি তাঁহার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করিয়া আর-কিছুতেই অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না, এইটে আমাদের বুলি।” এই যে হিন্দু তার হিন্দুত্ব নিয়ে রুখে ওঠে, হিন্দুত্ব সম্বন্ধে তাদের মন আর সহজ অবস্থায় থাকে না, তার নানা ‘বিশেষ কারণ’ থাকে। পরাধীন ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিভেদের রাজনীতি গড়ে ওঠার নানা কারণ আর সেই বিভেদের রাজনীতি থেকে যে ‘হিন্দুত্ব’ নামক ভাবনাটি গড়ে ওঠে তার সঙ্গে জাগতিক প্রীতির অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ ছিল না— প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেখানে মুখ্য। ‘হিন্দুত্বই বিধাতার চরম কীর্তি’ এই ভাবনা অসহজ অহঙ্কার। সাভারকারের বইটিও সেই প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বের ধোঁয়ায় ধুনো দিয়েছিল। সাভারকার কল্পিত হিন্দুরাজ্যে অনেকেরই ঠাঁই হয় না। নর্ডিক জার্মানরাই সেরা— এই ভাবনার মতোই ‘হিন্দুত্ব বিধাতার চরম কীর্তি’ এই ভাবনা।
তাই বলে প্রতিযোগিতামূলকতায় বিশ্বাসী হয়ে ভয়ঙ্কর রুখে ওঠাই ‘হিন্দুত্ব’ শব্দের একমাত্র অর্থ, এমন সহজ সিদ্ধান্তে যদি আমরা উপস্থিত হই, ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটিকে সঙ্কীর্ণপন্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার কথাই যদি ভাবি, তা হলে তো সাম্প্রদায়িকদেরই জয় হবে। এমন মানুষও তো আছেন যিনি ‘হিন্দুত্ব’ বলতে জাগতিক প্রীতি বোঝেন। বিশেষ মুসলমানের অপকীর্তির জন্য নির্বিশেষে সব মুসলমানদের যেমন দোষ দেওয়া যায় না— তেমনই বিশেষ এক প্রকার ‘হিন্দুত্ব’-এর দোষে অন্য সব প্রকার ‘হিন্দুত্ব’কে আঘাত করা যায় না। তবে কিনা, সেই অন্য প্রকারের সেই হিন্দুত্ব-কেও প্রমাণ করতে হবে যে, সে সঙ্কীর্ণ পথের পথিক নয়।