দামোদর নদের উৎপত্তিস্থল ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুরের পাহাড়। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নদীটির প্রবাহ প্রথম ২৪০ কিমি ঝাড়খণ্ডে আর শেষ ৩০০ কিমি পশ্চিমবঙ্গে হওয়ার পর কলকাতার কাছে হুগলি নদীতে মিশেছে। ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের ঠিক উজানে মিলিত হয়েছে এর প্রধান উপনদী বরাকর। দুর্গাপুর পার করে দামোদর হঠাৎ তার গতিপথ পরিবর্তন করে এবং দু’টি চ্যানেলে বিভক্ত হয়— একটির নাম দামোদর চ্যানেল বা আমতা চ্যানেল এবং অন্যটি হল কঙ্কা-মুণ্ডেশ্বরী চ্যানেল। দামোদরের বন্যার ইতিহাস বহু পুরনো। স্বাধীনতার পর পরই ১৯৪৮ সালের ৭ জুলাই দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) গঠিত হয় কেবল এই নদীর বন্যার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করতে। প্রথম দফায় তিলাইয়া, কোনার, মাইথন ও পাঞ্চেত বাঁধ নির্মাণ করার পর নদীধারার নীচের দিকে দুর্গাপুর ব্যারাজ নির্মিত হয়েছিল, যা আনুমানিক ৩,৬৪,০০০ হেক্টর জমির সেচের জল ক্যানাল দ্বারা সরবরাহ করে থাকে। এই সব কিছুই ছিল ডিভিসি-র নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু ১৯৭৮ সালে তৎকালীন বিহার সরকার দামোদরের উপর তেনুঘাট বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ ভাবে ঝাড়খণ্ড সরকারের। বিহার সরকার এই বাঁধের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ না করতে পারায় বাঁধটির বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোনও ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ, ঝাড়খণ্ড রাজ্যে পাঁচটি বাঁধ আছে, যার ছাড়া জল পশ্চিমবঙ্গেই ঢুকবে এবং তেনুঘাট বাদে বাকি চারটি বাঁধ নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গের দু’জন প্রতিনিধি আছেন। ডিভিসি-র চারটি ড্যাম বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময়ে খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কাহিনির পটভূমি রচনা হয়েছিল গত ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে নিম্ন দামোদর উপত্যকার প্রবল বর্ষণে। এর পর ঝাড়খণ্ডে উচ্চ উপত্যকায় বৃষ্টি হল ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে। ১৭ তারিখ থেকে অবশ্য বৃষ্টি থেমে যায়। কিন্তু বৃষ্টির পর দামোদরের আমতা চ্যানেল এবং মুণ্ডেশ্বরীর জল হুহু করে বেড়ে যায়। ও-দিকে শিলাবতী, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বরও কানায় কানায়। অতিরিক্ত জল সামলাতে যখন মাইথন পাঞ্চেত বাঁধগুলি ব্যস্ত, তখনই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে ঝাড়খণ্ড সরকার তেনুঘাটের গেট খুলে জল ছেড়ে দেয়। একলপ্তে ৮৫,০০০ কিউসেক জল আসার পর আর কিছু করার ছিল না কারও পক্ষেই।
মাইথন বা পাঞ্চেত জলাধারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বন্যা-নিয়ন্ত্রণ এবং সেচের জন্য জলাধার থেকে জল সরবরাহ করার জন্য। পাশাপাশি বিভিন্ন পুর এলাকা এবং শিল্পের জন্য জল সরবরাহ এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও করা হয়। জলাধার বানাতে গেলে একটি বাঁধ কিংবা ব্যারাজের প্রয়োজন থাকে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে একটা নির্দিষ্ট সীমার নীচে জলাধার বা রিজ়ার্ভারের জলের স্তর নামানো যায় না। এই স্তরকে বলা হয় ‘মিনিমাম ড্র ডাউন লেভেল’, সংক্ষেপে এমডিডিএল। আবার বাঁধের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে গেলে কখনও নির্দিষ্ট করে দেওয়া সীমার উপর জলের স্তর নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাঁধের উপর দিয়ে জল যেতে দেওয়ার কথা তো কল্পনাতেও আনা যায় না, কারণ সে ক্ষেত্রে বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়ে মহাপ্লাবনের মতো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। অতি সম্প্রতি ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত সিকিমের তিস্তা-থ্রি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ ভেঙে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের স্মৃতি মানুষের মনে এখনও তাজা।
ফিরে আসি এমডিডিএল-কথায়। এই স্তরের অনেক উপরে থাকে এফআরএল বা ‘ফুল রিজ়ার্ভার লেভেল’। জলাধারের লেভেল কী রাখা হবে, তার নজরদারিতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি থাকে। সেই কমিটিতে যেমন পরিচালক সংস্থার পদাধিকারীরা থাকেন, তেমনই জলধারার নীচের দিকের রাজ্যের প্রতিনিধিরাও থাকেন। সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনুমোদিত হয় বছরের বিভিন্ন সময়ে জলস্তর কী রাখা হবে, সেই নিয়ে। বাঁধের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, তাও এই কমিটি নজর রাখে। উদ্দেশ্য একটাই, বিপর্যয় এড়ানো। সাধারণ সময়ে আগত জলের ধারার পরিমাণ হিসাব করে এমডিডিএল বেশি রাখা হলেও, বর্ষাকালে তা নিয়ন্ত্রিত রাখার সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা রাখা থাকে, যাতে অকস্মাৎ অতিবৃষ্টিতে আগত জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে সেই অতিরিক্ত জলের ধাক্কা বাঁধ সামলাতে পারে। ন্যূনতম স্তর থেকে জল বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছনোর আগেই যদি বৃষ্টি ধরে যায়, তা হলে তো কথাই নেই। জলাধার নিজে অতিবৃষ্টির চাপ নীচের এলাকাকে জানতে না দিয়ে নিজেই ধারণ করে নেয়। একে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘ফ্লাড কুশনিং’ বলা হয়। অন্যথায় যদি বর্ধিত জলের পরিমাণ বাড়তেই থাকে, তা হলে নিয়ন্ত্রিত ভাবে স্পিলওয়ে গেট খুলে জলস্তর নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এই সব কিছুর উপরেই নজরদারি করার জন্য ১৯৬৪ সালের এক নির্দেশিকায় দামোদর উপত্যকা নদী নিয়ন্ত্রক কমিটি (ডিভিআরআরসি) গঠন করা হয়েছিল, এবং তার মাথায় আছেন কেন্দ্রীয় জল কমিশনের সদস্য স্বয়ং। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় জল কমিশনের এক জন সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার সেই কমিটির অন্যতম প্রধান। বাকি ছয় সদস্যের মধ্যে দু’জন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার, দু’জন ঝাড়খণ্ড সরকারের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার এবং দু’জন ডিভিসি-র মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার।
এঁদের মূল দায়িত্বই হল জলস্তরে নজর রাখা এবং স্পিলওয়ে গেট কখন কত শতাংশ খোলা হবে, তার নির্দেশ দেওয়া। কমিটির আদেশ ছাড়া কেউ ইচ্ছামতো জল ছাড়তে পারে না। কমিটির নির্দেশ অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অতএব এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে যা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। সরকারের দু’জন সদস্যের যদি স্পিলওয়ে গেট খুলতে আপত্তি থাকত, তা তাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন বলে তো কেউ দাবি করছেন না! কারণ, ১৫ সেপ্টেম্বর থেকেই লাল সতর্কতা জারি হয়েছিল আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস দেখে।
তা ছাড়া পলি জমে দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সমস্ত নদীরই গভীরতা কমে যাওয়ায় জলবহন ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। ফলত, সমপরিমাণ জলস্ফীতিতে পঞ্চাশ বছর আগে বন্যা না হলেও এখন দু’কূল ছাপিয়ে যায়। যে-হেতু ড্রেজিং একটি প্রযুক্তিগত কাজ এবং ভোট-রাজনীতিতে এর কোনও বাজার নেই, তাই বোধহয় কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারই নদীগুলির ড্রেজিং নিয়ে কোনও রকম চিন্তাভাবনা করতে ইচ্ছুক নয়। যত দিন না তেনুঘাট প্রকল্প ডিভিসি-র নিয়ন্ত্রক কমিটির আওতায় আসবে, আর যত দিন না দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলিরও সংস্কার হবে, তত দিন পর্যন্ত এই প্লাবন সহ্য করতেই হবে। ভাবের ঘরে চুরি করার কোনও অর্থ নেই।