নিজের বলতে যা বোঝায়— শাণিত শরীর, প্রসাধনলালিত মুখশ্রী, আপ্লুত অভিব্যক্তি, উচ্ছ্বসিত বন্ধুসমষ্টি, অর্জিত সম্পত্তি, লব্ধ পণ্য— সবই এখন সেলফি তথা নিজস্বীর আওতায়। যা কিছু নিজের নয়, তা-ও। সাগরে, বরফে, বিমানে, পাতালে, রাস্তায়, রেস্তরাঁয়— বিশ্বময় মানবকুল মেতে আছে দৃশ্য-সাধনায়। শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আমরা অনবরত এক হাত বাড়িয়ে, বিভিন্ন কোণ থেকে নিজের ছবি তুলে ও তক্ষুনি তা বিলিয়ে নিজেদের তোল্লাই দিচ্ছি। এ এক নেশাময় ডিজিটাল-ক্রিয়া।
ছবি তো মানুষ প্রায় দু’শো বছর ধরে তুলছে। কিন্তু নিজেকে দেখার ও দেখানোর এই বিশ্বব্যাপী প্রবণতাকে উস্কে দিয়েছে ফোনের সেলফি ক্যামেরা। এই দৃশ্যকেন্দ্রিকতা ইন্টারনেট-নির্ভর, যার মাধ্যমে নিমেষে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে দৃশ্য-তথ্যের বণ্টন সম্ভব। আমরা স্বেচ্ছায় আমাদের প্রতিনিধিত্বের দায়ভার সঁপে দিয়েছি নিজস্বীকে। প্রযুক্তি আমাদের অংশবিশেষ নিয়ে অনায়াসে পাড়ি দিচ্ছে অন্যের ফোনের পর্দায়। আমাদের অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে অস্থির, সর্বদা মন্তব্যপিপাসু। সেই অস্থির সত্তা বাধ্য করে আমাদের চালচলন, হাবভাব, পাশের মানুষজন ও পটভূমি পাল্টে পাল্টে নিজেকে সচেতন ভাবে সাজাতে। গোটা পরিকল্পনাটাই নিজের, যদিও অধিকাংশ সময় তা অপরমুখী। আর তাই এই মুহূর্তে সেই ছবির বিতরণ না হলে সমস্ত প্রয়াসটাই বৃথা।
নিজস্বী-স্পৃহাকে উৎসাহিত করতে বাজারে আসছে নিত্যনতুন সেলফি-এক্সপার্ট ক্যামেরা, যা উন্নততর আত্ম-ছবি তুলতে সক্ষম, আরও কম আলোয়, আরও স্পষ্ট করে। মেগাপিক্সেল-মহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে নিজেরই আরতি, নিমেষে বিলুপ্ত হচ্ছে পুরনো ক্যামেরা-প্রযুক্তি। ভবিষ্যতের নিজস্বী-তরঙ্গে বিলীন হচ্ছে এক মুহূর্ত আগে তোলা ছবিও। নিজস্বীর মেয়াদ স্বল্প, এই অস্থায়ীত্বই তার স্বভাব। সাময়িকতার দৈনন্দিন উৎসবে আমরা এতটাই মগ্ন যে, কোনও নিজস্বীই আলাদা করে দাগ কাটে না, দীর্ঘমেয়াদিও হয় না। স্থিরচিত্রের নান্দনিক দর্শনে স্থান-কালের স্থিতির যে অনড় ভাবনা ছিল, ডিজিটাল অঢেলপনা তা বাতিল করেছে। নিজস্বীর বাহুল্যের সামনে অ্যালবামের ছবি মূল্যবান হলেও অচল; নস্ট্যালজিয়া-মাখা, কাগজে-ছাপা ছবি অতীতের সাক্ষী মাত্র। একবিংশ শতকের নিজস্বী-প্রযুক্তি স্বীকৃতি দেয় দৃশ্যের আধিক্যকে। নিমেষে, নির্ঝঞ্ঝাটে কমকে বেশিতে, এক-কে একাধিকে ও অদৃশ্যকে দৃশ্যে পরিণত করাই এই দৃশ্য-প্রযুক্তির দর্শন।
ছবির সঙ্গে আমাদের দুই শতকের থিতু সম্পর্ক ও তার যাবতীয় ভিত্তিকে চুরমার করেছে নিজস্বী। তবে কেবল আধিক্যের যুক্তি দিয়ে আত্ম-দৃশ্যের এই জোয়ারকে ব্যাখ্যা করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আরও তিনটি বৈশিষ্ট্য মনে রাখা জরুরি। প্রথমত, মাধ্যমের গণতন্ত্রায়নের ফলে জনসাধারণের পকেটে ও হাতে এখন দৃশ্য-যন্ত্রের এবং ছবি তোলারও চরম সুবিধা, এক দশক আগেও যা আবদ্ধ ছিল বিশেষজ্ঞদের জিম্মায়। ক্ষমতার হাত ধরে এসেছে সমতাও— ঘুচেছে ফোটোগ্রাফার ও নন-ফোটোগ্রাফার’এর মধ্যেকার পরম্পরাগত তফাত, দূরত্বও। স্মার্টফোনের ক্যামেরা রীতিমতো টেক্কা দিচ্ছে নামীদামি ক্যামেরাকে। অনেক ফোনের বিজ্ঞাপন দেখলে মনে হতে পারে, তারা হয়তো ফোন নয়, ক্যামেরাই বেচতে চাইছে। এখন সবাই ছবি তুলতে সক্ষম, সবাই ফোটোগ্রাফার। ছবির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন, সে অন্য প্রসঙ্গ। দ্বিতীয়ত, দশ বছর আগেও, যে ছবি তুলছে ও যার ছবি তোলা হচ্ছে তাদের বিভাজন ছিল প্রশ্নাতীত। প্রথাগত ভাবে এরা পৃথক ও ভিন্ন না হলে স্থিরচিত্র নির্মাণ সম্ভবই ছিল না। নিজস্বী এই সমীকরণ উল্টে দিল। যার হাতে ক্যামেরা, সে-ই এখন ফোনের পর্দা জুড়ে। নিজেকে নিজের মতো করে ‘দেখার’ যে দৃশ্য ফোনের পর্দায় দেখা যাচ্ছে, সেটাই ছবি। ছবি তোলার সময় নিজেকে অনবরত দেখা এবং সেই দৃশ্যটিই সবাইকে দেখানো, এটাই নিজস্বী-নির্মাণের প্রণালী। দেখনদারির এই মুদ্রায় চিত্র ও চিত্রকর একনিষ্ঠ। তৃতীয়ত, ছবি তোলার মুহূর্তে ক্যামেরায় দেখা আর তোলার পর তা কাগজে দেখার মধ্যে যে চিরাচরিত স্থান-কালের ফারাক ছিল, তা আজ বিলীন। ছবি তোলার প্রক্রিয়াটাও এখন ছবি। নিজস্বী-পূর্ব যুগে ছবি তোলার প্রণালী ছিল ছবির অগোচরে, সেটাই এখন নির্দ্বিধায় ছবির অন্তরে। দৃষ্টি, দৃশ্য, দৃশ্যকার— সবই মিলেমিশে একাকার।
নিজস্বীগ্রস্ত এই সভ্যতা সদা তৎপর নিজেকে দৃশ্য-পণ্যে পরিণত করে ও তাকে বিতরণ করে নজর কাড়তে। নিজস্বী-ক্যামেরা এখন আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ছবি তুলে জানান না দিলে যেন জীবন বৃথা। ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রতিটি ব্যক্তিগত মুহূর্তই এখন প্রচারযোগ্য ও মন্তব্যকামী। নিজের অস্তিত্ব, সঙ্গ বা একাকিত্ব, কর্মকাণ্ডকে নিজস্বীর মাধ্যমে সম্প্রচার করাটা এখন দৈনিক অভ্যাস। এই স্বমুদ্রণের মাধ্যমে আমরাই দৃশ্য, আমরাই দর্শক; নিজস্বী-দর্শনের ধারক বাহক প্রচারকও আমরাই। আমরাই অংশগ্রহণকারী; আমরাই মূল্যায়নকারী।
সমাজবিদ্যা বিভাগ, শিব নাদার ইউনিভার্সিটি