নিরাপত্তা: মুম্বইয়ের হ্যাবিট্যাট স্টুডিয়োয় শিবসেনা (শিন্দে)-র কর্মীদের হামলার পর পুলিশ প্রহরা। ২৪ মার্চ। ছবি: পিটিআই।
আরও এক বার রাষ্ট্রযন্ত্রকে চটিয়ে দিতে সক্ষম হলেন কুণাল কামরা। এই নিয়ে তৃতীয় বার, না কি চতুর্থ, সে হিসাব যদি গুলিয়ে যায়ও, এই প্রথম বার যে একটা অন্য ঘটনাও ঘটছে, সেটা খেয়াল না করা মুশকিল— এ বার উদারপন্থী ভারত প্রায় নির্দ্বিধায় কুণালের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর আগেও কুণাল সরকারের রোষে পড়েছেন, বীর দাসের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে অসংখ্য এফআইআর, রীতিমতো জেল খেটে এসেছেন মুনাব্বর ফারুকি— কিন্তু, সমাজমাধ্যমে নাগরিক সমাজের ঢেউ এ বার যেমন প্রবল হয়ে আছড়ে পড়ছে, আগে কোনও বারই তেমনটা হয়নি।
স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জুলুম শেষ অবধি নাগরিক সমাজের অসহ্য হল কি না, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বরং একটা অন্য প্রশ্ন করা যাক— গত মাসেই যখন বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন আর এক স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান সময় রায়না, এবং তাঁর সঙ্গী ইউটিউবার রণবীর এলাহাবাদিয়া ওরফে ‘বিয়ার বাইসেপস’, তখনও কি নাগরিক সমাজের মনে হয়েছিল যে, রাষ্ট্রীয় রোষের বিরুদ্ধে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন? নিজেকে যদি মাপকাঠি ধরতে হয়, তা হলে বলব, আমাদের মনে হয়নি সে কথা। কেন, সে কারণটাও খুব স্পষ্ট— সময়-রণবীর যে কথা বলেছিলেন, সঙ্গত কারণেই আমাদের মনে হয়েছিল যে, কথাটি নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। অশালীনও বটে। মনে হয়েছিল, এমন কথা বলা আসলে রাষ্ট্রের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া, যে অস্ত্রে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বাক্স্বাধীনতার পরিসরটিকে। ঘটনাক্রমে, সময়-রণবীরের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে বলেছিল, সমাজমাধ্যমের মতো গণপরিসরে অশালীনতা নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু করা প্রয়োজন। আমরা বিরক্ত হয়েছিলাম সময়দের উপরে।
ভাবিনি যে, ওঁরা যে কথাটা বলেছেন, সে কথা বলার বাক্স্বাধীনতাও রক্ষা করা প্রয়োজন। খেয়াল করুন, এই লেখায় রণবীর এলাহাবাদিয়ার মন্তব্যটির উদ্ধৃতি দিচ্ছি না— কথাটা কুরুচিকর বলে মনে করছি বলেই দিচ্ছি না। কিন্তু, কোনও কথা আমার রুচিতে বাধে বলেই রাষ্ট্র সে কথা বলার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চাইলে তার প্রতিবাদ করব না, এই অবস্থানটার মধ্যে একটা বড় ধরনের গোলমাল আছে না? কুণাল কামরা যে কথা বলেছেন, যে রকম কথা বলে থাকেন, সে কথাগুলো আমাদের বিশ্বাসের কাছাকাছি বলে তাঁর বাক্স্বাধীনতা চাইব, আর রণবীর এলাহাবাদিয়ার কথা রুচিতে বাধে বলে তাঁর বাক্স্বাধীনতার পরোয়া করব না— ‘উদারবাদী’দের এই অবস্থানটি আসলে খুলে দিচ্ছে একটা অন্য দরজা: কোনও একটি বিশেষ অবস্থান থেকে বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে বিচার করার দরজা। সেই ফাঁক গলে ঢুকে পড়বে মনুবাদী সমাজসত্তা, এ কথাটা উদারবাদীরা কোনও আশ্চর্য কারণে ভুলে যান মাঝেমধ্যেই।
এখানে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রায়না-এলাহাবাদিয়া আর কুণাল কামরার কমেডি অথবা তাঁদের বক্তব্যের গুরুত্বকে কোনও ভাবেই তুলনীয় বলছি না। দু’পক্ষের কথার সামাজিক অভিঘাতও এক নয়, লক্ষ্যবস্তুও এক নয়। বস্তুত, সেটাই আসল কথা— দু’পক্ষের মধ্যে কোনও তুলনা যদি সম্ভব না-ও হয়, তবুও রাষ্ট্রের হাত থেকে দু’পক্ষের বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই সমান ভাবে লড়া প্রয়োজন। তাঁদের কথা বা আচরণ যদি আইনের সীমা লঙ্ঘন করে, আদালত নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করবে; কথাগুলিকে নিন্দনীয় মনে করলে সমাজও নিশ্চয়ই নিন্দা করবে, তীব্র বিতর্ক হবে; বিয়ার বাইসেপস-এর মতো লোকদের অবশ্যই মনে করিয়ে দিতে হবে যে, অহেতুক শালীনতার গণ্ডি অতিক্রম করলে তাতে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু, কারও কথা ‘সামাজিক মূল্যবোধ’ বা ‘নৈতিকতা’র গণ্ডি অতিক্রম করছে বলে রাষ্ট্র তাঁর বাক্স্বাধীনতা খর্ব করতে চাইলে, তিনি ঠিক কতখানি রুচিশীল বা উদারপন্থী মতের কাছাকাছি কথা বলছেন, তার হিসাব না কষেই রাষ্ট্রের সেই দখলদারির প্রতিবাদ করা জরুরি। কারণ, রাষ্ট্র যে ‘মূল্যবোধ’ বা ‘নৈতিকতা’র কথা বলে, সেটা নিয্যস মনুবাদী— হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী, পুরুষতান্ত্রিক, বর্ণাশ্রমবাদী এক নৈতিকতা। তার দখল থেকে নাগরিক অধিকারকে রক্ষা করা উদারবাদী রাজনীতির পূর্ণ সময়ের কাজ হওয়া উচিত।
আজকের ভারতে এই কথাটা দ্বিগুণ সত্যি। কারণ, বিজেপি যে রাজনৈতিক একাধিপত্য কায়েম করতে চায়, তা হাড়ে-মজ্জায় নির্ভরশীল এই মনুবাদী সমাজব্যবস্থার উপরে— বিজেপির রাজনৈতিক আধিপত্যের চূড়ান্ত রূপ এই একশৈলিক হিন্দুত্ববাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কুণাল কামরার কমেডি যেমন ধাক্কা দেয় এই রাজনৈতিক সমাজকল্পনার গায়ে, রণবীর এলাহাবাদিয়ার মন্তব্যও লাগে সেখানেই— ফারাক হল, কুণাল সচেতন ভাবে ধাক্কা দিতে চান এই ‘মূল্যবোধ’কে, তার রাজনীতিকে; রণবীর-সময় বলার সময় সম্ভবত খেয়াল করেন না যে, তাঁদের অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য শেষ অবধি কোথায় আঘাত করবে। তাঁরা সম্ভবত ভাবেন না যে, তাঁদের মন্তব্য ধাক্কা দেয় পরিবারের হেজিমনিক ক্ষমতাকাঠামোয়— এবং, গোটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের তাতে প্রবল প্রতিক্রিয়া হবে।
কিন্তু, কে সচেতন ভাবে আঘাত করতে চেয়েছেন, এবং কার ‘নির্বুদ্ধিতা’ ঘটনাক্রমে আঘাত করে ফেলেছে— রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া সেই ফারাক করে না। রাষ্ট্র প্রতিটি উপলক্ষকেই ব্যবহার করতে চায় এমন আঘাত করার বাক্স্বাধীনতাকে খর্ব করার কাজে। তাতে ক্ষতি উদারবাদীদের। কারণ, যে কথা আধিপত্যকামী রাষ্ট্রের পছন্দ নয়, সে কথা বলার তাগিদ শুধু উদারবাদীদেরই থাকে। এবং, সেই কারণেই, কুণাল কামরার বাক্স্বাধীনতার পক্ষে লড়া যতখানি জরুরি, বিয়ার বাইসেপস-এর পক্ষে লড়াও ঠিক ততখানিই— দ্বিতীয় জনের কথাটি নিতান্ত নির্বোধের মতো হলেও।
কেউ হাওয়ায় একটা সংশয় ভাসিয়ে দিতে পারেন— বিয়ার বাইসেপস-এর মতো আপাত-শাসকঘনিষ্ঠ ইউটিউবার যখন এমন একটি কথা বলেন, যা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকে বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার আরও একটা সুযোগ করে দেয়, তখন তা কি নেহাতই ঘটনাক্রমে ঘটে, না কি তার মধ্যে একটা সুপরিকল্পিত ছক রয়েছে? হতেই পারে, বিয়ার বাইসেপস বা অন্য কেউ, রাষ্ট্রশক্তিরই সুপরামর্শে, এমন একটি মন্তব্য করলেন, যা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হবে, এবং শেষ অবধি রাষ্ট্রের সুযোগ হবে বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে আরও এক কদম অগ্রসর হওয়ার। কিন্তু, তাতেই বা কী? কথাটা কে বলছেন, কেন বলছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, রাষ্ট্র তাঁকে কী প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ পাচ্ছে। সে সুযোগ যদি তারই তৈরি করে নেওয়া হয়, তবে কথাটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সুযোগ নেওয়াটা ঠেকানোই উদারবাদী রাজনীতির কাজ।
ঠিক এখানে এসেই ঠেকে যাচ্ছে ভারতের উদারবাদী রাজনীতি, নাগরিক সমাজ। সব প্রশ্নেই যেন আরও বেশি সাবধানি, আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠছে তার প্রতিক্রিয়া— ভাবটা এমন, যেন লোকে বলতে না পারে যে, উদারবাদ আসলে অনৈতিকতাকে রক্ষা করতে চায়, প্রশ্রয় দিতে চায়! আর, এ ভাবে আরও আরও সাবধানি হতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিচ্ছে মনুবাদী সমাজের নৈতিকতার মাপকাঠিকেই। শুধু স্ট্যান্ড-আপ কমেডির ক্ষেত্রেই তো নয়, সব ক্ষেত্রেই। এক বার থমকে দাঁড়িয়ে ভাবা প্রয়োজন।
ঠিক যেমন ভাবতে হবে যে, দুনিয়ার সব একাধিপত্যকামী শাসনই কি স্ট্যান্ড-আপ কমেডির ক্ষেত্রে একই রকম প্রতিক্রিয়া জানায়? বছর ছয়েক আগে হাউ টু লুজ় আ কান্ট্রি নামে একটা বই লিখেছিলেন তুরস্কের নির্বাসিত সাংবাদিক এচে তেমেলকুরান। লিখেছিলেন, তাঁর দেশে নাগরিকের হাসিকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেন না স্বৈরতন্ত্রী শাসক। ভারতের শাসকরা বারে বারেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, তাঁরা অন্য রকম— নাগরিকের হাসিতে তাঁদের এখনও ভয় করে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই ভয়টা আসলে গণতন্ত্রের।
দুনিয়ার বহু একাধিপত্যকামী শাসনের চেয়ে ভারত আলাদা, কারণ মরতে মরতেও এখানে গণতন্ত্র এখনও বেঁচে আছে— মানুষ চাইলে এখনও শাসকের গদি উল্টোতে পারে। এই অন্ধকারেও যদি উদারবাদী নাগরিক সমাজের কাছে আশার আলো থাকে, তবে তা এই গণতন্ত্রের প্রাণশক্তিটুকুই। তাকে ব্যবহার করতে হলে প্রাণপণে লড়ে যেতে হবে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ‘নৈতিকতা’র বিরুদ্ধে, মৌলিক অধিকারের পক্ষে।
কোন নাগরিকের অধিকার রক্ষা করতে লড়ছি, সে প্রশ্ন নিতান্তই গৌণ।