R G Kar Hospital Incident

কে ভাই কে দুশমন

আন্দোলনে শামিল হওয়া শহুরে মধ্যবিত্তদের সিংহভাগ অবশ্য সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার উপভোক্তা নন, তাই সরকারি হাসপাতালের দুর্নীতি কিংবা অদক্ষতা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:৪৩
Share:

Sourced by the ABP

অভিযোগ দু’টি, বাদী পক্ষও সংখ্যায় দুই। একটা অভিযোগ ধর্ষণ ও খুনের; অন্যটা দুর্নীতির। অল্পবয়সি চিকিৎসকরা মূল ফরিয়াদি; তাঁদের সঙ্গে শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা উল্লেখযোগ্য অংশও রাস্তায় নেমেছিল। তার উচিত-অনুচিত, অভিযোগ, তদন্তপদ্ধতি বা বিচার নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছে। সে আন্দোলন এখন অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে। এখন প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে কি আদৌ প্রভাবিত করবে? করলে, কী ভাবে?

Advertisement

অল্পবয়সি ডাক্তারদের সঙ্গে বেশ কিছু পরিণতবয়স্ক ডাক্তারও ছিলেন। তাঁদের সম্মিলিত ক্রোধ ও ঘৃণা যে প্রখরতায় নবীন সহকর্মীর ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে বর্ষিত হয়েছে, সেই একই তীব্রতায় তাঁরা অনেকে রাজ্যের বর্তমান সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিরুদ্ধে নানা রকম দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। অর্থাৎ চিকিৎসকদের কাছে ধর্ষণ-খুন এবং দুর্নীতি দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যে-হেতু এই দুইয়ের সঙ্গেই তাঁদের জীবন ও জীবিকা জড়িত।

আন্দোলনে শামিল হওয়া শহুরে মধ্যবিত্তদের সিংহভাগ অবশ্য সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার উপভোক্তা নন, তাই সরকারি হাসপাতালের দুর্নীতি কিংবা অদক্ষতা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। তাঁদের প্রধান অসন্তোষ সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি সফল মধ্যবিত্ত মেয়ের খুন ও ধর্ষণ নিয়ে। এই মেয়েটির সঙ্গে তাঁরা একাত্ম বোধ করছিলেন। তাঁদের নিজেদের পরিবারেও যে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, সেই চিন্তা তাঁদের মধ্যে রাগ, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছিল। আর জি কর-কাণ্ডের আগে ও পরে যে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনাগুলি গ্রাম ও মফস্‌সলের কম বিত্তশালী সমাজে ঘটেছে, সেগুলি নিয়ে শ্রেণি-সচেতন মধ্যবিত্তকে কোনও দিন পথে নামতে দেখা যায়নি। অবশ্য পথে-নামা মধ্যবিত্তের আর একটা উদ্দেশ্য ছিল— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে তাঁরা ঘোর অসন্তুষ্ট, তাই আর জি করের ঘটনাকে সামনে রেখে এই ক্ষুব্ধ নগরবাসীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ, একটা বড়সড় আন্দোলন খাড়া করতে চেয়েছিলেন।

Advertisement

যে কোনও আন্দোলনে সবার আগে ঠিক করতে হয় যে, শত্রুপক্ষ কে, আন্দোলনটা কার বিরুদ্ধে। চিকিৎসক শ্রেণি এবং আন্দোলনরত শহুরে মধ্যবিত্ত, দু’দলই আশা করেছিলেন, অচিরেই খুন-ধর্ষণের সঙ্গে দুর্নীতির একটা যোগসূত্র পাওয়া যাবে। আদালতে অভিযোগ করা যাবে যে, দুর্নীতি চাপা দিতেই খুন ও ধর্ষণ; এবং এর জন্য দায়ী সরকার-ঘনিষ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু ডাক্তার, সরকার যাঁদের আড়াল করছে। অর্থাৎ একেবারে সরাসরি সরকার এবং সরকার-ঘনিষ্ঠ কিছু ডাক্তারের বিরুদ্ধে আক্রমণের লক্ষ্য স্থির করা যাবে। বলা যাবে, ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ মানে ধর্ষক ও দুর্নীতিগ্রস্ত ডাক্তারদের শাস্তি দেওয়া; এবং যে সরকার এত দিন তাঁদের রক্ষা করেছে, তার আসল চরিত্রটা জনসমক্ষে তুলে ধরা। এই ধারণা নিয়ে দুই বাদী পক্ষ— ডাক্তার ও মধ্যবিত্ত— এক সঙ্গে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, কারণ তাঁদের লক্ষ্য মোটামুটি মিলে গিয়েছিল।

বাস্তবে ঘটনাগুলো অন্য রকম ঘটল। তদন্তের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা পুলিশকে সাত দিন সময় দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশে চার দিনের মাথায় তদন্তের ভার সিবিআইয়ের হাতে চলে গেল। তদন্ত কতটা এগোচ্ছে, সেটা তদারকি করার ভার গেল মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে, যার মধ্যমণি প্রধান বিচারপতি স্বয়ং। ফলে এ কথা আর বলার উপায় রইল না যে, কলকাতা পুলিশ আসল অপরাধীদের আড়াল করছে, বা ইচ্ছা করে তদন্তে দেরি করছে।

সিবিআইয়ের প্রাথমিক তদন্তে অবশ্য দুর্নীতির যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, এবং সেই প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে কয়েক জন দুর্নীতিগ্রস্ত চিকিৎসক গ্রেফতারও হয়েছেন। কিন্তু তিন মাস হয়ে গেল— সিবিআইয়ের তদন্ত থেকে এমন কোনও তথ্য এখনও উঠে আসেনি, যা থেকে বলা যায় যে, দুর্নীতিগ্রস্ত চিকিৎসকরা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ দুর্নীতির সঙ্গে ধর্ষণ-খুনের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠিত হল না। ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় কলকাতা পুলিশ যাকে গ্রেফতার করেছিল, এখন অবধি সিবিআই শুধু তার বিরুদ্ধেই কোর্টে অভিযোগপত্র জমা দিতে পেরেছে— কোনও চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় জড়াতে পারেনি। দুর্নীতি ও খুনের মধ্যে যদি ভবিষ্যতে কোনও যোগসূত্র পাওয়াও যায়, তত দিনে আন্দোলন তার গতি হারাবে।

অর্থাৎ, যে সব শহুরে মধ্যবিত্ত রাতদখল থেকে শুরু করে নানা কারণে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়লেন। ধর্ষকের ভূমিকায় তাঁরা এমন কাউকে দেখতে চাইছিলেন, যে সরকারের ঘনিষ্ঠ। সে রকম কাউকে পাওয়া গেলে ধর্ষকের সঙ্গে সঙ্গে সরকারকেও শূলে চড়ানো যেত। তদন্তে দেরি হচ্ছে বলে অবশ্য সিবিআই কিংবা সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু সিবিআই বা সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধাচরণে রাতদখলকারীদের রুচি নেই— তাঁদের শত্রু মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল। একই ভাবে সরকারি হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়েও তাঁরা নিরুৎসাহ রইলেন যে-হেতু সরকারি হাসপাতাল তাঁরা ব্যবহার করেন না। সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে শহুরে মধ্যবিত্ত আর জি কর-আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেন। ফলে এই আন্দোলন অনেক সঙ্কীর্ণ হয়ে গেল।

চিকিৎসকদের দলের সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিল— এক, দ্রুত বিচার চেয়ে সিবিআই-সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন; দুই, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। দ্বিতীয়টি চিকিৎসকদের জীবিকার সঙ্গে জড়িত, তাই মূলত এই দ্বিতীয় আন্দোলনেই তাঁরা তাঁদের সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করলেন এবং কিছুটা সফলও হলেন। স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সফলতা নিশ্চয় মূল্যবান। কিন্তু যে ব্যাপ্তি নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেটা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল।

উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তর বাইরে যে বিপুল সংখ্যক অল্পবিত্ত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন, তাঁদের কিন্তু আর জি কর-কাণ্ড তেমন ভাবে স্পর্শ করেনি। তাঁদের সমাজে নারী-নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন নতুন কিছু নয়। পেটের দায়ে তাঁদের মেয়েদের অনেককেই আলো ফোটার ঢের আগে কাজে বেরোতে হয়। অনেকেরই বাড়ি ফিরতে গভীর রাত হয়ে যায়। রাত্রির দখল তাঁরা অনেক দিন আগেই নিয়ে রেখেছেন। উপরন্তু সরকারি হাসপাতালে কর্মবিরতির ফলে তাঁরাই অসুবিধায় পড়েছিলেন, তাই নিয়ে ডাক্তারদের উপরে তাঁদের ক্ষোভও ছিল। এটা ঠিক ‌যে, ভবিষ্যতে সরকারি পরিষেবার উন্নতি হলে তাঁরাই লাভবান হবেন। সে দিক থেকে ডাক্তারদের আন্দোলনে তাঁদের সমর্থন থাকার কথা। কিন্তু দূর ভবিষ্যতের কথা ভাবার ক্ষমতা গরিব মানুষের, বিশেষ করে অসুস্থ গরিব মানুষের, নেই। বলা বাহুল্য, এই গরিব মানুষরাই তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক।

ডাক্তার ও মধ্যবিত্তর যৌথ আন্দোলনে স্পষ্টতই বাম প্রভাব ছিল। গণসঙ্গীত, পথনাটিকা, মশাল, স্লোগানের ধরন এবং সবার উপরে আন্দোলনকারীদের শরীরী ভাষা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে, সংস্কৃতিমান বাঙালি মধ্যবিত্তর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও বাম চিন্তার নিগড়ে বাঁধা। এই আন্দোলন থেকে যদি কারও সরাসরি রাজনৈতিক লাভ হয়ে থাকে, তা হলে সেটা বামেদেরই হওয়া উচিত। তবে সেই লাভ শহরে সীমাবদ্ধ। গ্রামবাংলার সঙ্গে বামেদের যোগাযোগ বহু দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেস এই আন্দোলনে মাথা গলায়নি, সম্ভবত ইন্ডিয়া ঐক্য টিকিয়ে রাখার তাগিদে। আর বিজেপিকে তো আন্দোলনকারীরা কাছেই ঘেঁষতে দেননি।

যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর জি কর-কাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা কোনও দিনই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটার ছিলেন না। উল্টো দিকে গ্রাম ও শহরের গরিব মানুষ, যাঁরা তৃণমূলের আসল ভোটার, আর জি কর-কাণ্ডে মোটের উপরে অবিচলিত ছিলেন। দুটোকে মেলালে বোঝা যাবে যে, আর জি করের ঘটনা তৃণমূলের আধিপত্যে সরাসরি কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না। কিন্তু পরোক্ষ ভাবে, কিছুটা হলেও, পারবে। আর জি কর-আন্দোলনের ফলে শহরাঞ্চলে বামেরা যদি কিছু ভোট বেশি পায়, তা হলে সেই ভোট আসতে হবে মূল বিরোধী দল বিজেপির সমর্থকদের থেকে। আর বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে গেলে তৃণমূলের আধিপত্য আরও বাড়বে।

অর্থাৎ, আর জি কর-কাণ্ডকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠল, শেষ বিচারে সেটা তৃণমূলকেই আরও শক্তিশালী করে তুলবে। এই কারণেই কি দিল্লির বিজেপি নেতারা আর জি কর নিয়ে মোটামুটি নীরব ছিলেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement