মাস ছয়েক আগের কথা। সদ্য মার্চ পেরিয়ে এপ্রিলের শুরু। রাজ্যে জোরকদমে বিধানসভা ভোট, তুঙ্গে প্রচার। তার পর? মারণ ভাইরাসের হামলায় দ্বিতীয় বারের জন্য থমকে গিয়েছিল গোটা দেশের হৃৎস্পন্দন।
মানুষকে দোষ দেওয়া মুশকিল। দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী যুক্তি-বুদ্ধির তোয়াক্কা না করে করোনা-শেষের বার্তা দিয়েছিলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী করোনাকে তালি-থালা দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে বলেছিলেন। নির্বাচন কমিশনও পাঁচ রাজ্যের ভোট ঘোষণা করে দিয়েছিল অনায়াসে। এই রাজ্যে নির্বাচন হয়েছিল আট দফায়, রাজ্যের ইতিহাসে প্রথম বার। সেই অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তের প্রভাবেই দলে দলে রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকরা বেরিয়ে পড়েছিলেন রাস্তায়। প্রাণ যায় যাক, গদি দখলে রাখতে হবে তো!
সেই একই সময়ে গুজরাতের হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্সের দীর্ঘ লাইন। উত্তরপ্রদেশে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে শ্মশানের চারপাশ। গুজরাতের এক শ্মশানে টানা সাত দিন নিরন্তর চুল্লি চালু থাকার জেরে গলতে শুরু করেছে কাঠামোর একাংশ। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে দেশের বাকি অংশের মানুষের পাশাপাশি এই রাজ্যবাসীও অনুভব করল সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত এবং মৃত্যু। দিকে দিকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের কাড়াকড়ি। হাসপাতালে শয্যা অপ্রতুল। প্রিয়জনের শেষকৃত্যের জন্য বিপুল লাইন শ্মশানে। চলছে অক্সিজেনের দেদার কালোবাজারি। তার পর সেই ভয়ঙ্কর ৭ মে, যে দিন গোটা পৃথিবীতে করোনার দৈনিক সংক্রমণে রেকর্ড গড়ল ভারত। এক দিনে করোনায় আক্রান্ত হলেন ৪ লক্ষ ১৪ হাজার ১৮৮ জন। ভোট মিটতেই ফের এক দফা লকডাউন।
ভাসমান লাশের পর গঙ্গা দিয়ে ইতিমধ্যে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। ক্রমশ নেমেছে করোনা সংক্রমণের গ্রাফ। সুতরাং, এই অক্টোবরে মোক্ষম সুযোগ পেয়েই কাতারে কাতারে মানুষ গা ভাসালেন পুজোর হুজুগে। চিত্তাকর্ষক পুজোবাহার দেখতে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন উৎসাহীরা। প্রাণ যায় যাক, এই সব মণ্ডপ এক বার চাক্ষুষ করা চাই-ই চাই। জীবদ্দশায় এ সুযোগ যদি আর না মেলে! জীবন থাকতে আনন্দে ঘাটতি? শুধু তো একটি মণ্ডপ নয়, গোটা কলকাতা জুড়েই দর্শনার্থীদের জনস্রোত দেখে মনে হয়েছে, মার্চ-এপ্রিল-মে’র দিনগুলির কথা সকলে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন।
কেউ বলতে পারেন, যাঁর ইচ্ছে তিনি আনন্দ করছেন, খামোকা সেই হুজুগে বাদ সাধা কেন! কেউ বলতে পারেন, এমনি এমনি তো করোনার প্রতিষেধক নিইনি, আর করোনাকে ডরাব কেন।
এই মানুষরা আরও এক বার মনে রাখেননি, করোনাভাইরাসে আপনি আক্রান্ত হলে হয়তো আপনি রক্ষে পাবেন, পাবেন না আপনার পাশের জন। তাই যাঁরা বিচার-বিবেচনা করেই এ বারেও ঘরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিংবা একেবারেই নিজস্ব পরিসরে পুজো কাটালেন, তাঁরাই হয়তো দাম গুনবেন যাঁরা বেরিয়ে পড়েছেন তাঁদের দুর্বুদ্ধির। অন্যের ভুলের জন্য আর কত বার খেসারত দেবেন তাঁরা। দুই ডোজ় টিকাপ্রাপকেরা কি জানেন না, টিকা সংক্রমণের সম্ভাবনা আটকায় না? কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা বার বার সাবধান করে বলেছিলেন, উৎসবের মরসুমে ভিড় এড়াতে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে হারে টিকাকরণ হয়েছে, শহরতলি, গ্রামগঞ্জের বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলেই কিন্তু টিকাকরণের হার তার থেকে অনেক কম। ফলে, মফস্সল বা গ্রামগঞ্জের মানুষ যখন প্রতিমা দর্শনের জন্য তিলোত্তমায় পাড়ি দিয়েছেন, তাঁরাও অজানতে পড়ে গিয়েছেন সংক্রমণের আওতায়। তাঁদের থেকে যে সেই অঞ্চল বা গ্রামেও ফের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল না, কে বলতে পারে এই মুহূর্তে।
সাধারণ মানুষের একাংশ বরাবরই হুজুগে। তাঁদের নিয়ন্ত্রণের জন্যই তো সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন পুলিশ-প্রশাসনের। হ্যাঁ, অষ্টমীর শেষ লগ্নে শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের বাঁধভাঙা ভিড়ে রাশ টানতে প্রশাসন সক্রিয় হয়েছে ঠিকই। মানুষের হিতে দেশপ্রিয় পার্কের পুজো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তড়িঘড়ি। ভিড় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যানজট নিয়েও কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল পুজো উদ্যোক্তাদের। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, অতিমারি পরিস্থিতিতে শ্রীভূমির ক্ষেত্রে কেন পুজোর ‘স্লগ ওভার’ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হল, বিশেষত চতুর্থী-পঞ্চমীর ভিড়ই যেখানে অশনিসঙ্কেত দিয়েছিল? যানজটের প্রসঙ্গ না হয় ঊহ্যই রইল।
বহু পুজো মণ্ডপেই হাই কোর্ট নির্দেশিত বিধি লঙ্ঘন হয়েছে। যে রাজ্যে এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে বন্ধ স্কুল-কলেজ, লোকাল ট্রেন, চলছে বিধিনিষেধ— সেখানে কোনও কোনও ক্রাউডপুলার প্যান্ডেলে জনস্রোত, মাস্কহীন বেয়াক্কেলের ভিড় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক পদক্ষেপে এত দেরি কেন!
পুজোর পিছনে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির জন্যই কি কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোলাচল প্রশাসনের? না কি আরও কিছু হিসাব রয়েছে এর পিছনে, যে হিসাবের অন্য দিকটা হল সাধারণ মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা— স্পষ্টতই যার তেমন দাম নেই আজ?