Budget 2025

চাকরি নেই, ক্রয়ক্ষমতাও নেই

চলতি অর্থবর্ষে মোট সরকারি ব্যয় বাজেট-ঘোষণার তুলনায় ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ছাঁটা হয়েছে, সরকারি মূলধনি বিনিয়োগ ছাঁটা হয়েছে ৯২,০০০ কোটি টাকার বেশি।

Advertisement

প্রসেনজিৎ বসু

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:১০
Share:

গত জুলাইয়ে, তৃতীয় মোদী সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী জোর দিয়েছিলেন যুবসমাজের কর্মসংস্থান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উপরে। প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত একটি প্যাকেজের অন্তর্গত পাঁচটি প্রকল্প ঘোষণা করে পাঁচ বছরে দুই লক্ষ কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়। অর্থমন্ত্রী দাবি করেন যে, এই প্যাকেজের মাধ্যমে পাঁচ বছরে চার কোটি যুবক-যুবতীর জন্য চাকরি এবং ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এ বছরের বাজেট-বক্তৃতায় কিন্তু সেই প্যাকেজের কোনও উল্লেখই নেই। গত বারের বাজেট-ঘোষণা কতখানি বাস্তবায়িত হল, সেই দলিলে বলা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রক বণিকসভা সিআইআই-এর সঙ্গে লগ্নি এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত একাধিক বৈঠক করেছে; এবং ‘এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেনটিভ’ প্রকল্পের একটি খসড়া ক্যাবিনেট নোট ‘চূড়ান্তকরণের স্তরে আছে’।

Advertisement

গত বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা জানিয়েছিল যে, ভারতের ক্রমবর্ধমান কর্মক্ষম যুবসমাজের কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করতে ২০২৪ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত অ-কৃষি ক্ষেত্রে প্রতি বছর ৭৮.৫ লক্ষ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে বা পিএলএফএস-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০.২%; স্নাতকদের মধ্যে এই হার ছিল ১৩%। সরকারি পরিসংখ্যান এও দেখাচ্ছে যে, অতিমারির পরের পাঁচ বছরে ভারতে নিয়মিত বেতনের কর্মসংস্থানের হার কমে গিয়ে কৃষি এবং অসংগঠিত স্বনিযুক্ত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্র থেকে সংগঠিত শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অভিবাসন হওয়ার পরিবর্তে সংগঠিত শিল্প থেকে কৃষি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অভিবাসন ঘটছে; অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা উল্টো দিকে ঘুরছে।

এ বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে যে, স্বনিযুক্ত ক্ষেত্রে কর্মরত পুরুষ-কর্মীদের গড় প্রকৃত আয় ২০১৭-১৮ সালে মাসিক ৯৪৫৪ টাকা থেকে কমে ২০২৩-২৪ সালে মাসিক ৮৫৯১ টাকায় নেমে এসেছে। নিয়মিত বেতনভুক পুরুষ-কর্মীদের গড় প্রকৃত মজুরিও ২০১৭-১৮ সালে মাসিক ১২৬৬৫ টাকা থেকে কমে ২০২৩-২৪ সালে হয়েছে ১১৮৫৮ টাকা। অর্থাৎ, চাকরির বাজারে উদ্বৃত্ত শ্রমের প্লাবন এবং খাদ্যদ্রব্যের চড়া মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভারতের আনুমানিক ৫৫ কোটি শ্রমজীবী জনগণের বহুলাংশেরই প্রকৃত আয় বা মজুরি সঙ্কুচিত হয়েছে। এর উপরে জিডিপি বৃদ্ধির হার গত আর্থিক বছরে ৮.২% থেকে ২০২৪-২৫’এ হয়েছে ৬.৪%, যার ফলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির গতিও মন্থর হয়েছে, চলতি অর্থবর্ষে কেন্দ্রের কর রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় অর্থমন্ত্রী গত বাজেটে ঘোষিত ব্যয়বরাদ্দে বিপুল কাটছাঁট করেছেন।

Advertisement

চলতি অর্থবর্ষে মোট সরকারি ব্যয় বাজেট-ঘোষণার তুলনায় ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ছাঁটা হয়েছে, সরকারি মূলধনি বিনিয়োগ ছাঁটা হয়েছে ৯২,০০০ কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য, শক্তি, পরিবহণ এবং স্বাস্থ্য দফতরের চলতি বছরের বাজেট-বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে জল জীবন মিশন-এর ২০২৪-২৫’এর বরাদ্দে ছাঁটা হয়েছে ৪৭,০০০ কোটি টাকা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ছাঁটা হয়েছে ৩৮,০০০ কোটি টাকা। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের বাজেট-বরাদ্দে গত বছর থেকেই কাটছাঁট শুরু হয়েছে। চলতি অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনি বিনিয়োগ এবং জনকল্যাণ খাতে ব্যয়বরাদ্দে এই কাটছাঁটের নেতিবাচক প্রভাব বেসরকারি বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের উপরে পড়তে বাধ্য, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে।

এই ব্যয় সঙ্কোচনের কুপ্রভাব এড়াতে অর্থমন্ত্রী পরবর্তী অর্থবর্ষ (২০২৫-২৬) থেকে আয়করদাতাদের জন্য কিছু ছাড় ঘোষণা করেছেন। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এর ফলে আয়কর আদায়ে ১ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে। আয়কর বিভাগের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে যে ৭.৫ কোটি ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্ন দাখিল করা হয়েছিল, তাতে শূন্য করদাতাদের সংখ্যা ৪.৭ কোটি। অর্থাৎ এই বাজেটে আগামী বছরের জন্য ঘোষিত আয়কর ছাড়ের সুবিধা পাবেন শুধুমাত্র ২.৮ কোটি আয়করদাতা। এই সংখ্যা ভারতের বেতনভুক শ্রমজীবীদের মোট সংখ্যার মাত্র ২২%। দেশের অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষের কাছে এই আয়কর ছাড়ের কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। বরং পেট্রল-ডিজ়েলের উপরে উৎপাদন শুল্ক কমিয়ে জ্বালানির দাম কমাতে পারলে শ্রমজীবীদের সকল অংশই উপকৃত হতে পারতেন। সার্বিক দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে জিএসটি-র হারও কমানো যেত।

কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একশো দিনের কাজের কর্মীদের গড় দৈনিক মজুরি ২০১৯-২০’তে ছিল ২০০ টাকা, সেটা ২০২৪-২৫’এ এসে দাঁড়িয়েছে ২৫২ টাকায়। অথচ কৃষিকাজে অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এখন দৈনিক ৪৫২ টাকা। আয়করদাতাদের দেওয়া ১ লক্ষ কোটি টাকার ছাড়ের একটা ভগ্নাংশও যদি একশো দিনের কাজের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রামোন্নয়ন খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানো যেত, সে ক্ষেত্রে দেশের বাজারে ভোগব্যয়ের চাহিদা অনেক বড় পরিমাণে বৃদ্ধি পেত।

সর্বশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, কী ভাবে শেয়ার বাজারের সূচক নিফটি-র তালিকাভুক্ত শীর্ষ ৫০০ সংস্থার কর-পরবর্তী মোট মুনাফা ২০১৯-২০ সালে ৪.৩২ লক্ষ কোটি টাকা (দেশের জিডিপির ২.১%) থেকে চার বছরে তিন গুণের বেশি বেড়ে ২০২৩-২৪’এ হয়েছে ১৪.১২ লক্ষ কোটি টাকা (জিডিপির ৪.৮%)। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী কর্পোরেট করের হার এক ধাক্কায় কমিয়ে দেওয়াতেই বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলি এই বিপুল মুনাফা করতে পেরেছে। অথচ, কর্পোরেট ক্ষেত্রে কর্মীদের মাইনে বৃদ্ধির হার মুনাফা বৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম।

গত চার-পাঁচ বছরে মুনাফার এই বিপুল বৃদ্ধি কিন্তু বর্ধিত বা কর্মসংস্থানে পরিণত হয়নি। বরং, শেয়ার বাজারের সূচকগুলি অতি দ্রুত ঊর্ধ্বগামী হয়েছে। অথচ এই অভিজ্ঞতা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও শিক্ষাই নেয়নি। ২০২৫-এর কেন্দ্রীয় বাজেট এক দিকে মূলধনি বিনিয়োগ এবং জনকল্যাণ খাতে ব্যয়সঙ্কোচ করে বাজেট-ঘাটতি কমাতে চাইছে, আর অন্য দিকে আয়কর কাটছাঁটের মাধ্যমে অর্থনীতিতে ভোগব্যয়ের চাহিদা বাড়াতে চাইছে। এর ফলে দেশের বাজারে সার্বিক চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করছেন। এই পরিবেশে ভারতের পক্ষে রফতানি বাড়িয়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটানো খুবই কঠিন। তদুপরি, ভারতের ঘরোয়া বাজারেও যদি চাহিদা না-বাড়ে, সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী হবে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শ্রমজীবী জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন অধরাই থেকে যাবে। ২০২৫-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে মোদী সরকারের অর্থনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানের অভাব প্রকট।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement