Language of Protest

প্রতিবাদের আন্তর্জাতিক সুর

এ বারের আন্দোলন যখন মাঝপথে, সেই সময় ইউরোপের কয়েকটি দেশে নানা শহরে বিষয়ভিত্তিক প্রতিবাদ দেখেছি। যেমন রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বা ইজ়রায়েলের গাজ়া আক্রমণের প্রতিবাদ।

Advertisement

প্রবালকুমার বসু

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:৩২
Share:

বাঙালি জাতি হিসেবে স্বপ্ন দেখা ভুলেই গিয়েছিল। সেই কবে, গত শতকের ষাটের দশকে কিছু বাঙালি যুবক সমাজ পাল্টানোর স্বপ্নে একটা আন্দোলন শুরু করতে চেয়ে নৈরাজ্যের পথে চলে গিয়েছিল, তার পর থেকে বাঙালির জাতি হিসেবে শুধুই আত্মক্ষয়ের বিবর্তন। নিজ নিজ প্রকোষ্ঠে এমন এক জীবনের যাপন, যেখানে কোনও বৃহত্তর স্বপ্ন নেই। দীর্ঘ বাম শাসনের অবসান ঘটাতে যে সুশীল সমাজ এগিয়ে এসেছিল তা সার্বিক হয়নি কেননা তার উৎস ছিল রাজনৈতিক চিত্রপটে। আর জি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঙালি যেন আবার জেগে উঠল, স্বপ্ন দেখল, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল।

Advertisement

এ বারের আন্দোলন যখন মাঝপথে, সেই সময় ইউরোপের কয়েকটি দেশে নানা শহরে বিষয়ভিত্তিক প্রতিবাদ দেখেছি। যেমন রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বা ইজ়রায়েলের গাজ়া আক্রমণের প্রতিবাদ। ইউরোপের এই আন্দোলন আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না। জার্মানির কোলন শহরে গত বছরও দেখেছি, বিপুল সংখ্যক মানুষ ইউক্রেন আক্রমণের প্রতিবাদে ফেস্টুন নিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে রেল স্টেশনের পাশে গির্জা চত্বর থেকে একটু দূরে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন। কারও কারও হাতে প্রতিবাদের ছোট ফেস্টুন। অবাক হয়েছিলাম দেখে, ওঁদের মুখে চিৎকার করে স্লোগান নেই; কারও কারও হাতে গিটার, তাঁরা গান গাইছেন। জার্মান ভাষা বুঝি না, সফরসঙ্গী অর্থ বুঝিয়ে দিলেন। শুনে মনে হল, এ তো আমাদের প্রতিবাদের গানের মতো, অনেকটা মিল সলিল চৌধুরীর সুরের সঙ্গে।

এই প্রতিবাদী মানুষদের রাজনৈতিক বিশ্বাস যা-ই হোক, তাঁরা সেই মুহূর্তে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ছিলেন না। প্রতিবাদে হাজির ছিলেন আপন বিশ্বাসের তাগিদে। রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছে, বা ইজ়রায়েল গাজ়ায় সাধারণ মানুষ মেরে ফেলছে, তাতে জার্মানদের কী? বৃহত্তর মানবিক স্বার্থ তাঁদের কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই বৃহত্তর মানবিকতার জায়গা থেকেই আজকের জার্মানি দরজা খুলে দিয়েছে ইউক্রেনের শরণার্থীদের জন্য। শুধু জার্মানিতে থাকার অনুমতিই নয়, প্রতিটি শরণার্থী পরিবারকে সদস্যসংখ্যা অনুযায়ী ভাতাও দিচ্ছে সরকার। তার পরিমাণ নেহাত কম নয়, মাসে দুই থেকে সাড়ে তিন হাজার ইউরো পর্যন্ত। এতে কিছু জার্মান নাগরিকের মধ্যে যে ক্ষোভ জমছে না তা নয়, চরম দক্ষিণপন্থীরা এই পরিস্থিতি থেকে রাজনৈতিক লাভ তুলে নিতেও সচেষ্ট। তবু পীড়িতের পাশে জার্মানরা স্বেচ্ছায় দাঁড়িয়েছেন।

Advertisement

স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভায় এক তরুণের সঙ্গে আলাপ। তাঁর কাজ আগ্রহী পর্যটকদের পায়ে হেঁটে ব্রাতিস্লাভা দেখানো, শহরের ইতিহাস সম্পর্কে বাইরে থেকে আসা মানুষদের অবহিত করা। অন্যান্য দেশ সম্পর্কেও তিনি বেশ ওয়াকিবহাল, এই মুহূর্তে কলকাতায় কী হচ্ছে তা জানেন। বললেন, তোমাদের এই আন্দোলনের ধরনটা অনেকটাই ইউরোপিয়ানদের মতো, গান গাওয়া, কখনও মৌনী মিছিল। ১৯৮৯ সালে স্লোভাকরা রুশ কমিউনিস্ট শাসন থেকে বেরিয়ে আসার বার্তা দিতে ওঁদের টাউন স্কোয়ারে জমায়েত হয়ে ঘণ্টা বাজাতেন, রোজ। আজকের স্লোভাক তরুণেরা বিশ্বাস করেন, বদল আনার জন্য রক্তপাত অপরিহার্য নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এ-ও জানালেন, তোমরা যে কারণে আন্দোলন করছ, আমরা কিন্তু সেগুলো স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আমাদের এখানেও দুর্নীতি আছে, কিন্তু তা খাদ্য, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য স্পর্শ করে না। মনে হল, সত্যিই তো, আমাদেরও আন্দোলনের ধরন, প্রতিবাদের ধরন পাল্টেছে। বাংলার তরুণরা চোখে চোখ রেখে কিন্তু সংযমের সীমারেখা অতিক্রম না করে প্রতিবাদ করতে শিখেছে। সেটাই জোগান দিয়েছে সমাজের নানা স্তরে আত্মবিশ্বাসের।

২০০৩-এ ইরাক আক্রমণের আগে আগে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র)-এর মনে হয়েছিল, এ রকম একটা সিদ্ধান্তের জন্য চিন্তাশীল সমাজের সমর্থন প্রয়োজন। একশো জন কবি লেখক বুদ্ধিজীবীকে হোয়াইট হাউসে চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানান তিনি। আমন্ত্রিতদের মধ্যে স্যাম হ্যামিল নামে এক কবির মনে হয়েছিল, এই সভাটাই প্রতিবাদে পাল্টে দিলে কেমন হয়? তিনি বাকিদের মেল করে জানালেন তাঁর ভাবনা। সকলেই রাজি। ঠিক হল, সবাই একটা করে কবিতা পড়ে জানাবেন প্রতিবাদ। আমেরিকান গোয়েন্দা বিভাগ এই মেল-চালাচালি জানতে পেরে যায়। নির্ধারিত দিনের আগের দিন সবার কাছে একটা মেল আসে, আমন্ত্রণ বাতিলের সংবাদ-সহ। আমন্ত্রিতরা দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলালেন। তাঁরা নির্ধারিত দিনেই জড়ো হলেন হোয়াইট হাউসের সামনে, পাঠ করলেন কবিতা, যেখান থেকে ‘পোয়েটস এগেনস্ট ওয়র’ নামে এক বৃহৎ আন্দোলনের সূত্রপাত।

স্যামকে প্রশ্ন করেছিলাম, কবিদের আন্দোলন বা সক্রিয়তা কি ইরাক আক্রমণ আটকাতে পারল? স্যাম বলেছিলেন, রাষ্ট্রকে আটকানো কবিতার কাজ না। কিন্তু কবিতা বা শিল্প সচেতনতা তৈরি করতে পারে, যাতে ভবিষ্যতে আগ্রাসনের আগে রাষ্ট্র আরও এক বার ভাবে, যা করছে ঠিক করছে কি না। আমরা শাসকের সব কাজ-কারবার দেখেশুনেও মুখ ফিরিয়ে ছিলাম আর মনের মধ্যে জমাচ্ছিলাম ক্ষোভ, হতাশা। সেই স্তূপে অগ্নিসংযোগ করলেন তরুণ প্রজন্মের ক’জন। তাঁদের স্বপ্ন চারিয়ে গেল সাধারণ মানুষের মধ্যেও। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের সুরে এসে মিলল আমাদের প্রতিবাদের সুর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement