ষাট বছর হতে চলল প্রায়। এতটা সময় পরেও একের পর এক দৃশ্য জুড়ে দর্শক সোৎসাহে হাততালি দিয়ে উঠছেন, এমন মুহূর্তের সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য বড় একটা ঘটে না। ১৯৬৬ সালের নায়ক ২০২৫-এ নতুন করে মুক্তি পাওয়ার সুবাদে তেমনটা ঘটে গেল।
মুহূর্তটা একটু তলিয়ে ভাবার মতো। নায়ক এমন একটা ছবি, যা তুলনামূলক ভাবে বেশি পরিচিত, বেশি বার সম্প্রচারিত। টেলিভিশনে, ওটিটি-তে, ইউটিউবে— ছবিটি একাধিক বার দেখেননি, দেখে দেখে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেননি, বাংলা ছবির দীক্ষিত দর্শকের মধ্যে এমন কেউ প্রায় নেই বললেই চলে। বস্তুত পুনর্মুক্তির এই সুযোগে ছবিটি যাঁরা নতুন করে বড় পর্দায় দেখতে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম বার ছবিটি দেখছেন, এমন সংখ্যা নিশ্চিত ভাবেই হাতেগোনা। বরং ছবিটি দেখে দেখে মুখস্থ করে ফেলাদের ভিড়ই বেশি। তৎসত্ত্বেও তাঁরা যে ছুটে যাচ্ছেন, বড় পর্দার টানেই যাচ্ছেন। সত্যজিৎ রায় আর উত্তমকুমারের যুগলবন্দি বড় পর্দায় চাক্ষুষ করতে চাইছেন বলেই যাচ্ছেন। অতি পরিচিত ছবিও যে আলাদা করে বড় পর্দায় দেখা প্রয়োজন, এই বোধটা কাজ করছে বলেই যাচ্ছেন।
সিনেমা-সাক্ষরতার দিক থেকে বিচার করলে এ আশার কথা। নইলে দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে টেনে আনার তাগিদে বেশ কিছু দিন ধরে ‘মাস মুভি’ নামক একটি গোত্রের উত্থান চোখে পড়ছে। সেখানে বড় পর্দার উপযোগিতা প্রমাণের দায়ে সব কিছুই খুব বড় করে দেখানোর চল এসেছে— বৃহৎ ঘটনাবলি, বৃহৎ চরিত্র, বৃহৎ প্রযুক্তি, বৃহৎ সংঘর্ষ, বৃহৎ (?) বার্তা...। উচ্চতারের অভিনয়, উচ্চগ্রামের শব্দানুষঙ্গ, ততোধিক উচ্চগামী অস্মিতার সিংহনাদে দর্শক থরহরিকম্প! ফের সেই সত্যজিৎকে উদ্ধৃত করেই বলতে ইচ্ছা করে, কী দাপট! সেই সর্বব্যাপী দাপটের যুগেও মানুষ গাঁটের কড়ি খরচ করে নায়ক দেখতে ছুটছেন, সেটা ভরসার কথা বইকি!
এই ভরসাকে পুঁজি করেই পুনরবলোকনের এই লগ্নটি কিছু ভাবনার জন্ম দেয়। পুনঃপাঠের অভিজ্ঞতাও যে কী প্রবল ভাবে কাল-নির্ধারিত, অনুভব করে শিহরন জাগে। মূলধারার জনপ্রিয় ছবি বরাবরই বেশ খানিকটা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। কিন্তু সেই চেনা ছককেও প্রভূত পরিমাণে ছাপিয়ে গিয়ে নতুন ধারার যে ব্লকবাস্টার ইদানীং জাঁকিয়ে বসছে, সেটা চরিত্রগত ভাবে অনেকখানি আলাদা। পাশ্চাত্যের বেশ কিছু সমালোচক এই প্রবণতাটিকে আলাদা ভাবে নজর করেছেন। তাঁরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, এই নবগোত্রীয় নির্মাণে সিনেমা তৈরি করার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তথাকথিত ‘সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স’ তৈরি করা। ওটিটি আসার পরে সিনেমা দেখার গড়ন-ধরন গিয়েছে বদলে। সেটা ক্রমশ ব্যক্তিকতার গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এই ব্যক্তিকতার গণ্ডি আরও কী করে সম্প্রসারিত হয়, সেই চিন্তাভাবনা জোরকদমে চলছে। দর্শককে স্রেফ দর্শকের আসনে না রেখে কী ভাবে সিনেমার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যায়, তার হরেক ফিকির বার করা হচ্ছে। যেমন দর্শক হয়তো একটা জঙ্গলের দৃশ্য শুধু দেখবেন না, নিজেকেই সেই জঙ্গলের মধ্যে অনুভব করবেন। এমনকি বাঘের গায়ের গন্ধও পেতে পারেন। তার পর ধরা যাক, কৃত্রিম মেধা আর ডেটা অ্যানালিটিক্স দিয়ে গল্পের গতিবিধি নির্ধারণ করে নেবেন দর্শকই। দর্শক যদি চান, ‘বাবুমশাই, জ়িন্দগী বড়ী হোনী চাহিয়ে, লম্বী নহী’ বলার পরেও ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’ বলে আনন্দ উঠে বসবে।
এর উল্টো পিঠে যাঁরা দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে আনতে চান, তাঁরা ‘এ জিনিস বাড়িতে পাবেন না’ বলে হাঁক ছেড়ে কী করে সিনেমাকে আরও অতিকায় করে তোলা যায়, সেই দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এই দুই বিপরীতধর্মী প্রবণতার ফাঁক গলে মোটামুটি তিনটি নতুন ঝোঁক দর্শকদের একাংশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, অতিমারির প্রকোপ কাটার পরে পৃথিবী জুড়েই যৌথতার উদ্যাপন বেশ বেড়েছে। ফলে প্রেক্ষাগৃহে সকলের সঙ্গে ছবি দেখার একটা টান জন্মেছে নতুন করে। দ্বিতীয়ত, মূলধারার ছবি প্রধানত ওটিটি-ধর্মী আর অতিকায়-ধর্মীতে ভাগ হয়ে গিয়ে বাদ পড়ে যাওয়া আরও নানা ধরনের গল্পের একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। ফলে ভিন্ন স্বাদের চাহিদাও একেবারে অপ্রতুল নয়। তৃতীয়ত, সাবেক চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যত বেশি করে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিচ্ছে, তারই পাশাপাশি তাকে ঘিরে একটা নস্টালজিয়াও দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সাবেক ছবি সাবেক ভাবে দেখার খিদে তৈরি হচ্ছে। পশ্চিমের দেশগুলিতেও রেপার্টরি সিনেমা অর্থাৎ বড় পর্দায় পুরনো ছবির শো ঘিরে আগ্রহ বাড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটকে মাথার মধ্যে রেখে যখন পুনর্বার নায়ক-এ ফিরি, এক চিত্রতারকার আত্মবীক্ষণের মধ্য দিয়ে সিনেমার এক কালখণ্ডের যাত্রাপথ যেন ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হচ্ছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে মুকুন্দ লাহিড়ীর সঙ্গে অরিন্দমের সংঘাত যেন এক বৃহত্তর ইতিহাসের ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে। প্রথম দিনের শুটিংয়ে তিনি অরিন্দমকে দাবড়ানি দিতে গিয়ে একটা কথা বলেন, কণ্ঠস্বরটা অবহেলা করার জিনিস নয়। ওই দৃশ্যটিতে এই বাক্য প্রাচীন এবং নবীন অভিনয়শৈলীর দ্বন্দ্বের অধিক কিছু বলে মনে হয় না তৎক্ষণাৎ। কিন্তু যে দৃশ্যে বৃদ্ধ মুকুন্দ কর্মপ্রার্থী হয়ে ফিরে আসেন অরিন্দমের কাছে, সে দিন ওই কথাটির অন্তর্নিহিত ব্যাপ্তি আবিষ্কার করার সুযোগ ঘটে। মুকুন্দ বলে চলেন, প্রথম ছবি করেছিলেন ১৯২৩ সালে। অর্থাৎ নির্বাক যুগ। প্রথম দিকে খুব সুবিধা করতে পারেননি, সে কথাও গোপন করেন না। কিন্তু পট বদলাল কিছু দিনেই। ছবি সবাক হল। মুকুন্দর এ বার তুরুপের তাস হয়ে দাঁড়াল তাঁর ভরাট কণ্ঠ। “ভয়েস...আই ওয়েন্ট টু দ্য সামিট!”
তার পর দু’দশক কাটল। যে জোরালো স্বরক্ষেপ এক দিন তাঁকে রাজা করেছিল, মৃদু উচ্চারণের অরিন্দমকে এক দিন তাঁর সেই সিংহাসন কেড়ে নিতে উদ্যত বলে দেখলেন তিনি। তড়পালেন, কিন্তু কালের গতি রুখতে পারলেন না। তারিণীখুড়োর ‘জুটি’ গল্পটি এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যেতে পারে। রতনলাল রক্ষিত আর শরৎ কুণ্ডু— নির্বাক ছবির জনপ্রিয় কমিক শিল্পীদ্বয়। টকি আসার পরে রতন টিকে গেলেন সুকণ্ঠের জোরে, বাতিল হয়ে গেলেন শরৎ। মুকুন্দর কাহিনি এগিয়ে গেল এরও পরের পর্বে। তিনি যখন কাজ ফিরে পেতে মরিয়া, অরিন্দম বলে, “আপনি কি কাজ করতে পারবেন? আপনাকে দেখে ভাল লাগছে না মুকুন্দদা।” মুকুন্দ আবারও আর্ত স্বরে বলে ওঠেন, “ভয়েস? ভয়েস?” তিনি যেন বিশ্বাস করতে অপারগ, তাঁর অস্ত্রে মরচে ধরেছে। কাশির দমকে তাঁর গলা বুজে আসে। আর অরিন্দম মনে করিয়ে দেয়, “শুধু ভয়েস দিয়ে কি চলে?”
অথচ নির্বাক থেকে সবাকে উত্তরণের যুগে অভিনেতাদের সাফল্যের মাপকাঠি অনেকাংশেই ছিল ‘ভয়েস’। বহু অভিনেতারই সে সময় বিনিদ্র রজনী কেটেছে ভয়েস টেস্ট উতরোনোর চিন্তায়। ধীরাজ ভট্টাচার্যের স্মৃতিলিখন (দ্রষ্টব্য যখন নায়ক ছিলাম) বলছে, “ফেল! ফেল করলাম ভয়েস টেস্ট-এ। একা আমি নই, অনেকেই। অহীনদা, নরেশদা, গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, আরও ছোটখাটো অনেকে। ফুল মার্ক পেয়ে পাস করলেন দুর্গাদাস আর জয়নারায়ণ মুখুজ্যে। মেয়েদের সবাই পাস। ভীষণ দমে গেলাম। সবাক ছবির শুরুতেই এ রকম অবাক হব ভাবতেও পারিনি। যোগেশ চৌধুরীর ‘সীতা’ নাটকে রামের পার্ট বহুবার সুখ্যাতির সঙ্গে অভিনয় করেছি দেশে। তা থেকে একটা ইমোশনাল সিন অভিনয় করলাম নিষ্ঠুর মাইক্রোফোনের সামনে, কিছুই হল না। ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম নির্বাক গিরিবালা, কাল-পরিণয়ের সমস্ত নামযশ নিঃশেষে ধুয়ে মুছে দেবে নাকি ঐ এক ফোঁটা মাইক্রোফোন?”
মুকুন্দ লাহিড়ী এক কালে জানতেন, গলার জোর মহার্ঘ বস্তু। কিন্তু অরিন্দম নায়ক হিসেবে উঠে আসছে আরও দু’দশক পেরিয়ে। অভিনয়ের রীতি তখন নতুন বাঁক নিচ্ছে, এ বার মুকুন্দদের ঝরে যাওয়ার সময়। প্রথম দিন শুটিংয়ে মুকুন্দ যে ‘হলিউড স্টাইল’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন, অরিন্দম বাস্তবিক সেই স্টাইলের অনুসারী। ব্র্যান্ডো, বোগার্ট, পল মুনি তার আদর্শ। এই নামগুলো উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সত্যজিৎ অরিন্দমের উত্থানপর্বকে মোটামুটি ভাবে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি স্থাপিত করেন, যে সময়টা আদতে উত্তমেরও উত্থানপর্ব। সিনেমার উপযোগী অভিনয়রীতি সম্পর্কে যে সব কথা তিনি অরিন্দমের মুখে বসান, অনুমান করা চলে যে, সেগুলো অরিন্দমরূপী উত্তমের মুখে মানানসই বলে নিঃসংশয় ছিলেন তিনি। অরিন্দম এ ছবিতে শুধু সিনেম্যাটিক অভিনয়ে পারদর্শী নায়ক নয়— তার নায়কত্বের সাফল্য নির্মিতই হয়েছে ওই পরিমিত অভিনয়রীতি আত্মস্থ করার জোরে। সুতরাং উত্তমকে ভেবে এই চরিত্র যখন লিখছেন সত্যজিৎ, তিনি শুধু একটি চরিত্রই লিখছেন না। বাংলা ছবিতে উত্তমের অনন্য সাফল্যের এক বিশ্লেষণ তার মধ্যে ধরা থাকছে। কর্মহীন মুকুন্দর যে মরফিয়া-আসক্তির কথা অরিন্দমের সংলাপে, সেও সে যুগে বেশ চালু ঘটনা। রবীন মজুমদারের উদাহরণ মনে পড়তে পারে।
একুশ শতকের সিকি ভাগে সিনেমার খোলনলচে যখন আবার বদলে যাচ্ছে, তখন ছবির মধ্যেই নিহিত থাকা ছবির ইতিহাসের এই সব দিকচিহ্ন অমোঘ হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায়, বীরেশ্বর সেনের চিত্রপঞ্জিতে নায়ক-ই শেষ ছবি। বীরেশ্বর সেন— মুকুন্দ লাহিড়ীর চরিত্রাভিনেতা।