বঞ্চিত: চা শ্রমিক এবং রাজনৈতিক কর্মীরা জলপাইগুড়িতে আঞ্চলিক পিএফ অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। ডিসেম্বর, ২০২২
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি...।” এমন দেখা কি কেবল প্রেম-জাগানিয়া মানুষটির সঙ্গেই হয়? হতে পারে রাষ্ট্র আর তার নাগরিকেরও। কার্তিকের ভরা খেতে, কিংবা ভাঙা ঘরের হিমে বসে হঠাৎ মনে হতে পারে, এ কি সেই দেশ, যাকে আগে দেখেছি? এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে তেমন একটা বছর কুড়ির চক্র ঘুরে এল এই জুলাই মাসে।
৭ জুলাই ২০০৪, গুরুদাস দাশগুপ্ত সংসদে বলেছিলেন, এমপ্লয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিসে (ইপিএফও) এক রিপোর্ট দাখিল হয়েছে, যা সংস্থা গোপন করছে। তাতে বলা হয়েছে, অন্তত দেড় কোটি কর্মী সঞ্চিত টাকা পাচ্ছেন না। অথচ, ইপিএফও-র কাছে আট হাজার কোটি টাকা জমা পড়ে আছে। এ ভাবে মানুষের টাকা খেয়ে ফেলছে শ্রম দফতর আর ইপিএফও। কী করছে সরকার? উত্তরে ১৯ জুলাই সরকার জানায়, ইপিএফ আইন লঙ্ঘনের জন্য ৪৯,৭৫০টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে, ৫৪৫টি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। ফাঁকি আটকাতে আইনে নানা পরিবর্তন আনা হবে।
২০২৪ সাল। শ্রমিকের না-পাওয়া সঞ্চয়ের পরিমাণ সে দিনের আট হাজার কোটি টাকা থেকে আজ আটান্ন হাজার কোটি টাকা। টাকার অপেক্ষা করতে করতে কত কর্মী মারা গিয়েছেন এই কুড়ি বছরে, সে হিসাব কেউ রাখেনি। কী করে এই বিপুল টাকা লাগানো যায় শ্রমিক কল্যাণে, তারও কোনও রূপরেখা প্রকাশ করেনি সরকার।
বকেয়া পিএফ উদ্ধারই বা হবে কী করে? তার অঙ্ক কুড়ি বছরে ৭৮১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পনেরো হাজার কোটি টাকা। মাইনে থেকে পিএফ কাটা হচ্ছে অথচ তা জমা পড়ছে না, বহু কর্মী টের পান না। কেবল দিনমজুর, ঠিকামজুর নন, সাংবাদিক, অধ্যাপক থেকে বিমানচালক, কে না প্রতারিত হয়েছেন? জেট এয়ারওয়েজ়-এর আন্তর্জাতিক বিমানচালকেরা জানতেন না, ২০০৩-০৬ সময়কালে তাঁদের বেতন থেকে টাকা কাটা হলেও পিএফ তহবিলে জমা পড়েনি। সিবিআই সাড়ে তিন কোটি টাকা তছরুপের দায়ে সংস্থার তেরো জন তৎকালীন কর্মী এবং ইপিএফ অফিসের দুই আধিকারিককে অভিযুক্ত করে। ইতিমধ্যে বিমান সংস্থাটির মালিকানা বদল হয়েছে।
তবে চটকল বা চা বাগানের মজুরদের কপালে এমন নিষ্পত্তি বিরল। ইপিএফও-র বার্ষিক রিপোর্ট রাষ্ট্র ও কর্মীর সম্পর্কের ছবি আঁকে সংখ্যায়। ২০২২-২৩ সালে প্রায় চার হাজার ফৌজদারি মামলা হয় পিএফ ফাঁকির। মাত্র সাঁইত্রিশটিতে পুলিশ আদালতে চালান জমা দিয়েছে। এই হল ভারতের ছবি। রাজ্যের ছবি আরও ধূসর। বছরের পর বছর পিএফ, পেনশন ফাঁকির মামলায় শাস্তির হিসাব লেখা হয়েছে একটি সংখ্যায়— শূন্য। কেবল ২০২১-২২ সালে এক জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
এই সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত, নিয়ম কঠোর না করে শিথিল করাই ভাল। শ্রম কোডের প্রস্তাব, পিএফ ফাঁকির অভিযোগ খতিয়ে দেখে দিল্লির প্রধান দফতর অনুমোদন দিলে তবে আঞ্চলিক দফতর পরিদর্শনে যেতে পারবে। বাস্তবে পরিদর্শনের হাল কী, তা অবশ্য কেউ বলে না। শ্রম দফতরের এক আধিকারিক জানালেন, দুর্গাপুরে রয়েছে শ্রম কমিশনারের দফতর, কিন্তু বর্ধমানের কোনও চালকলে শ্রমিকদের পিএফ দেওয়া হয় না। হোটেল, হলিডে হোম, রিসর্ট, ধাবার অধিকাংশ কর্মী পিএফ-এর আওতার বাইরে। কে কাকে ধরবে? ১৯৭৩ সালে সংসদ আইন পাশ করেছিল যে, পিএফ কাটার পর সে টাকা জমা না দিলে দোষীর তিন মাস থেকে ছ’মাস জেল হবে। পঞ্চাশ বছরে এ দেশে পঞ্চাশ জনও সাজা পাননি। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে— পিএফ বকেয়া রাখার জন্য জরিমানা (পেনাল্টি) এ বছরেই কমিয়ে করা হয়েছে মাসে বকেয়ার মাত্র এক শতাংশ, তা সে যত দিনই বাকি থাক। আগে ছিল বিলম্বের সময় অনুসারে পাঁচ শতাংশ থেকে পঁচিশ শতাংশ।
এ কি দুর্নীতির ছাড়পত্র? সরকারের যুক্তি, জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে কী মিলেছে, মামলা ছাড়া? তার চাইতে সংলাপ-সমঝোতায় টাকা আদায় হোক। ধারণাটা বেশ, কিন্তু নজির ভাল নয়। পশ্চিমবঙ্গের চোখের সামনে রয়েছে চা বাগান, চটকলের মতো কর্মক্ষেত্র, যেখানে পিএফ-এর টাকার নিয়ন্ত্রণে শ্রমিকদেরও অংশীদার করা হয়েছিল। পিএফ-এর টাকা সরাসরি পিএফ কমিশনারের তহবিলে জমা না পড়ে, গচ্ছিত থাকে এক অছি পরিষদ-নিয়ন্ত্রিত তহবিলে। অছিদের মধ্যে থাকেন ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচিত সদস্যরাও। টাকার ব্যবহারে নমনীয়তা আনতে পিএফ-এর সাধারণ নিয়মাবলি থেকে ছাড় (এগজ়েম্পট) দেওয়া হয়েছে কিছু শিল্পকে।
আক্ষেপ, এই ছাড়প্রাপ্ত ক্ষেত্রগুলিতেও বকেয়া পিএফ-এর অঙ্ক ক্রমাগত বেড়েছে। এ বিষয়ে বহু বছর পশ্চিমবঙ্গ ছিল শীর্ষে, গত বছর পাঁচেক রয়েছে তৃতীয় স্থানে। ২০২২-২৩ সালে দেখা যাচ্ছে, ১৫৭ কোটি টাকা বকেয়ার মাত্র সাত শতাংশ আদায় হয়েছে। পাশাপাশি, বন্ধ কলকারখানার অসংখ্য শ্রমিক তাঁদের সঞ্চিত টাকা আদায় করতে পারেননি, কর্তৃপক্ষ বা অছিদের খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে। অগণিত ঠিকাশ্রমিক জানতেই পারেন না, তাঁদের পিএফ কাটা হয়েছে। নথিভুক্তির সময়ে নাম-বয়সে গরমিলের জন্য নিজের টাকা ছুঁতে পারছেন না অনেকে। অদক্ষ কর্মী থেকে দক্ষ পেশাদার, চাকরি বদলের পরে পিএফ অ্যাকাউন্ট নতুন কর্মক্ষেত্রে ‘ট্রান্সফার’ করা যে কারও কাছে এক দুরূহ ব্যাপার।
আরও ভয়ানক, ছাড়প্রাপ্তির সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী পিএফ-এর টাকা নিজেদের ব্যবসায়ে লগ্নি করে চলেছেন। এ সবই ঘটেছে ট্রেড ইউনিয়নগুলির নাকের ডগায়। ২০১৭-১৮ সালে সংসদের শ্রম বিষয়ক স্থায়ী কমিটি এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে আইনি ব্যবস্থা করতে বলেছিল। পশ্চিমবঙ্গে একাধিক বার ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা পিএফ-এর অবৈধ বিনিয়োগ নিয়ে আঞ্চলিক ইপিএফ দফতরে লিখিত অভিযোগও জমা করেছেন। শ্রমিকদের ক্ষোভে বার বার ইউনিয়ন ভেঙেছে, নতুন সংগঠনও পড়েছে একই রাজনীতির ফাঁদে। নেতারা অব্যবস্থার প্রতিকারের চাইতে, দাবি-দাওয়ার তালিকা নিয়ে দরদস্তুর করে, কিছুমিছু আদায় করে ‘পরিত্রাতা’ সেজেছেন। শ্রমিক নেতাদের পকেট ভরছে, শ্রম আধিকারিকরা ঘুষ খাচ্ছেন— দুর্নীতির নালিশ অজস্র।
সর্বোপরি, পিএফ-এর সুবিধার প্রসারে ব্যর্থ ট্রেড ইউনিয়ন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিড়ি শ্রমিকদের উপরে একটি অসরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনায় লক্ষাধিক মহিলা বিড়ি-কর্মীর মাত্র কুড়ি জনের পিএফ আছে। গিগ কর্মী, আশা কর্মী-সহ বহু ধরনের কর্মীকে কেন্দ্র ঠেলে রেখেছে পিএফ-এর বাইরে। অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ ছাড়া ইউনিয়নগুলি আর কিছু করেনি।
নাগরিকের সামাজিক সুরক্ষায় আজ যখন রাজকোষ থেকে বিপুল ব্যয় হচ্ছে, তখন প্রায় ৩০ কোটি কর্মীর ভাগ্যবিধাতা পিএফ ব্যবস্থার সঙ্কীর্ণতা, জীর্ণতা, প্রতিটি করদাতার বিচার্য বিষয়। পিএফ-পেনশন সামাজিক সুরক্ষার প্রধান ব্যবস্থা হওয়া দরকার ছিল। তাতে কর্মীর মর্যাদা থাকে, সরকারের ব্যয়ভারও কমে। কিন্তু দুর্নীতি, অব্যবস্থার বহর দেখে আজ কর্মীরাও পিএফ কাটাতে চান না, হাতে নগদ চান। অন্য দিকে, জনবাদী রাজনীতি অনুদানের গ্রাহক তৈরিতে বেশি আগ্রহী। বাঁচার উপযোগী বেতন, বা পিএফ-পেনশন (যা কার্যত বিলম্বে বেতনদান) নিশ্চিত করায় উৎসাহী নয়। রাজ্যই হোক বা কেন্দ্র, সব স্তরের সরকার নিজের ‘আইনরক্ষক’ ভূমিকা থেকে সরে এসে ‘হুজুর মায়-বাপ’ ভূমিকা নিচ্ছে। ‘গরিবের ত্রাতা’ ভাবমূর্তিটিই নেতাদের কাছে আজ অধিক প্রার্থিত।
দেশে বিনিয়োগ আনার জন্য সব দেশের সরকারই শিল্পপতিদের বোঝা খানিকটা স্বেচ্ছায় বহন করে। উদ্দেশ্য, কর্মসংস্থান তৈরি, দক্ষ শ্রমবাহিনী নির্মাণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। সে সব খাতে ভারতের আমজনতার যা লাভ মিলছে, তা কি পিএফ-পেনশন মার যাওয়ার বিপুল ক্ষতি পূরণ করতে পারছে? সারা জীবন যিনি পরিশ্রম করেছেন, শেষ বেলায় তাঁকে বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতার আবেদন নিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে ‘দুয়ারে সরকার’-এর লাইনে। তাঁর দেশ কি তখন তাঁকে কর্মী বলে চিনছে, না কি প্রার্থী বলে? তাঁর কাছেই বা নিজের দেশের মুখটি আজ কেমন?