—প্রতীকী চিত্র।
রাজার ঘরে যে ধন আছে টুনির ঘরে সে ধন থাকতেই পারে। টুনি তা রাজপ্রাসাদ তৈরিতে ব্যবহার করবে না দান করবে তা টুনির ব্যাপার। কিন্তু রাজার কোষাগার? আর এখানেই আসে রাজধর্মের প্রশ্ন। কারণ রাজার কোষাগার কিন্তু রাজধর্মের নিরিখে আসলে প্রজাকল্যাণের স্বার্থে ব্যবহারের কথা, যেখানে রাজা সেই কোষাগারের অছি। কোষাগার পরিচালনায় তা কতটা প্রজার কল্যাণমুখী তা দিয়েই কিন্তু রাজার প্রশাসক হিসাবে পরিচিতির অঙ্কটা নির্ধারিত হয়ে থাকে। রাজার কোষাগার ভরার বা সেই কোষাগার থেকে খরচের পদ্ধতি যখম রাজ্যের উন্নয়নের অভিমুখ ঠিক করে, তখন টুনির বিলাস তার পরিবারের আয়াস নির্ধারণ করবে। রাজ্যের নয়। আর আসল আলোচনাটা কিন্তু এই খানেই। সমস্যার মূলও এখানেই।
ধরা যাক পড়াশোনার কথা। উন্নয়নের প্রাথমিক চাহিদাই হল নাগরিকের শিক্ষার বিস্তার। যে দেশে নাগরিকের শিক্ষার সুযোগ সীমিত সে দেশের উন্নয়নের বিস্তারও বহু দোষে দুষ্ট। এমন দেশ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে দেশে শিক্ষার বিস্তার হয়নি অথচ উন্নয়নের অঙ্কে সেই দেশ অনুকরণীয়। তা হলে উন্নয়নের রাস্তায় হাঁটতে আগ্রাসী নীতির প্রথম লক্ষ্যই তো হবে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামো এমন হবে যাতে নাগরিকের শিক্ষিত হওয়ার পথে আর্থিক ক্ষমতা বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা নীতির বর্তমান অভিমুখ যা তাতে শিক্ষার খরচ ক্রমাগত সাধারণের হাতের বাইরে চলে যেতে বসেছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হোস্টেল খরচের উপর জিএসটি।
বেঙ্গালুরু অথরিটি অফ অ্যাডভান্স রুলিং বা এএআর রায় দিয়েছে যে হোস্টেল খরচের উপর ১২ শতাংশ জিএসটি ধার্য করতে হবে। এই রায় নিয়ে নানান ধন্দ রয়েছে। যেমন, আইনের একটি অংশ পড়লে দাঁড়াচ্ছে যে হোস্টেল যদি স্কুল বা কলেজ বা এমন শিক্ষা সংস্থা যে স্বীকৃত ডিগ্রি দেওয়ার অধিকারী চালায় তা হলে তা জিএসটি-র আওতার বাইরে থাকবে। তা হলে কি শুধুই যাদের আমরা বলি ‘প্রাইভেট হোস্টেল’ তারাই এর আওতায় আসবে? অনেকেই বলছেন এই রায়ের অর্থ আরও পরিষ্কার করতে হবে এএআর-কে।
যদি এই রায়ের মানে এই দাঁড়ায় যে ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য বাড়ির বাইরে হোস্টেলে থাকার জন্য সরকারকে কর দিতে হবে, তা হলে কিন্তু তা উন্নয়নের যুক্তির প্রেক্ষিতে নাগরিক স্বার্থ পরিপন্থী। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে যেখানে আমরা শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বললেও সেই অধিকার কার্যকর করতে যে পরিকাঠামো লাগে তার ব্যবস্থা সম্পর্কে উদাসীন। আর সেই পরিকাঠামোর অভাবের অন্যতম একটি অংশ হল হোস্টেলের অভাব।
মাথায় রাখতে হবে যে, ভারতে শিক্ষার খরচ বৃদ্ধির হার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ। যার মানে হল প্রতি ছয় থেকে সাত বছরে শিক্ষার খরচ দ্বিগুণ হচ্ছে। আমরা যদি মেনে নিই যে উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হল শিক্ষার অধিকারকে কার্যকর করার পরিকাঠামো, তা হলে কিন্তু তার পরবর্তী শর্ত হিসাবে সহজলভ্য শিক্ষা পরিকাঠামোর যুক্তি মানতেই হবে। আর তাই যদি হয় তা হলে মানতেই হবে হোস্টেলে থাকার খরচের উপর ১২ শতাংশ জিএসটি উন্নয়নের যুক্তির পরিপন্থী।
অথচ একই সঙ্গে যখন পড়ি দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছাত্রদের জন্য হোস্টেলের অভাবে কলেজছুটের সংখ্যা বাড়ছে এবং তা নিয়ে রাজ্য সরকারগুলি চিন্তিত আর তারই পাশাপাশি দেখি হোস্টেলে থাকার খরচ বাড়তে চলেছে আরও ১২ শতাংশ তখন রাজধর্ম, কোষাগার নীতি নিয়ে যে সব দাবি কানে আসে তা মিলিয়ে নিতে কষ্ট হয় বইকি!
আজ শুধু কলকাতা কেন, ভারতের সব শহরেই বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের মাথার উপর ছাদের সংস্থানের সমস্যা আছে। যদি ধরে নিই যে এই রায়ের আওতা থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেদের হোস্টেলগুলি বাদ তা হলেও কিন্তু এই রায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৃহত্তর উন্নয়নের যুক্তিকে নাগরিক স্বার্থ পরিপন্থী বলেই ধরতে হবে। কারণ, আজ কোনও শহরেই চাহিদার তুলনায় ছাত্রদের আবাসিক পরিকাঠামো যথেষ্ট নয়।
তা হলে এই ছাত্ররা থাকবে কোথায়? আর এই চাহিদা পূরণ করতেই বাড়ছে বেসরকারি হোস্টেল পরিকাঠামো। কলকাতায় পড়তে আসা ছাত্রদের বাবা-মারা গোটা শহর দৌড়ে বেড়ান সাধ্যের মধ্যে বেসরকারি থাকার জায়গা খুঁজে পেতে। আর এই পরিস্থিতিতে যদি সন্তান পড়ানোর খরচ আরও ১২ শতাংশ বেড়ে যায় তা হলে সাধারণ বাবা-মায়ের অবস্থা আরও করুণ হতে বাধ্য।
যুক্তির পথে হেঁটেই তাই এই সমস্যার সমাধান কিন্তু দেশের নীতি-কর্তাদের হাতেই। জিএসটি-র অভিমুখ এই ক্ষেত্রে কী হবে তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে জিএসটি কাউন্সিলকেই। আর সেটি কিন্তু দেশের ও রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্বেই পরিচালিত। তাঁদেরই দায় ছাত্রদের ঘাড় থেকে এই দায় হটানোর। কোনও সংস্থার আয় ২০ লক্ষ টাকার নীচে হলে জিএসটি দিতে হয় না এবং সাধারণ ছাত্রাবাসে এই আয় হয় না, এই যুক্তির নিগড়ে দায় এড়ানোটাও বোধহয় উন্নয়ন পরিপন্থী ভাবনা যা রাজকোষকে টুনির সম্পদের সমগোত্রীয় করে তুলবে। দেশের শিক্ষার অধিকারের ক্ষেত্রে অসাম্য আরও বাড়বে।