সমন্বয়: আরএসএস-এর বৈঠকে উপস্থিত বিজেপির জাতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা-সহ অন্যরা। ৩১ অগস্ট, পালাক্কড়, কেরল। ছবি: পিটিআই।
তৃতীয় মোদী সরকারের প্রথম ৮৮ দিন কেটে গেল। যে কোনও নতুন সরকারই প্রথম ১০০ দিনে কী কাজ করছে, তার উপরে সকলের নজর থাকে। আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে তা থাকবেই। কারণ তিনি নিজেই লোকসভা ভোটের আগে আমলাদের প্রথম ১০০ দিনের কাজের তালিকা তৈরি রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, তিনি তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রীর গদিতে ফিরবেন।
ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই দৃঢ় প্রত্যয় হারিয়ে গিয়েছে। তৃতীয় মোদী সরকারের প্রথম ৮৮ দিন দৃঢ় প্রত্যয় হারিয়ে ফেলারই কাহিনি।
গত তিন মাসে কেন্দ্রীয় সরকার যে একের পর এক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে, তা সকলেরই জানা। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, এই সময়কালেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ওরফে আরএসএস মেনে নিয়েছে, বিজেপির সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একে ‘পারিবারিক বিষয়’, অতএব ‘মিটে যাবে’ বলে দাবি করলেও আরএসএস এই প্রথম বিজেপির সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব স্বীকার করছে।
এ কথা ঠিক, লোকসভা ভোটে বিজেপির আসন কমে গিয়েছে। একার জোরে বিজেপি সরকার গঠনের মতো সংখ্যা জোগাড় করতে পারেনি। বিজেপি এখন নীতীশ কুমারের জে ডি(ইউ), চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম পার্টি, চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টির উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু এমন নয় যে নীতীশ, চন্দ্রবাবু বা চিরাগ যে কোনও সময়ে সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। উল্টে তাঁরা এই সরকারের শরিক থাকার সুবিধা নিয়ে নিজেদের রাজ্যে পায়ের তলার মাটি মজবুত করতে বেশি উৎসাহী। আবার তাঁদের সমর্থন প্রত্যাহারের ফলে মোদী সরকারের পতন হলেই যে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া কেন্দ্রে সরকার গঠনের মতো অবস্থায় রয়েছে, তা নয়।
তা সত্ত্বেও মোদী সরকার একের পর এক সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটছে। তৃতীয় সরকারের প্রথম বাজেটে ফ্ল্যাট-বাড়ি কেনাবেচায় মূলধনি লাভের উপরে করের সিদ্ধান্ত থেকে সরে গিয়েছে। নতুন পেনশন প্রকল্প থেকে সরে গিয়ে ন্যূনতম পেনশনের ব্যবস্থা করতে মোদী সরকার প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার দায় মাথায় তুলে নিয়েছে। হয়তো এর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি মেনে জীবন বিমা, চিকিৎসা বিমার প্রিমিয়ামে জিএসটি কমানো হবে। মোদী সরকার সম্প্রচার বিলের খসড়া ফিরিয়ে নিয়েছে। বিরোধীদের সঙ্গে তেলুগু দেশম, জে ডি(ইউ) ওয়াকফ বিল যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলতেই বিজেপি তা মেনে নিয়েছে। কেন্দ্রের বিশেষ কিছু উঁচু পদে সরাসরি বিশেষজ্ঞ নিয়োগে সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না বলে বিরোধীদের সঙ্গে চিরাগ পাসোয়ান গলা মেলাতেই সরকার তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অথচ এই সব সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের তা নিয়ে গলা ফাটাতে দেখা গিয়েছে। তাঁরা জানতেও পারেননি, কিছু ক্ষণ পরেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।
কেন এই দৃঢ় প্রত্যয়ের অভাব?
এর কারণ লোকসভা ভোটে কেন বিজেপির আসন সংখ্যা ৩০৩টি থেকে কমে ২৪০-এ পৌঁছে গিয়েছে, তা নিয়ে এখনও বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব সন্দিহান। খারাপ ফলের কারণ নিশ্চিত জানা না থাকলে যে কোনও পদক্ষেপ করতে গিয়েই ভয় হবে, এর ফল আরও খারাপ হবে না তো! বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের ক্ষেত্রে হয়তো সেটাই হচ্ছে। বিজেপির অনেকেরই বিশ্বাস, লোকসভা ভোটে দলিত, জনজাতিদের ভোট সরে গিয়েছে। কারণ তফসিলি জাতি, জনজাতিদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা তুলে দিতে নরেন্দ্র মোদী সংবিধানে বদল করতে চাইছেন, আর সেই কারণেই তিনি ‘চারশো পার’-এর লক্ষ্য রেখেছেন বলে রাহুল গান্ধী, অখিলেশ যাদব, তেজস্বী যাদবদের প্রচার। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় বিজেপির অনেকেই সন্তুষ্ট নন। তাঁদের প্রশ্ন, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের মতো কিছু রাজ্যে না হয় দলিত-জনজাতি ভোট সরে যাওয়ার ফলে বিজেপির আসন কমেছে। তা হলে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, গুজরাতের মতো রাজ্যে তার প্রভাব দেখা গেল না কেন? ওড়িশার মতো দলিত-জনজাতি বহুল রাজ্যে বিজেপি কী ভাবে এত ভোট পেল?
বিজেপি নেতারা এত দিন আসল প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তা হল, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস মানুষের একশো শতাংশ ভোটদান নিশ্চিত করতে সক্রিয় হয়েছিল। সেই আরএসএস কেন এ বার নিষ্ক্রিয় ছিল? কেন রাজ্যে রাজ্যে আরএসএস-এর স্বেচ্ছাসেবকরা এ বার লোকসভা নির্বাচনের সময় মাঠেই নামলেন না? খোদ নরেন্দ্র মোদীকে তাঁর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতে এর খেসারত দিতে হয়েছে। সেখানে তাঁর জয়ের ব্যবধান কমেছে। অথচ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা কেন ভোটের মধ্যেই বলে বসলেন, বিজেপি এখন নিজেই সক্ষম, আরএসএস-কে তার প্রয়োজন নেই— তার উত্তর মেলেনি। গত সপ্তাহান্তে আরএসএসের সঙ্গে বিজেপি-সহ সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠনগুলির সমন্বয় বৈঠক শেষ হয়েছে। তার শেষে আরএসএস নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে, বিজেপির সঙ্গে কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে তা মিটে যাবে।
বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের এই ঠিক মতো ব্যাটে-বলে না-হওয়া বা বোঝাপড়ার সমস্যার ফলেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের দৃঢ় প্রত্যয়ের অভাব তৈরি হয়েছে?
আরএসএস শুধু যে বিজেপির সঙ্গে সমন্বয়ের সমস্যা মেনে নিচ্ছে, তা নয়। এত দিন ধরে যে সব ক্ষেত্রে বিজেপি আগ্রাসী নীতি নিয়েছে, বা অনড় মনোভাব নিয়েছে, সেখানেও আরএসএস অন্য সুর ধরছে। উদাহরণ, জাতগণনার দাবি। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কার্যত গোটা বিরোধী শিবির জাতগণনার দাবি তুলছে। এনডিএ শরিক নীতীশ কুমারেরও জাতগণনা পুরনো দাবি। বিজেপি নেতৃত্ব এ-যাবৎ জাতগণনার দাবি খারিজ করেনি, আবার তা মেনেও নেয়নি। বিজেপি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার আগেই আরএসএস এ বিষয়ে ভারসাম্যের নীতি নিয়ে ফেলেছে। আরএসএস জানিয়েছে, অনগ্রসরদের কল্যাণে তাঁদের সংখ্যা গণনা হতেই পারে। শুধু তা নিয়ে রাজনীতি করা চলবে না।
কলকাতায় আর জি কর কাণ্ডের পরে বিজেপির বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তুলেছেন। রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের ঘন-ঘন দিল্লি সফর এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক রাষ্ট্রপতি শাসনের জল্পনা উস্কে দিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব কোনও অবস্থান নেওয়ার আগেই আরএসএস জানিয়ে দিয়েছে, তারা রাষ্ট্রপতি শাসনের পক্ষে নয়। এর পরে শুভেন্দু ফের রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবি তোলার সাহস দেখাবেন?
আরএসএসের বার্তা স্পষ্ট। এত দিন নরেন্দ্র মোদীর দাপট এবং একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্যে আরএসএস টুঁ শব্দ করার সুযোগ পায়নি। এ বার বিজেপি দুর্বল হতেই আরএসএস বিজেপিকে দিশা-নির্দেশ পাঠাচ্ছে— তা সে জাতগণনা হোক বা পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনের প্রশ্ন।
এমনিতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কেন এক বারও আর জি কর কাণ্ড নিয়ে সরাসরি মুখ খুললেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অথচ এই নরেন্দ্র মোদীই লোকসভা ভোটের আগে সন্দেশখালি নিয়ে সরব হয়েছিলেন। মহিলাদের উপরে তৃণমূলের লোকেদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। সন্দেশখালির নির্যাতিতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক জনকে বিজেপি লোকসভা ভোটে প্রার্থী করার পরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথাও বলেছিলেন। নারী-নির্যাতনের ঘটনায় বিজেপির নিজের ট্র্যাক রেকর্ড মোটেই ভাল নয়। উল্টে বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগিররা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুললেও বিজেপি ব্রিজভূষণকেই আড়াল করে এসেছে। এখন নরেন্দ্র মোদী নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারগুলিকে পদক্ষেপ করতে বললেও সরাসরি আর জি কর কাণ্ড নিয়ে মুখ খুলছেন না।
এখানেও কি বিজেপি নেতৃত্বের মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয়ের অভাব দেখা দিয়েছে?