ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক জন মানুষ, যাঁকে হয় খুব পছন্দ করতে পারেন, নয়তো তীব্র ভাবে অপছন্দ— কিন্তু তাঁকে অবজ্ঞা করা প্রায় অসম্ভব। আমেরিকায় মানুষ ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছেন। সেই নির্বাচনে স্বভাবতই অন্য দেশের নাগরিকদের কোনও ভোট ছিল না। কথাটা, যাকে বলে ‘স্টেটিং দি অবভিয়াস’ মনে হতে পারে, কিন্তু তা ঠিক নয়। ট্রাম্পের সম্ভাব্য নীতির ফলে আমেরিকায় যে সুফল কিংবা দুর্যোগ আসবে, তার নৈতিক কৃতিত্ব বা দায়িত্বও বর্তাবে সে দেশের জনতার উপরে। কিন্তু অন্যান্য দেশের নাগরিকরা, ট্রাম্পের এই জয়ের পিছনে যাঁদের কোনও কৃতিত্ব বা দায় নেই, তাঁরাও সেই সুফল এবং দুর্ভোগের ভাগীদার হবেন।
আমেরিকার অর্থব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়। বিশ্বের অর্থব্যবস্থায় প্রতি টাকার প্রায় সিকি ভাগ উৎপাদিত হয় সে দেশে। কাজেই, সেই দেশের প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন, সেটা নির্ধারণে আমাদের কোনও ভূমিকা এবং অধিকার না থাকলেও, তাঁর ঘোষিত নীতির ফলে আমাদের ভাল বা খারাপ হবে, সেটা আমরা ভাবতেই পারি। প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্পের শাসনকালে ভারতে আমাদের কি লাভ, না কি লোকসান হবে? আমেরিকায় নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় ঘোষণার পর, দেশের শেয়ার বাজারে মন্দা এসেছে, টাকার দর ডলারের অনুপাতে কমেছে। এই পরিণাম কিন্তু শুধু ট্রাম্পের নির্বাচনী সাফল্যের জন্য নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আরও অনেক সম্ভাব্য কারণ— যেমন, ভারতের কয়েকটি প্রদেশে নির্বাচন-জনিত অনিশ্চয়তা। অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণ অপরিবর্তিত থাকলে, শুধু ট্রাম্পের জয়ের ফলে ভারতের কী হবে সেটাই প্রশ্ন।
বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রোটেকশনিস্ট, অর্থাৎ সংরক্ষণবাদী। নির্বাচনী প্রচারে উনি আমেরিকার বাজারে যে কোনও আমদানির উপরে ২০ শতাংশ, এবং চিন থেকে আমদানির উপরে ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার অভিপ্রায় ঘোষণা করেছিলেন। তা ছাড়া, উনি চিনকে ‘মোস্ট ফেভার্ড নেশন’-এর তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথাও বলেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর প্রথম দফায় ট্রাম্প চিনের বিরুদ্ধে রফতানির ক্ষেত্রে অনৈতিক অনুদানের অভিযোগ এনে যে বৈদেশিক বাণিজ্যিক লড়াই শুরু করেছিলেন, সেই যুদ্ধ আবার প্রবল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
ট্রাম্পের এই প্রোটেকশনিস্ট নীতির ফলে কিছু কিছু আমেরিকান শিল্প, যেগুলি অন্যান্য দেশের— বিশেষত চিনের— সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছে না, সেগুলি লাভবান হবে। কিন্তু বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদের মতে, এতে সামগ্রিক ভাবে আমেরিকান অর্থব্যবস্থার ক্ষতি হবে। আমেরিকায় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, আমেরিকান শিল্পের উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং বিশ্ব অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার কমবে। পৃথিবীর উৎপাদনব্যবস্থার অনেকটাই এখন সাপ্লাই চেন বা জোগানশৃঙ্খলের মাধ্যমে বিশ্ব জুড়ে সংহত হয়ে গেছে। জোগানশৃঙ্খল বিপর্যস্ত হলে যে বিশ্ব অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, সেটা আমরা কোভিডের সময় দেখেছি। চিন-আমেরিকার বাণিজ্যিক যুদ্ধে জোগানশৃঙ্খলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটা প্রশ্নচিহ্ন উঠে এসেছে।
ভারতের উপরে ট্রাম্পের রক্ষণশীল নীতির কী প্রভাব পড়বে? আমাদের রফতানির উপরে যে অতিরিক্ত শুল্ক বসবে, সেটা চিনা রফতানির উপর অতিরিক্ত শুল্কের থেকে কম হওয়ায়, আমেরিকার বাজারে আমাদের রফতানির প্রতিযোগী ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে বাড়বে। কিন্তু শুল্কের এই পার্থক্যের পরেও কি আমরা আমাদের পণ্যের গুণমান রক্ষা করে, আমেরিকায় আমাদের পণ্য চিনা পণ্যের বর্ধিত দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে পারব? তা ছাড়া, আমেরিকায় চিনের রফতানি (৫৫,১০০ কোটি ডলার) আমাদের রফতানির (৭,৫০০ কোটি ডলার) সাত গুণেরও বেশি। ট্রাম্পের নীতির ফলে আমেরিকার বাজার থেকে চিনা পণ্যের দখল যতটুকু কমবে, ভারত সেই শূন্যস্থান আদৌ অধিকার করতে পারবে কি না— এবং, পারলে কত দিন সময় লাগবে— তা নির্ভর করবে ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের সাফল্যের উপরে।
নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প মাঝেমধ্যেই ভারতের রফতানি-আমদানি নীতির সমালোচনা করেছেন, ভারতকে ‘ট্যারিফ কিং’ বা শুল্কের রাজা আখ্যা দিয়েছেন। আমাদের উচিত ট্রাম্পের সঙ্গে আমাদের শীর্ষনেতাদের সুসম্পর্কের ভিত্তিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তি করা, যাতে আমেরিকা ভারতীয় রফতানির উপরে সে দেশের বর্ধিত শুল্ক আরোপ না করে।
উন্নয়নের জন্য ভারতের বিশেষ ভাবে প্রয়োজন শিল্প, কারখানা এবং অনেক বেশি বিনিয়োগ। ট্রাম্প আসার ফলে ভারতে আমেরিকান বিনিয়োগ কি বাড়বে? আমেরিকান এফডিআই বা প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ ভারতে বেড়েছে। তবু ভারত এখনও চিনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। ২০২৩ সালে চিনে আমেরিকান এফডিআই ছিল ১২,৬৯১ কোটি ডলার, আর ভারতে সেই এফডিআই ছিল মাত্র ৫,১৬০ কোটি ডলার। চিনে আমেরিকার যে বিপুল বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভার রয়েছে, দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য-সংঘাত তৈরি হলে তারও একটা প্রবণতা হবে চিন থেকে সরে এশিয়ার অন্যান্য দেশে যাওয়ার। গত দু’তিন দশক ধরে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে। ভারতকে টেকনোলজি ট্রান্সফার বা প্রযুক্তি হস্তান্তরে আমেরিকার সরকার এবং শিল্পপতিদের দ্বিধাও কমেছে। আমাদের উচিত এই সময় ভারতকে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের একটি আকর্ষক গন্তব্যস্থল তৈরি করা।
কিছু কিছু বিষয়ে ট্রাম্প উদারপন্থী। উনি ডিরেগুলেশন-পন্থী, অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় সরকারি প্রতিবিধান অপসারণে বিশ্বাসী। আর্থিক জগতে ক্রিপ্টোকারেন্সির, যেমন বিটকয়েনের কথা আমরা প্রায় সবাই শুনেছি । প্রতিবিধান উঠে গেলে, ক্রিপ্টোকারেন্সির পালে হওয়া লাগবে। ক্রিপ্টোকারেন্সি বেশি করে চালু হলে, তার পরিণতি আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণে বা অনুসন্ধানে এবং সরকারের টাকা ছাপানোর থেকে যে আয় আসে তার উপরে কী প্রভাব পড়বে, সে নিয়ে অনেকেই চিন্তিত।
বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ দূষণ নিয়েও ট্রাম্পের নীতি অনেকটাই ব্যতিক্রমী। উনি পেট্রলিয়াম ড্রিলিং এবং খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের উপর থেকে প্রতিবিধান তুলে দিতে চান। ২০১৯ থেকে সব রকম পেট্রলিয়ামজাত পদার্থের ক্ষেত্রে— ক্রুড বা অপরিশোধিত, রিফাইন্ড বা পরিশোধিত পদার্থের— আমেরিকার মোট রফতানির পরিমাণ ছাপিয়ে গিয়েছে এই পদার্থগুলির ক্ষেত্রে তাদের মোট আমদানির পরিমাণকে। ট্রাম্প পেট্রলিয়াম ড্রিলিং-এর উপর থেকে প্রতিবিধান প্রত্যাহার করে নিলে বিশ্ববাজারে পেট্রলিয়াম পদার্থের দামে যেমন লাগাম লাগতেও পারে, তেমনই পরিবেশ দূষণ এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে চিন্তা বাড়বে।
ট্রাম্পের শাসনকালে আমেরিকান অর্থব্যবস্থায় যেখানে এক বিরাট পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা, তা হল স্বাস্থ্যক্ষেত্র। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে প্রবর্তিত ওবামা কেয়ার বা অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার-এর বিরোধী। ওবামা কেয়ার উঠে গেলে, আমেরিকান ফার্মাসিউটিক্যাল বা ঔষধ শিল্পের পসার বাড়বে। ভারতের ঔষধ শিল্পের উন্নতি হয়েছে, কোভিডের পর ভারতকে অনেকে বিশ্বের ফার্মেসি বা ঔষধাগার আখ্যা দিয়েছে। আশা করা যায়, আমেরিকার বর্ধিত ঔষধের চাহিদার কিছুটা ভারতের ঔষধ শিল্পের ভাগেও আসবে।
ট্রাম্প ইনকাম ট্যাক্স বা আয়কর কমাতে চান। উনি মনে করেন যে, আমেরিকার রাজকোষ ঘাটতির সমস্যা তিনি আয়কর কমিয়ে এবং আমদানি পণ্যের উপরে শুল্ক বাড়িয়ে সমাধান করে দেবেন। অনেক অর্থনীতিবিদই সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দিহান। তাঁদের মতে, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নীতির ফলে আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে, সুদের হার বাড়বে, এবং ডলারের মূল্য কমবে। ভারত যদি মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে ডলারের অনুপাতে টাকার মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকবে।
বিধায়ক, বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গ।