Ramakrishna Paramahamsa

অখণ্ড চৈতন্যবোধের সাধনা

প্রতি দিনে প্রতি ক্ষণে এমন আশ্চর্য সতর্কতার নাম শ্রীরামকৃষ্ণ। নিত্যদিনের অভ্যাসগত জীবনে আমাদের বিস্মৃত ‘আমি’টাকে অতি যত্নে মনে করান তিনি।

Advertisement

পিয়ালী বসু

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২২ ০৬:৫৫
Share:

কলকাতা থেকে ফেরার পথে দক্ষিণেশ্বরে প্রতাপচন্দ্র হাজরা এক বার নিজের গামছা ফেলে আসেন। ঘটনা সামান্য। অথচ প্রবল আপত্তি শ্রীরামকৃষ্ণের, আত্মভোলা যে মানুষটির পরনের কাপড় ঠিক থাকে না, তিনিই বললেন, “আমি তো নিজের গামছা বা বেটুয়া কলিকাতায় ভুলিয়া আসি না। আর তোর একটু জপ করে এত ভুল!” সারদা দেবীকে প্রতি মুহূর্তে মনে করান, কোথাও যাওয়ার সময় গাড়িতে বা নৌকায় সর্বাগ্রে উঠতে, আর সব জিনিস খেয়াল করে একেবারে শেষে নামতে।

Advertisement

প্রতি দিনে প্রতি ক্ষণে এমন আশ্চর্য সতর্কতার নাম শ্রীরামকৃষ্ণ। নিত্যদিনের অভ্যাসগত জীবনে আমাদের বিস্মৃত ‘আমি’টাকে অতি যত্নে মনে করান তিনি। তাঁর কথায়, জীবনবোধে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যে শাশ্বত সত্য, তার মূল উপাদান ‘চৈতন্য’, অনবরত যে বলে চলে, “আর ঘুমাইও না মন।” যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমরা, শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের সেই মগ্নতা ভেঙে জেগে উঠতে, সজাগ থাকতে বলেন।

কোন সেই আলোক যার দ্বারা প্রাণ ছুটে চলে, এমনই এক প্রশ্নে শুরু হয়েছিল কেনোপনিষদ। তার উত্তরের সার কথা: চেতনার অভিজ্ঞতালব্ধ এ জীবন, চৈতন্যের আলোতেই অগ্রসর। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের মতে এই অভিজ্ঞতার খোঁজই ‘সেল্‌্ফ কনশাসনেস’। শ্রীরামকৃষ্ণ যাকে বলছেন ‘গোলেমালে’র ‘গোল’টি ছেড়ে ‘মাল’টি ধরা। জগৎ চৈতন্যময়, জীবনভর সাধনায় এই ছিল তাঁর উপলব্ধি। ভারতীয় দর্শন যাকে ব্যাখ্যা করে ‘চিদানন্দরূপঃ শিবোহম্’ বলে, শ্রীরামকৃষ্ণ তা-ই বুঝিয়ে দেন, এই চৈতন্যে জগৎ ‘জরে রয়েছে’। জগৎ ও তার অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি জীব আসলে একই উৎসজাত, কোথাও দুই নেই, সব মিলেমিশে এক, এই অদ্বৈতবোধেই শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায় ‘চৈতন্যলাভ হয়’। সর্বভূতে, সর্বাবস্থায় একতার বোধ জাগে, ভেদদৃষ্টি ঘুচে যায়। অথচ জীবনধারণের জাঁতাকলে আমরা এই অভিন্নতা ভুলে থাকি। আমাদের ভিতরের সেই সুপ্ত চৈতন্যবোধেরই জাগরণ ঘটান শ্রীরামকৃষ্ণ। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অসাধারণ সম্ভাবনার প্রত্যাশায় নিশ্চিত করেন, স্বরূপ অন্বেষণেই মানুষ প্রকৃত ‘মানহুঁস’ যুক্ত হবে। জীবনের উদ্দেশ্য বলতে শ্রীরামকৃষ্ণ যে ঈশ্বরলাভের কথা বার বার বলেছেন, তা আসলে এই আত্মজ্ঞান, চৈতন্যেরই নামান্তর। এর স্পর্শেই জীবন আমূল পাল্টে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন মণিলালকে বলেন, “যাদের চৈতন্য হয়েছে তাদের হিসেব করে কিছু করতে হয় না, তাদের বেচালে পা পড়ে না।”

Advertisement

বেদান্তভাষ্য অনুসারে, চেতন জীব তার জড় জগতে রূপ রস স্পর্শ শব্দ গন্ধের যে অনুভূতি লাভ করে তা-ই চৈতন্যস্বরূপ। অতএব, চৈতন্য শরীরের গুণ নয়, বরং শরীর দ্বারা অভিব্যক্ত। সময়ের নিরিখে অনুভবের বিষয় পাল্টে গেলেও, এই চেতন অপরিবর্তনশীল। আমরা প্রত্যেকে সেই এক আনন্দজাত, এই আত্মোপলব্ধিই জীবনের সার। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী বেদান্তের এই গূঢ় তত্ত্বের ফলিত রূপ।

সর্বভূতে একই চৈতন্য, এই উপলব্ধির প্রমাণ শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনের বহু ঘটনা। দক্ষিণেশ্বরের ঘাটে ঝগড়ারত দুই মাঝি, সবল জন দুর্বলকে চপেটাঘাত শুরু করলে শ্রীরামকৃষ্ণ যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠেন। হৃদয়রাম ছুটে এসে দেখে তাঁর পিঠ আরক্ত, ফুলে উঠেছে। ব্যথিতের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ সমানুভবের বোধে তখন এক। মথুরবাবুর সঙ্গে তীর্থদর্শনে বেরিয়ে দেওঘরের পথে এক দল নিরন্ন মানুষকে দেখে অস্থির তিনি বললেন, এদের এক মাথা করে তেল-জল ও খাবার দিতে হবে। এই ‘অপব্যয়ে’ মথুরবাবু নারাজ হলে বেঁকে বসলেন তিনিও, “দূর শালা, তোর কাশী আমি যাব না।” শেষে শ্রীরামকৃষ্ণের সমানুভবেরই জয় হয়, মথুরবাবু তাঁর কথা রাখেন।

পুজোর ফুল-বেলপাতা তুলতে গিয়েও তিনি সেই এক ব্রহ্মকেই উপলব্ধি করেন। গাছেই পড়ে থাকে ফুল। কালীঘরের কোশাকুশি, বেদি, চৌকাঠ, মানুষ, দেবতা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব, সবেতেই সেই একেরই প্রকাশ দেখে চতুর্দিকে ফুল ছুড়তে থাকেন পূজারি শ্রীরামকৃষ্ণ। কোথাও বেচাল নেই, সবার ঘড়িই যে একদম ঠিক ঠিক চলছে, হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিতেই তাঁর ‘যত মত, তত পথ’-এর সাধনা। ঈশ্বরজ্ঞানে মানুষকেই সেবা করার যে পাঠ দিচ্ছেন তিনি, অখণ্ড চৈতন্যবোধই তার ভিত্তি।

এই আত্মচেতনা যে পুঁথি-পড়া বিদ্যাজাত নয়, সে কথাও স্পষ্ট করছেন তিনি। কথামৃতকার শ্রীম তথা মাস্টারমশাই যখন নিজের ‘অশিক্ষিত’ স্ত্রীকে ‘অজ্ঞান’ ঠাওরাচ্ছেন, বিরক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ ‘শিক্ষিত’ মানুষটির ফাঁপা অহঙ্কারে আঘাত হেনে বলেন, “আর তুমি জ্ঞানী?” সেই প্রথম ধাক্কা। মনের অন্ধকার কাটিয়ে ক্রমশ আলোকবলয়ে প্রবেশ করেন মাস্টারমশাই, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। স্বার্থযুক্ত ‘আমি’ময় জঞ্জালে ত্যাগের আগুন জ্বালিয়ে সমগ্রতায় মিশে যাওয়া— শ্রীরামকৃষ্ণের এই শিক্ষার নিদর্শন স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভাইদের জীবন। কেশবচন্দ্র সেন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র-সহ উনিশ শতকের কলকাতাও শ্রীরামকৃষ্ণের চৈতন্যোপলব্ধির সাক্ষী।

পদ্মপাতায় জলের মতো আমাদের অসচেতন জীবন দেশ-কাল নির্বিশেষে এই আত্মজ্ঞানের অভাবেই প্রতিনিয়ত অশ্রদ্ধা, হিংসা, অসহিষ্ণুতার মুখোমুখি হয়। এখানেই তাঁর চৈতন্যায়ুধ প্রয়োগ করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। ছাঁচ বদলান না তিনি, আত্মবিস্মৃত, অচেতন মানুষকে গড়েপিটে ভিতর থেকে ‘নতুন’ করে নেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement