কে জানে কী করে, প্রয়াণদিনেও লতা আমাদের অন্তরাত্মা ছুঁয়ে গিয়েছেন। সে দিন সকালে কারও বাড়িতে সরস্বতীর ঘট বিসর্জন হচ্ছিল, কেউ দেবীর অর্ঘ্য সাজাচ্ছেন, শাঁখে ফুঁ দেন: এমন সংযোগ অসংখ্য। মাঝে চলে গেলেন বাঙালির আর এক গানের রানি, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সব মিলিয়ে নিঝুম ক্লান্তি এখন চরাচরে। সন্ধ্যা তো বাঙালিরই। কিন্তু লতা-বিয়োগের এমন অভিঘাত দেশে এবং বাঙালির উপরেও— কেন?
উত্তর মিলবে পঁচাত্তর বছর আগের দেশ স্বাধীন হওয়ার সন্ধিক্ষণে। কলাকুশলীরা অবমাননাকর পেশা থেকে আসেন, এই মনে করে হিন্দি সিনেমা ও সঙ্গীতকে হীন নজরে দেখা হত। লতার রিনরিনে নিষ্পাপ কণ্ঠ এই গোটা ধারণাকে, ভারতীয় সিনেমা-সংস্কৃতির অঙ্গনটাকেই পুণ্যতোয়া সুরের স্রোতে ধুয়ে দিল। তাই লতা মঙ্গেশকরকে নব্যভারতীয় সভ্যতার সংস্কারক বলেও চিহ্নিত করা হয়। আর এক ‘সমস্যা’রও সমাধান তাঁর অপাপবিদ্ধ কণ্ঠ। সিনেমাকে সদ্যোজাত এই জাতিরাষ্ট্রের সংস্কৃতির বাহক রূপে দেখা হচ্ছিল। সেই আয়নায় দেশের মেয়েদের রূপ কেমন হবে? গল্পের প্রয়োজনে তারা বাইরে বেরোবে, বাগানে গানও গাইবে। সেখানে তাদের ‘সম্মান’ কী ভাবে রক্ষিত হবে? লতাকণ্ঠ সেই প্রশ্নেরও উত্তর। বহির্জগতে নায়িকার শারীরিক উপস্থিতিকে খানিক মোলায়েম করল তাঁর সুরেলা আওয়াজ। মূলধারার নায়িকা হিসাবে এমন সীতাসাবিত্রীকেই যুগে যুগে সিনেমায় দেখিয়েছেন নির্মাতারা, আর সাত দশক ধরে চিরকিশোরী স্বরতন্ত্রের সেই চাহিদা পূরণ করে লতা হয়ে উঠেছেন জাতির স্বর, সহস্রাব্দের কণ্ঠ। যে লজ্জানত দৃষ্টিতে বলে, ‘তুনে ও রঙ্গিলে ক্যায়সা জাদু কিয়া’, ‘কোই হাসিনা কদম পহলে বড়াতি নেহি’! বেড়া ভাঙতে নিষেধ করে, ‘ইঁহা আনা না দোবারা’। নতুন সহস্রাব্দেও সমর্পণের মঙ্গলদীপ জ্বালিয়ে রাখে ‘তেরে লিয়ে’-তে।
এমন গানেই সমাজের স্থিতাবস্থার বাতাস বয়, স্বর্গের শান্তির ছায়াটুকুকে দূর থেকে দেখেই তৃপ্ত হয় জনসাধারণ। তাই ক্লিষ্ট জীবনে বরাভয়মুদ্রায় অবিচ্ছেদ্য জুড়ে যান লতা মঙ্গেশকর।
এই কণ্ঠ-ভাবমূর্তির উল্টো দিকে আছেন ‘খলনায়িকা’রা, তাঁরা কামনা-বাসনায় সরব। সেই ‘দোষ’-এ সিনেমার শেষে তাঁদের মৃত্যু হয়। এই ‘অপর’-এর কণ্ঠে, আদর্শ নারীর স্টিরিয়োটাইপের বিরুদ্ধ-আখ্যান গড়েছেন প্রথমে কিছুটা গীতা দত্ত, পরে আশা ভোঁসলে। লতা-আশার প্রকৃত বিরোধিতা এখানেই। গলায় ‘পাওয়ার’ নেই— এই বলেই তো লতার সঙ্গে কাজ করেননি সুরকার ওপি নায়ার।
অথচ, সাত দশক আদর্শ নারীর ধ্বজা এক হাতে বয়েছেন লতা। আবার অন্য হাতে নিজেই তাকে খণ্ডন করে অসীম ক্ষমতার পরিচয়ও দিয়েছেন! ১৯৪৯-এ ‘লারালাপ্পা’ বলে একটি টকমিষ্টি গান গাইলে সিনেপুরুষরা তাঁকে বলেন, এমন গানে তোমাকে মানায় না। পরিণত লতা কথা-সুর, গল্প জেনে গান বাছতেন। গানে খুব বেশি কামজ ইশারা থাকলে ফিরিয়ে দিতেন। কিংবা, অনেক সময় বলতেন, এটা আশা বেশি ভাল গাইবে। সব রকমের গান তিনি গাননি। চাইলেই যে গাইতে পারতেন, তার উদাহরণ হেলেনের ক্যাবারে ‘আ জানেজাঁ’।
‘আয়েগা আনেওয়ালা’ থেকেই তিনি অলৌকিক-অশরীরী ঘরানার গানের প্রচলন করেন। পরের দশকগুলির ‘আ জা রে পরদেশি’, ‘কহি দীপ জ্বলে’, ‘গুমনাম হ্যায়’, ‘মেরা সায়া’, কুহেলির ‘সে আসছে’-য় মনে হত, এই কণ্ঠের অধিকারিণীকে ছোঁয়া যায় না। যেন মৃত্যুহীন আত্মা, দৈবী সত্তা। নায়িকাকে কার্যত পৃথিবীর ঊর্ধ্বে কায়াহীন স্তরে তুলে নিয়ে গেলেন লতা, ফলে সিনেমায় মেয়েদের ভাবমূর্তি নিয়ে আরও নিশ্চিন্ত হলেন সমাজপ্রভুরা। লতা যে সরস্বতীর মানবীরূপ হয়ে উঠলেন, তাতে এমন নিসর্গসঙ্গীতেরও বেশ খানিকটা অবদান।
আবার নারীর রাজপাটের শাসনদণ্ডটাও তাঁরই হাতে। পুরুষশাসিত সংস্কৃতিতে একটি মেয়ের এমন সাম্রাজ্যবিস্তার শুধু লতা মঙ্গেশকরের নয়, গোটা নারীজাতির জয়গাথা। সমাজের রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করেই নারীর স্বরটিও চড়িয়েছেন মাঝেমধ্যেই। ‘হোঁটোমে অ্যায়সি’, ‘দো ঘুঁট মুঝেভি’, ‘চড়তি জওয়ানি’— এই তালিকাও যথেষ্ট দীর্ঘ!
তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা অতীব সুকণ্ঠী হলেও নিখুঁত ছিলেন না। তাঁদের কণ্ঠলাবণ্যের বন্যায় চৈতালি ভেসে গেলেও মনে হত, এই স্বর কিছুটা বেশি মিষ্টি। এক অভিমানিনীর পুরস্কারজয়ী গানের পাশাপাশি একই সিনেমায় লতার কালজয়ী গানটি শুনলে স্পষ্ট হবে— যিনি প্রাপ্য পাননি বলছেন, তাঁর গায়নে প্রাদেশিকতার সমস্যা। এই নিয়ে ‘পারফেকশন’-এর মোকাবিলা হয় না।
জায়গা বুঝে ‘হরকত’, গানের গতির সম্যক নিয়ন্ত্রণ, বিশুদ্ধ উচ্চারণ— এত ‘পারফেক্ট’ ঈশ্বর ছাড়া আর কে? লালালালা, হোহোহো— তান খেলানোর নৈপুণ্য ছিল লতার অন্যতম শক্তি। কারণ, দীর্ঘ সময় দম ধরে রাখতে পারতেন। তাঁকে বিষ দেওয়ার পর সেই দম ধরার সময়টা কমে যায়। তবুও দক্ষতায় ভাটা আসেনি! দুরূহতম সুরগুলিতে তাঁকে ছাড়া চলতই না। রাহুল দেব বর্মণের ভীষণ কঠিন এক গান শুনে কিশোর বলেছিলেন, “আগে লতাকে দিয়ে গাওয়াও।” লতা অক্লেশে গেয়ে গেলেন। কিশোর সেই রেকর্ডিং সাত দিন শুনে তবে গান গাইতে এলেন। শিবরঞ্জনী রাগাশ্রিত গানটি হল ‘মেরে নয়না শাওন ভাদো’।
আষাঢ়-শ্রাবণ তো নাকি তানসেনের গানে নামত। আর আমরা কি জীবদ্দশায় লোকগাথা হতে দেখলাম লতাকে? তাঁর তারুণ্যেই তাঁকে ‘মির্যাকল’-এর চোখে দেখে সিনেমার পরিকল্পনা হয়েছে। সত্যম শিবম সুন্দরম। রটে গিয়েছে গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়েন, ঘুম ভাঙলে সেখান থেকেই সুর ধরেন। মৃত্যুলগ্ন কি তাঁর ভারতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় মিথে পরিণত হওয়া সম্পূর্ণ করল? আগামী প্রজন্ম কি জানবে, লতা ‘পিয়া বিনা পিয়া বিনা’ ধরলে, বুকে হাত দিলে হৃদয়ের রক্তের দাগ দেখা যেত?
এই দেবত্ব কতখানি তাঁর বুদ্ধিমত্তা, কতটা পরিস্থিতির নির্মাণ, আর কতটা সত্যিই আমাদের বিশ্লেষণের বাইরে?