Puri: A police personnel asks visitors to vacate the beach in view of cyclone 'Dana' which is expected to make landfall in Odisha, in Puri, Thursday, Oct 24, 2024. (PTI Photo)(PTI10_24_2024_000314A) Sourced by the ABP
ঘূর্ণিঝড় দেখতে এসেছি... শুনেছি সমুদ্র প্রচণ্ড উত্তাল হবে। পুলিশ আমাদের আসতেই দিচ্ছে না।” যে রাতে দানার আছড়ে পড়ার কথা, সেই সন্ধ্যাতেই খবরের চ্যানেলের অনুষ্ঠানে এমনটাই বলছিলেন দিঘা ঘুরতে আসা এক পর্যটক। তাঁর প্রতিধ্বনি ওই রাতেই দিঘা, মন্দারমণি, পুরীতে ‘ঘুরতে আসা’ আরও বহু পর্যটকের গলাতেও। বিষয়টা ‘বিচ্ছিন্ন’ প্রবণতা নয়। এই বছরই কেরলের ওয়েনাড়ে ভয়াবহ ভূমিধস ও বন্যা পরিস্থিতিতে যখন শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তখন সেই বিপর্যয় ‘সরাসরি’ দেখতে, স্থানীয়দের মর্মান্তিক অবস্থা ক্যামেরা-বন্দি করতে বহু দূর থেকে উজিয়ে হাজির হয়েছিলেন অনেকেই। এমনকি, বন্যা সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা যাবে, এমন হোটেল, হোম-স্টের খোঁজও পড়েছিল নেটমাধ্যমে! সেই সময় পর্যটকরা যাতে কেরলে, বিশেষত ওয়েনাড়ে কম ঘুরতে আসেন, সেই মর্মে বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত জারি করতে হয় প্রশাসনকে।
এই ধরনের মানুষের ভিড়ে ওয়েনাড়ের মতো বিভিন্ন বিপর্যয়স্থলে উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হয়েছে বার বার। বিপর্যয়-পর্যটকরাও নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছেন এই করতে গিয়ে। যেমন, ২০২৪-এর এপ্রিলে ইন্দোনেশিয়ায় একটি আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত হবে, এ কথা জেনেই হাজির হয়েছিলেন চিনের এক পর্যটক। ছবি তোলার অতি-উৎসাহে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির ভিতরের দিকে ঝুঁকতে গিয়েছিলেন তিনি। পরিণতি, মর্মান্তিক মৃত্যু।
কিন্তু নিজের বিপদ হতে পারে, সামাজিক ভাবে অসুবিধা হতে পারে, এ সব জেনেও কেন এমন দেখতে ও দেখাতে চাওয়ার ইচ্ছা, কেন এমন আচরণ? বস্তুত, এটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন অনেক তাত্ত্বিকই। তাঁদের মধ্যে আমেরিকার সমাজতাত্ত্বিক আরভিং গফম্যানের কথা মনে পড়তে পারে। তাঁর ‘ইমপ্রেশন ম্যানেজমেন্ট’-এর তত্ত্ব বলে, সমাজে মানুষ কাউকে কী ভাবে, কতটা মেনে নেবেন, তা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট মানুষকে তিনি কী ভাবে নিজেকে দেখাতে চান। ফলে তাঁর বেশভূষা, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, সবই প্রভাবিত হয় সমাজে ‘মেশার’ তাগিদে। আবার, ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের বুর্দিউ-এর একটি তত্ত্ব বলছে, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এমন নানা ধরনের পুঁজি বা ক্যাপিটাল রয়েছে ব্যক্তি-মানুষের। তারই একটি হল ‘কালচারাল ক্যাপিটাল’। এই সাংস্কৃতিক পুঁজির আওতায় পড়ে শিক্ষাগত ডিগ্রি, মূল্যবান বই, ছবির মতো জিনিসপত্র থেকে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা। আমরা মনে করি, এই পুঁজিগুলিই সমাজে আমাদের অবস্থানের চিহ্ন হিসাবে কাজ করে।
আদতে এই ‘মিশে যাওয়ার তাগিদ’ বা সামাজিক অবস্থানগত কারণেই হয়তো ‘দেখা ও দেখানো’র প্রবণতাও লাগাম ছেড়েছে। তাতে সঙ্গত দিচ্ছে ডিজিটাল যুগ। আমাদের দিনের সিংহ ভাগ কাটে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে পোস্ট হওয়া ‘কন্টেন্ট’ দেখে। কিন্তু আমরা যা দেখছি, অর্থাৎ কী পণ্যকে গ্রহণ করছি, সেই ধাঁচটা আবার প্রভাবিত হচ্ছে গণমাধ্যম দ্বারা, সেটা খবরের চ্যানেলের সরাসরি সম্প্রচার হতে পারে বা সমাজমাধ্যমে পোস্ট হওয়া বিভিন্ন ‘ভ্লগ’, ‘রিল’, ‘লাইভ’ বা ছবি, এ সবও হতে পারে। এই দেখার সংস্কৃতির সঙ্গেই দেখানোর প্রবণতা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আর এই সূত্রেই বাড়তে থাকে ‘যদি সর্বপ্রথম আমি পৌঁছে যাই দুর্যোগের জায়গায়?’ ‘সবার আগে পোস্ট করি এক্সক্লুসিভ ছবি-ভিডিয়ো?’ এমন ইচ্ছাগুলোও।
কিন্তু এই অতি-ইচ্ছা বা আগ্রহ দিনে দিনে আমাদের অসংবেদনশীল করে তুলছে। একটা সময় ছিল, যখন দুর্যোগ আসার আগে মানুষ একে অপরকে সতর্ক করতেন। বিপদের সম্ভাবনার কথা জানলে সমবেত ভাবে সকলে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে জরুরি পদক্ষেপ করতেন। মৃত্যুর ঘটনায় শোকপ্রকাশ হত নিজেদের মধ্যে, খবর দেওয়া হত নিকট পরিজনকে। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ মর্মান্তিক ঘটনা ফ্রেমবন্দি করে রাখছেন কাছের ও দূরের মানুষ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তা পোস্ট হচ্ছে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে, দাবানলের মতো তা ছড়িয়েও পড়ছে অন্যের কাছে। সমবেদনা জানাতে হলেও তা প্রকাশ পাচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়াতেই।
সাম্প্রতিক সময়ে ওই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে মানুষের এই অতি-উৎসাহ সম্পর্কে একটি শব্দবন্ধ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, ‘ডার্ক টুরিজ়্ম’ বা আঁধার পর্যটন। বিশ্বে এমন বহু পর্যটক রয়েছেন যাঁরা দুঃখের, যুদ্ধের, ধ্বংসের জায়গা দেখতে পছন্দ করেন। সেখানকার ইতিহাস, মানুষজনের কষ্ট, ক্ষতির বিষয়ে জানতে, সহমর্মী, সহানুভূতিশীল হতে চান। এটাকেই বলে আঁধার পর্যটন। যেমন, জালিয়ানওয়ালা বাগ, চের্নোবিল পরমাণুকেন্দ্র, হিটলারের তৈরি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ ইজ়রায়েলের যে এলাকায় হামাসের হামলায় প্রাণ হারাতে হয়েছিল বহু মানুষকে— এই সব এলাকায় পর্যটনকে এর আওতায় ফেলা যায়। একই ভাবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছিল, এমন জায়গায় ঘুরতে গেলে সেটা হয় ‘ডিজ়াস্টার টুরিজ়্ম’-এর অঙ্গ। এই ধরনের পর্যটন আখেরে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, সামাজিক সহমর্মিতা তৈরির ক্ষেত্রে সহযোগী ভূমিকা নেয়।
কিন্তু যাঁরা দুর্যোগের সময়ে বা তার আগে-পরে গিয়ে স্রেফ উৎসাহ চরিতার্থ করতে যাচ্ছেন এবং তা অন্যকে দেখাচ্ছেন, বা দেখাবেন বলে ভাবছেন, সেটা আর যা-ই হোক, শুভবুদ্ধির কাজ বলা চলে না। সেই সঙ্গে একটা প্রশ্নও থাকছে, গতিশীল ভার্চুয়াল দুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গত করতে গিয়ে এমন দেখা ও দেখানোর চেষ্টা আদতে ঘটনাগুলির অস্তিত্ব ও গুরুত্বও ক্ষণস্থায়ী করে তুলছে না তো? মানুষের কাছে পৌঁছতে গিয়ে আমরা আরও অমানবিক হয়ে উঠছি না তো!