১জুলাই থেকে পশ্চিমবঙ্গে ৭৫ মাইক্রনের কম ঘনত্বযুক্ত এবং এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদন, বিপণন, মজুতদারি, বিক্রয় এবং ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল। রাজ্যের পরিবেশ দফতরের পক্ষ থেকে আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্লাস্টিক নামক সর্বগ্রাসী এবং সর্বব্যাপী ম্যাজিক পলিমার-পূর্ববর্তী জীবন কেমন ছিল, তা ধরা আছে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ছায়াছবির কয়েকটি দৃশ্যে। সর্বজয়ার হেঁশেলের দেওয়ালে ঝোলানো দড়িবাঁধা কাচের শিশি এবং পাঠশালা-মুদিখানায় কাগজের ঠোঙায় ভরে প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের চাল ওজন করা কিংবা ছোট্ট মেয়েটির শাড়ির আঁচলে এক পয়সার নুন ঢেলে দেওয়ার মধ্যে সেই সময়কার চিত্র যেন জীবন্ত হয়ে আছে। বস্তুত মাত্র কয়েক দশক আগেও এটাই ছিল আমাদের স্বাভাবিক জীবনচিত্র। বাজার থেকে মাছ বা মাংস আনার জন্য ছিল কাপড় বা চটের থলি কিংবা কঞ্চি দিয়ে বোনা কলসাকৃতির খালুই, তেল আসত গলায় দড়ি বাঁধা কাচের শিশিতে, আইসক্রিম নামক রঙিন বরফ ধরার জন্য থাকত বাঁশের কাঠি। উৎসব-অনুষ্ঠানে পাত পেড়ে খাওয়ার জন্যে পড়ত কলাপাতা, কোথাও বা পদ্মপাতা। গরম ভাত-তরকারির ভাপে আমরে ওঠা সবুজ পাতা থেকে অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ ছড়াত।
দৈনন্দিন যাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠা প্লাস্টিক জল, বায়ু এবং মাটিকে প্রতিনিয়ত দূষিত করে জল, স্থল, অন্তরিক্ষে বসবাসকারী অসংখ্য প্রাণী-উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। মাত্রাহীন প্লাস্টিকের ব্যবহার শহুরে নিকাশিব্যবস্থা থেকে শুরু করে বাস্তুতন্ত্রকে পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে তুলেছে। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে শুধুমাত্র প্লাস্টিক জমা হয়ে ৬০০ বর্গকিলোমিটার ভাসমান দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য বহু সামগ্রীতেই প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় অপরিহার্য। মগ, বালতি, জলের বোতল থেকে শুরু করে কম্পিউটারের নানা যন্ত্রাংশ, এমনকি কারেন্সি নোটে পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। অর্থাৎ, আমরা কিছুটা জেনেশুনেই এই নীরব ঘাতকের সঙ্গে সহবাসে বাধ্য হচ্ছি।
প্লাস্টিকের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রধান সমিতি এবং সংগঠনগুলিকে নিয়ে গঠিত ‘প্লাস্টিন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৭-১৮ সালে ভারতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের পরিমাণ ছিল ১৬.৫ মিলিয়ন টন! ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, এ দেশের ৬০টি বড় শহরের দৈনিক প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টির পরিমাণ প্রায় ২৫৯৪০ টন। প্রশ্ন হল, শুধুমাত্র এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধ হলেই কি আমরা প্লাস্টিকের কুপ্রভাব থেকে মুক্তি পাব? প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর মোড়ক হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের দিকেও নজর ঘোরানো দরকার। ‘ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স’-এর হিসাব অনুযায়ী, ভারতে মোট ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৪৩ শতাংশ পণ্যসামগ্রী মোড়কের কাজে ব্যবহার হয়। এই প্লাস্টিকও কিন্তু দ্বিতীয় বার ব্যবহার করা যায় না।
প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে যখন সারা বিশ্বে ‘গেল গেল’ রব, তখন ভারতের চিত্রটা কেমন? কয়েক দশক ধরে বেশ কিছু রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্লাস্টিক ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করে যাচ্ছিল। অবশেষে ২০১১ সালে ভারত সরকার ‘প্লাস্টিক ওয়েস্ট (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হ্যান্ডলিং) রুলস, ২০১১’ প্রণয়ন করে। এতে পলিব্যাগের উপর মূল্য আরোপ এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে পুনর্ব্যবহারের জন্যে প্রক্রিয়াকরণের নিয়ম তৈরি করতে বলা হয়। ২০১৬ সালে ‘প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুলস’-এ ৫০ মাইক্রনের কম ঘনত্বযুক্ত সমস্ত প্লাস্টিককে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ধাপে ধাপে বহুস্তরযুক্ত মোড়কের প্লাস্টিক হ্রাসের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া, নিঃশেষিত না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃতি-সহায়ক উপায়ে এগুলির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব উৎপাদক, ব্র্যান্ড-মালিক ও আমদানিকারকদের উপর ন্যস্ত করা হয়। অবশ্য পরবর্তী কালে এই আইনকে কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।
৭৫ মাইক্রনের কম ঘনত্বযুক্ত প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণের পাশাপাশি প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্টে এ রাজ্যের কিছু উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কেন্দ্রের প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট (অ্যামেন্ডমেন্ট) রুলস, ২০২১ এবং প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট (অ্যামেন্ডমেন্ট) রুলস, ২০২২-এর কথা উল্লেখ করে জানিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২-এর পর ১২০ মাইক্রনের চেয়ে পাতলা প্লাস্টিক বা পিভিসি ব্যবহার করা যাবে না। তবে অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এই বিজ্ঞপ্তি শুধু কাগজবন্দি হয়ে থাকবে না তো?
তবে এ কথাও সত্যি, শুধুমাত্র সরকারের উপর দায় চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা যায় না। ব্যাগ নিয়ে দোকান-বাজারে যাওয়া কিংবা অনুষ্ঠানে কলাপাতা বা শালপাতার ব্যবহার কী এমন কঠিন কাজ? এ ব্যাপারে নিজেদের সচেতনতাই শেষ কথা।