একের পর এক মন্দির-মসজিদ বিতর্ক এখন মামলার পথই নেবে
Ram Mandir

আন্দোলনের দরকার কী

২০১৯-এর নভেম্বরে, এক শীতের সকালে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিল।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২২ ০৪:৩৯
Share:

অতঃপর: বর্তমান বিরোধের কেন্দ্র মথুরার কৃষ্ণজন্মস্থান মন্দির ও শাহি ইদগা। মন্দির-মসজিদের পাশাপাশি এই অবস্থান কয়েক শতাব্দীর গৌরব। পিটিআই

নরেন্দ্র মোদীর কথায় ও কাজে বিস্তর ফারাক বলে নিন্দুকদের দাবি। আরএসএস সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের সে দুর্নাম নেই। তিনি যা বিশ্বাস করেন, তা-ই বলেন।

Advertisement

২০১৯-এর নভেম্বরে, এক শীতের সকালে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিল। সে দিনই মোহন ভাগবত বলেছিলেন, আরএসএস আর বারাণসী, মথুরা নিয়ে আন্দোলনে নামবে না। সঙ্ঘ এমনিতেই কোনও আন্দোলনে জড়ায় না। তার প্রধান কাজ চরিত্র গঠন।

মোহন ভাগবতের এই কথা প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাননি। কারণ রামমন্দির আন্দোলনের সময়ই তো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বলে রেখেছিল, ‘অযোধ্যা তো বাস ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’! বাবরি মসজিদের জমিতে রামমন্দিরের জন্য আন্দোলন শুধুই সূত্রপাত। এর পরে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহি ইদগার জমিতেও মন্দিরের দাবি তোলা থাকল। বাবরি মসজিদ ভাঙা ঘোর অন্যায় হয়েছিল বলেও সুপ্রিম কোর্ট সেখানে রামমন্দির তৈরির পক্ষেই রায় দেওয়ায় অযোধ্যার সাধু, হিন্দুত্ববাদীদের দিকচক্রবালে কাশী-মথুরায় মন্দিরের দৃশ্য ভেসে উঠতে দেরি হয়নি। তাঁরা বলতে শুরু করেন, ‘অযোধ্যা, মথুরা, বিশ্বনাথ, তিনো লেঙ্গে এক সাথ’! কিন্তু খোদ সরসঙ্ঘচালক উল্টো সুর ধরেন। রামমন্দির আন্দোলনে আরএসএস-ই প্রধান হোতা হলেও ভাগবতের দাবি ছিল, অতীতে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। তাই সঙ্ঘ রামজন্মভূমি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল। এ বার আরএসএস ফের চরিত্র গঠনে মন দেবে।

Advertisement

মাঝে আড়াই বছর অতিক্রান্ত। বারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদ আদতে কাশীর বিশ্বনাথের জমি, মথুরার ইদগার জমির মালিক শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান বলে দাবি উঠে গিয়েছে। ঠিক যেমন বাবরি মসজিদের জমির মালিক রামলালা বিরাজমান বলে দাবি উঠেছিল। রামজন্মভূমি আন্দোলনের সময় ঠিক যেমন প্রথমে কিছু ছোটখাটো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দাবি তুলতে শুরু করেছিল, এ বারেও ঠিক তা-ই। মোদী, শাহ, যোগীরা এখনও নীরব। মন্দির-মসজিদ নিয়ে গোলমাল বাধানোর দরকার নেই, এমন বলছেন না। বরং আদালতে মামলার পিছনে বিজেপি-আরএসএসের পরোক্ষ মদত সুস্পষ্ট।

প্রশ্ন হল, আরএসএসের পক্ষে কি আবার রামমন্দির আন্দোলনের মতো কাশী-মথুরায় মন্দিরের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব?

১৯৯২-এ লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশী, অশোক সিঙ্ঘলদের সামনে যখন বাবরি মসজিদ ভাঙা হচ্ছে, বিজেপি তখনও দিল্লির মসনদ থেকে অনেক দূরে। এখন সেই আডবাণী, জোশীরা বিজেপির মার্গদর্শক মণ্ডলীতে। তাঁদের কাছে কে, কত বার মার্গদর্শন চাইতে যান, সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু বিজেপি এখন নিজেই ক্ষমতায়। কেন্দ্রে। উত্তরপ্রদেশেও। এখন তা হলে সঙ্ঘপরিবার কার কাছে ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’ বলে দাবি তুলবে? কার সামনে আন্দোলন করবে? উত্তর হল, কাশী-মথুরায় মন্দিরের দাবিতে রামমন্দির আন্দোলনের মতো আরও একটা আন্দোলন এখন আর সম্ভব নয়। তার থেকেও বড় কথা, আর এর প্রয়োজনও নেই।

প্রথমত, বিজেপি ক্ষমতায় এলেও সেই সরকারকে যে ধর্মনিরপেক্ষতার গণ্ডিতে আটকে থাকতে হবে, এমন নয়। রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিবাদে সুপ্রিম কোর্ট শুধু রামমন্দিরের পক্ষেই রায় দেয়নি, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের দূরত্বও মুছে দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকেই রামমন্দির নির্মাণের জন্য ট্রাস্ট তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর তাই মন্দিরের ভূমিপুজোয় সমস্যা হয়নি। ভবিষ্যতে কেন্দ্র বা উত্তরপ্রদেশ সরকার কাশী-মথুরায় মন্দির তৈরিতে হস্তক্ষেপ করবে না, তা হলফ করে বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, তিন দশক আগে যখন রামমন্দির আন্দোলন তুঙ্গে উঠছে, তখন এ দেশে মুক্ত অর্থনীতির খোলা বাতাস ঢোকেনি। আর্থিক সংস্কারের তিন দশকের সুফলে দেশের অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমৃদ্ধি ঘটেছে। মোবাইলে আঙুলের ছোঁয়ায় যেমন বিশ্ব বাজারের যাবতীয় পণ্য ঘরের দুয়ারে চলে আসে, তেমনই মোবাইলের কারসাজিতেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ত্রিভুবনে ছড়িয়ে যায়। ধর্মের নামে অসন্তোষ তৈরি করতে আর রাস্তায় ভিড় জমানোর দরকার পড়ে না। ফেসবুক-টুইটারে সক্রিয় বাহিনীই যথেষ্ট। লাভ জেহাদ, বোরখা বা মসজিদের লাউডস্পিকার নিয়ে বিবাদ তৈরিতে তাই কোনও প্রথম সারির হিন্দু নেতাকে মাঠে নামতে হয়নি। এখন দু’এক বার ‘জয় শ্রীরাম’ আওড়ালে বা জনা তিনেক মিলে কুতুব মিনারের সামনে ‘হনুমান চালিসা’ পাঠ করলেই মোবাইলে তা ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

তৃতীয়ত ও সর্বোপরি, গত তিন দশকে দেশের রাজনীতিতেও মূলগত বদল এসেছে। রামশিলা নিয়ে যখন করসেবকরা অযোধ্যা যাত্রা করছেন, তখনও দেশের নির্বাচনে হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের পৃথক অস্তিত্ব তৈরি হয়নি। হিন্দুরা ভোটার হিসেবে পৃথক রাজনৈতিক পরিচিতিও পাননি। যে দেশে হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু, সে দেশে ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ বলে গেল, গেল রব তোলা তখনও কঠিন ছিল। রামমন্দির আন্দোলন হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের পৃথক অস্তিত্বকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন হিন্দুরা পুজোর অধিকার থেকে বঞ্চিত বলে আওয়াজ তোলা যায়। কিন্তু তাতে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক মুষড়ে পড়ে না। বরং সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করে সংখ্যাগুরুর দাপট দেখানোই এখন প্রকৃতির নিয়ম। ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়ো তুলে আর তাকে আটকানো মুশকিল। কোনও এক রাহুল গান্ধী সংবিধানের মূল ভাবনার কথা বলে চলেছেন। তা দিয়ে রাজনীতির চিঁড়ে ভিজছে না।

মোদ্দা কথা হল, রামমন্দির আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি ছাড়াই বিজেপি-আরএসএস এখন কাশী-মথুরা নিয়ে হিন্দুত্বের আঁচে প্রয়োজন মতো রাজনীতির রুটি সেঁকতে পারে। তার জন্য করসেবকদের দরকার নেই। মসজিদ ভাঙার জন্য লোক খেপানোর দরকার নেই। এই যে আজ বারাণসী, কাল মথুরা, পরশু ইলাহাবাদ হাই কোর্ট, তরশু সুপ্রিম কোর্টে কাশী-মথুরা নিয়ে মামলা চলছে, তাতেই হিন্দুত্ব ও মেরুকরণের রাজনীতি ধিকিধিকি জ্বলতে থাকবে। বারাণসী, মথুরায় মন্দিরের দাবিতে মামলাকারী আইনজীবী বিষ্ণুশঙ্কর জৈন বলে দিয়েছেন, হিন্দুদের পুজোর অধিকার না ফেলা পর্যন্ত কোনও না কোনও আদালতে আইনি লড়াই চলতেই থাকবে। আর মামলা চলার অর্থ মন্দির-মসজিদ বিতর্কও জিইয়ে রাখা। ফেসবুক-টুইটারে জ্ঞানবাপী মসজিদের উঠোনে শিবলিঙ্গ না ফোয়ারা নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা চলবে। সঙ্গে ফাউয়ের মতো কখনও দিল্লির কুতুব মিনার, কখনও আগরার তাজমহল, কখনও লখনউয়ের তিলেওয়ালি মসজিদেও দেবতা বিরাজমান বলে পুজোআচ্চার দাবি উঠবে।

এ সবের মাঝে বেকারত্বের হার বাড়ল না কমল, কত জন মহিলা রোজগারের সুযোগ না পেয়ে কাজ খোঁজাই বন্ধ করে দিলেন, কেউ এ সব প্রশ্ন তুলবে না। পাঁচ হিন্দু মহিলা যে জ্ঞানবাপীর চত্বরে মা শৃঙ্গার গৌরীস্থলে পুজোর দাবিতে মামলা ঠুকে দিলেন, তা নিয়েই সবাই মাতোয়ারা হয়ে উঠবে।

মোহন ভাগবত প্রতিশ্রুতি না দিলেও এ দেশে আরও একটা রামমন্দির আন্দোলন হবে না বলে অনেকের বিশ্বাস ছিল। কারণ তিন দশক আগে তৈরি উপাসনাস্থল রক্ষা আইন। যাতে বলা ছিল, ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেখানে যেমন মন্দির, মসজিদ রয়েছে, তেমনই থাকবে। কোনও ভাবেই তার চরিত্র বদল করা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বই হবে মন্দির, মসজিদ যেখানে যেমন রয়েছে, তা রেখে দেওয়া। সেই আইন মেনে আর মসজিদ ভাঙতে দেওয়া হবে না বলে আদালতের উপরে ভরসা ছিল।

স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতীকস্বরূপ সেই উপাসনাস্থল রক্ষা আইনই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। মসজিদের জায়গায় মন্দিরের আর্জিতে মামলা হলে প্রথমেই তা আদালতের আবর্জনার ঝুড়িতে স্থান পাবে বলে মনে করা হত। অথচ, বারাণসী-মথুরা নিয়ে মামলায় আদালতে শুনানির তারিখের পর তারিখ স্থির হয়ে চলেছে। অযোধ্যার পথে মন্দির আন্দোলন উঠে এসেছে বিচারপতিদের এজলাসে।

সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত ঠিকই বলেছিলেন। কাশী-মথুরা নিয়ে সঙ্ঘ আন্দোলনে নামবে না। আদৌ তার প্রয়োজন নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement