মনে রাখি যে, ২০২৪ সালের ঘটমান অক্টোবরে, ‘অভয়া’-র বিচার চেয়ে রাজ্যব্যাপী গণআন্দোলন চলার কালেও, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর চব্বিশ পরগনা, মালদহ, নদিয়ায় ধর্ষণ ও খুনের রোজনামচা লেখা হচ্ছে। এখনই, এক অগ্নিদগ্ধ কিশোরীর সম্ভাব্য অতীতচরিত শোনা যাচ্ছে নদিয়ার হাওয়ায় কান পাতলেই। অথচ, এক অপ্রাপ্তবয়স্কের এমন ভয়ঙ্কর মৃত্যু হতে পারত বিশুদ্ধ ভাবে শোকবহ। ধৃত জনও যে সদ্য-প্রাপ্তবয়স্ক, সে তথ্য আগামী প্রজন্মকে নিয়ে নিখাদ দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারত।
এ কথাও মনে থাকুক যে, প্রাণে-বেঁচে যাওয়া নির্যাতিতার চেয়ে বেশি জন-সংবেদনা আবর্তিত হচ্ছে খুন-হওয়া নির্যাতিতাদের ঘিরে। সাত থেকে দশ বছর বয়সি ধর্ষিত-নিহতরা হয়তো ‘ভিক্টিম-ব্লেমিং’-এর শিকার হচ্ছিল না। কিন্তু বয়স তার বেশি হলেই, ব্যবচ্ছেদ চলছিল মৃতা-নির্যাতিতার ‘চরিত্র’-এর। ‘রাতে বেরোনো’-র অবধারিত পরিণতি ধর্ষণ— এই ভাষ্যও ফিরে আসছিল।
অথচ আড়াই মাসের এই আন্দোলনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল ১৪ অগস্ট মেয়ে-ট্রান্স-কুইয়র মানুষের ‘রাতদখল’, যা ডাক্তারদের আন্দোলনকে গণআন্দোলনে পরিণত করেছিল। অবশ্য জনতার মনোযোগ লিঙ্গরাজনৈতিক আন্দোলন থেকে স্বাস্থ্য-আন্দোলনে সরে যেতে সময় লাগেনি। জুনিয়র চিকিৎসকরা জনসমর্থন পেয়েছেন, কারণ তাঁরা সফল ভাবে জনগণকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে, অভয়ার মৃত্যুর জন্য সম্ভবত দায়ী যে সিন্ডিকেট, তা চিকিৎসাব্যবস্থারও ক্ষতিসাধন করছে। লিঙ্গরাজনৈতিক আন্দোলনটিও গড়ে উঠেছিল একই রকম একাত্মতা থেকে। সাধারণ মেয়ে-ট্রান্স-কুইয়ররা যৌনহিংসা, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা এবং নির্যাতিত/নিহতকে দোষারোপের চেষ্টাকে নিজেদের অভিজ্ঞতায় চেনেন। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উদ্গিরণ ঘটেছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল ফলল কতটা?
আর জি করের নিগৃহীতা মেয়েটি ছিলেন কৃতী ছাত্রী, চিকিৎসক। রাতে তিনি অভিসারে বেরোননি, ছিলেন কর্তব্যে নিয়োজিত। সমবেদনা জাগাতে গেলে নারীর শুধু নির্যাতিত হলে চলে না, হতে হয় এমন ‘নিখুঁত ভাল মেয়ে’। লিঙ্গরাজনৈতিক আন্দোলনের কাজ হল, ‘ভাল মেয়ে’ আক্রান্ত হওয়ার পর স্বতঃস্ফূর্ত যে অভ্যুত্থান হয়েছে, তাকে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে জনচেতনা জাগ্রত করা সব মেয়ে ও প্রান্তলিঙ্গযৌনতার মানুষের জন্য, যাতে ভরা সভায় কোনও বিশিষ্টজন আর না বলেন: “এ ঘটনা সোনাগাছিতে ঘটলে মেনে নিতাম, কিন্তু সরকারি হাসপাতালে!” এই ধর্ষণ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই লিঙ্গ-আন্দোলনের যুদ্ধ, যেখানে ‘ভাল নির্যাতিত’র ধর্ষণ নিন্দিত, কিন্তু ‘মন্দ নির্যাতিত’র ধর্ষণ জলভাত। লিঙ্গ-আন্দোলন তাই ডাক্তারদের আন্দোলনের সঙ্গে কোনও কোনও মুহূর্তে এক বিন্দুতে মিলতে পারে। কিন্তু তার ছায়াসহচর হতে পারে না।
অথচ ‘রেপ কালচার’ পরিভাষাটির জায়গা ক্রমশ নিল ‘থ্রেট কালচার’। নবলব্ধ দ্বিতীয় শব্দবন্ধটির দ্বারা ডাক্তাররা বুঝিয়েছেন, হাসপাতালের পরিসরে শাসক দল-পোষিত অধ্যাপক ও পড়ুয়া কর্তৃক দুর্নীতি ও হুমকির বাড়বাড়ন্ত, যা চরম পর্যায়ে ধর্ষণ ও হত্যা ঘটায়। কিন্তু ‘রেপ কালচার’ এর চেয়ে অনেক বেশি মূলগত। শুধু দুর্জনের হুমকিতে নয়, সুজনের আদরে-সোহাগে-রসিকতায়, পারিবারিক বা স্কুল শিক্ষায়, ভাষায়-সাহিত্যে-শিল্পে তার প্রকোপ বর্তমান। লিঙ্গরাজনীতির আওতায় পড়ে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত যাপন। বৈষম্যের শিক্ষাকে মুছতে মুছতে, নতুনকে শিখতে শিখতে এগোতে হয়। অপরায়নের স্থান সেখানে নেই। আত্মমন্থন কঠিন বলে হয়তো তাতে অংশগ্রহণের হার দুর্জন-বিরোধিতার চেয়ে কম।
শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছিল, অভয়ার জায়গায় কোনও ছেলে থাকলেও কি সে খুন হত না? কেউ বলেছিলেন, এ ক্ষেত্রে খুনই মুখ্য, ধর্ষণ নয়। বিলকিস বানোর ধর্ষণকে কি আমরা তা হলে লিঙ্গহিংসা নয়, কেবল সাম্প্রদায়িক হিংসা বলব? কিছু হিংসা লিঙ্গনির্বিশেষে ঘটে। আবার হিংসার কিছু রূপ অভয়ার ‘প্রাপ্য’ হয়েছিল নারী হিসাবেই। দ্বিতীয় অংশটিকে কম গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা যে আত্মঘাতী হতে পারে, তা প্রমাণ করেছিল পরবর্তী কালে নানা অন্তঃকলেজ তদন্ত। বর্ধমানে বা আর জি করে হুমকি-প্রথা সম্পর্কে কলেজ কমিটি যে রিপোর্ট পেশ করেছে, সেখানে যৌন নির্যাতনের উল্লেখ আছে বার বার। বর্ধমানে গেস্ট হাউসে যে ছাত্রীদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আগে বলা হত, ওদের মধ্যে অনেকেই ‘নম্বরের মোহে আপস করে’। একেই বলে ‘ভিক্টিম-ব্লেমিং’। এত দিনে অভিযোগের তির ঘুরেছে তাদের দিকে, যারা নম্বর বাড়ানোর বা পাশ করানোর জন্য মেয়েদের এমন শর্ত দেয়।
এ সব সম্ভব হয়েছে মেয়ে-ডাক্তারদের সঙ্গে লিঙ্গরাজনীতির আন্দোলনকালীন আদানপ্রদানের ফলে। দ্বিতীয় বার কর্মবিরতি এঁদেরই চাপে হয়েছিল, যাঁরা সাগর দত্ত কলেজে ‘আর জি কর করে দেব’ শুনে বেঁকে বসেছিলেন। আপাত-নিরাপদ বৈষম্যের কথাও তাঁরা বলছেন। বলছেন, অস্থিচিকিৎসাবিদ্যা কেন অলিখিত ভাবে ‘ছেলেদের বিষয়’? বলছেন, যৌন হয়রানির ঘটনা এই সিন্ডিকেটের আমলে বেড়েছে, কিন্তু আগেও ছিল। তাঁরা নতুন করে ‘প্রিভেনশন অব সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ (পশ) আইন পড়ছেন, নিজ নিজ কলেজের আইসিসি-র গঠনগত গাফিলতি বুঝতে পারছেন।
কিন্তু কেন ‘পশ’ আইন বা আইসিসি-র গঠন সম্পর্কে অবগত ছিলেন না তাঁরাও, যাঁরা উক্ত সিন্ডিকেট রাজের আগে পাশ করেছেন? কর্তৃপক্ষ যখন পড়ুয়াকে এই আইন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল করে না, তখন সেও পরোক্ষে ধর্ষণ সংস্কৃতিতে মদত দেয় না কি? ‘থ্রেট কালচার’ যখন ছিল না, তখনও তা হলে ‘রেপ কালচার’ ছিল! আন্দোলন যদি সিন্ডিকেটকে উপড়ে ফেলতে পারে, তবুও সব ধরনের যৌন নির্যাতন নির্মূল হবে কি?
সাধারণ মেয়েদের জীবনেও ডাক্তার-মেয়েদের মতো উথালপাথাল ঘটেছে। এক মেয়ে বলেছিলেন, কলেজ-কালে লাইব্রেরি কার্ড হারিয়ে রুটিনমাফিক পুলিশ-ডায়েরি করতে যেতেও ভয় পেয়েছিলেন তিনি। অথচ এ বেলা আরও দু’জনকে জুটিয়ে হাজির হয়েছিলেন স্থানীয় থানায়, পুলিশকে ‘রাতদখল’-এর এত্তেলা দিতে। এক গৃহবধূ জানিয়েছিলেন, সন্তানের মুখেভাতে যে ডেকরেটর্স চেয়ার জুগিয়েছিলেন, তাঁরই দ্বারস্থ হয়েছিলেন আন্দোলন-রাতের চেয়ারের জন্য। পরিবার থেকে পুলিশ— নানা ভয় জয় করে, সাংসারিক ও পেশাগত ব্যবস্থাপনা-বুদ্ধিকে আন্দোলনের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত করেছিলেন তাঁরা। হয়তো ভবিষ্যতে দলবদ্ধ ভাবে তাঁরা থানায় যেতে ভয় পাবেন না। হয়তো আঞ্চলিক ভাবে কোনও নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াতে পারবেন।
কিন্তু আরও কী কী হতে পারত? এক দিকে, মেয়ে-ট্রান্স-কুইয়র মানুষেরও নিজস্ব দাবিদাওয়া গড়ে উঠেছে এই আন্দোলন ঘিরে। কিন্তু সরকার তাঁদের ‘স্টেকহোল্ডার’ মানেনি, আলোচনাতেও ডাকেনি। সরকার আলোচনায় ডাকে তখনই, আন্দোলনের পক্ষে যখন জনসমর্থন সর্বোচ্চ থাকে। সে জনসমর্থন কি এই মুহূর্তে লিঙ্গ-আন্দোলনের আছে? জনমত তৈরির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার অতএব। অন্য দিকে, ‘এসো রাতের দখল নিই’ যখন উচ্চারিত হয়েছিল, তখন তা ছিল নির্যাতিতাকে দোষারোপ করার কু-অভ্যাসের বিরুদ্ধে সরাসরি নারীবাদী প্রতিরোধ। ধর্ষিতার চরিত্রের থেকে ধর্ষকের বিকার ও ধর্ষণের নৃশংসতার দিকে যখন নজর ঘুরবে, তখনই সমাজমানসে লুকিয়ে থাকা সেই নারীবিদ্বেষ আলোচনায় আসবে, যার চরম রূপ হল ধর্ষণ করে খুন। ধর্ষণ সংস্কৃতি-বিরোধী সেই প্রকল্পও পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন।
আঙ্গিকও বদলাতে হতে পারে। আন্দোলন দখল করতে চাওয়া রাজনৈতিক দল ও শুধু ডাক্তারদের আন্দোলনে মনোনিবেশ করা নাগরিকদের দোষারোপ করা যথেষ্ট নয়। বুঝতে হবে যে, লিঙ্গরাজনীতিকে বিদগ্ধ ঘেরাটোপে আটকে রাখলে চলবে না। যে ভাষা ১৪ অগস্ট শাঁখাপলা পরে রাত দখল নিতে বেরোনো বধূটির, সে ভাষাতেও লিঙ্গসাম্যের ভাবনা ব্যক্ত করতে হবে। বুঝতে হবে, বিজেপির গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে শাঁখ-বাজানো ছিল, কিন্তু যে দেশে সন্ধেবেলা ঘরে-ঘরে শাঁখ বেজে ওঠে, সেখানে প্রত্যেক শঙ্খবাদিকা বিজেপি না-ই হতে পারেন। জ্ঞানপুঁজির ভিত্তিতে বর্জন আর ছুতমার্গের রাজনীতি এখন নিষ্ফলা। লিঙ্গরাজনৈতিক আন্দোলনকে সর্বোচ্চ জনসমর্থন পেতে হলে, নিজের লক্ষ্য স্থির রেখেও, প্রকাশভঙ্গি বদলাতে হবে। হতে হবে সর্বজনীন।