পশ্চিমবঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩-এর মার্চ মাস অবধি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের সাতাশটি ঘটনায় নব্বই জন মারা গিয়েছেন। প্রতীকী চিত্র।
এগরার খাদিকুলে বিস্ফোরণের ঘটনার এগারো দিন পরে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমা চাইলেন। বললেন, এমন অবৈধ বাজি উৎপাদনের কথা তিনি জানতেন না। এমন ঘটনা পুলিশকে জানাতে, কাজ না হলে মুখ্যমন্ত্রীকেই জানাতে পরামর্শ দিলেন তিনি। অসরকারি সংস্থার সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩-এর মার্চ মাস অবধি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের সাতাশটি ঘটনায় নব্বই জন মারা গিয়েছেন— কেবল তৃণমূল আমলেই ছিয়াত্তর জন মারা গিয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন ছত্রিশ জন। সবই কি মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে ঘটেছে?
প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, বড়সড় দুর্ঘটনার পর অভিযুক্তরা প্রথমে গা ঢাকা দিয়েছে, পরে ফের সক্রিয় হয়েছে, বেআইনি বাজি কারখানা চালু করেছে আগের মতো। এগরায় প্রধান অভিযুক্ত কৃষ্ণপদ ওরফে ভানু বাগের ইতিহাস থেকেই তা স্পষ্ট। বজবজের নন্দরামপুর, দাসপাড়ার বাজি কারখানা থেকে যে বিপুল পরিমাণ বাজির মশলা মজুত হয়েছিল, তা কি পুলিশ জানত না?
এগরাতে মহিলারাই আহত, নিহত হয়েছেন বেশি, বজবজে নিহত হয়েছেন দুই মহিলা ও এক বালিকা। কারণ, মেয়ে ও শিশুরাই বেশি কাজ করে বাজি কারখানায়। ১৯৯৫ সালে বাগনানের হাতুরিয়ায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে তেরো জন শিশুশ্রমিক মারা যায়। কলকাতা হাই কোর্টে মামলা হয়, বিচারপতি এস বি সিন্হা নির্দেশ দেন নিহত শিশুশ্রমিকদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দিতে, এবং সমস্ত অবৈধ কারখানা বন্ধ করতে। তা যে হয়নি, তার বড়সড় প্রমাণ মিলল ২০১৫ সালে— পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত হয় সাত জন শিশু। মুর্শিদাবাদের সুতি থেকে তাদের এনে কার্যত বন্দিদশায় কাজ করানো হচ্ছিল। এর পরেও বাজি তৈরিতে শিশুদের কাজে লাগানো বন্ধ হয়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, এগরার ওই কারখানাটিতে কি কেবলই বাজি বানানো হচ্ছিল, না বোমাও তৈরি হচ্ছিল? ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল (বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার) ২০১৫ নভেম্বর এবং ২০১৬ অগস্ট-এর দু’টি নির্দেশে স্পষ্ট বলেছে, রাজ্যে বাজি কারখানার আড়ালে বোমা তৈরি হয়, এবং কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় প্রচুর বেআইনি বাজি কারখানা চলছে। অতি দ্রুত রাজ্য সরকারকে সমস্ত বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করতে নির্দেশ দেয় জাতীয় পরিবেশ আদালত। তার সাত বছর পেরিয়ে ঘটল এগরা, বজবজের ঘটনা।
নাগরিক সংগঠন বা পরিবেশ-কর্মীরা অবৈধ কারখানার হদিস দিলেও ব্যবস্থা করে না পুলিশ। এগরার ঘটনার পরে হুগলির ‘বাজি ও ডিজে বক্স বিরোধী মঞ্চ’ পুলিশ সুপারকে চিঠি লিখে জানায়, চণ্ডীতলা, বেগমপুর, পাণ্ডুয়া, হরিপালে অবৈধ কারখানার কথা বার বার বলা হলেও কোনও পদক্ষেপ করেনি পুলিশ। উল্টে পরিবেশ-কর্মীরা চাপ তৈরি করলে সুকৌশলে শোরগোল তোলা হয়— হাজার হাজার কারখানায় লক্ষ লক্ষ কর্মী কাজ করেন, তাঁদের কর্মসংস্থানের কী হবে? এই ‘সহমর্মী’ ব্যক্তিরা হয় জানেন না, অথবা জেনেও বুঝতে চান না যে পশ্চিমবঙ্গে কোনও দিন শতাধিক কারখানা আইনসম্মত ছিল না, আজও নেই। ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের লাইসেন্স প্রাপ্ত বাজি কারখানা ছিল চব্বিশটি। যদিও গত বছর অক্টোবর মাসে পর্ষদ জানিয়ে দেয়, রাজ্যের কোনও বাজি কারখানাতেই সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিতসবুজ বাজি উৎপাদন হচ্ছে না, তাই রাজ্যের কোনও বাজি কারখানাই বৈধ নয়। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, রাজ্য পরিবেশ দফতর মোট সাতটি কারখানাকে সবুজ বাজি তৈরির লাইসেন্স দিয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় রয়েছে ছ’টি, এবং দার্জিলিং জেলায় একটি।
তা হলে শয়ে শয়ে কারখানায় লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের যুক্তি টেকে কী করে? কাদের মদতে রাজ্যের অন্তত ন’টি জেলায় এত বাজি কারখানা চলছে? যে কোনও বিস্ফোরক পদার্থ নিয়ে বড় মাপের কাজ করতে হলে কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভস সেফটি অর্গানাইজ়েশন’–এর থেকে অনুমতি নিতে হবে। তবে পনেরো কিলোগ্রাম পর্যন্ত বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করার অনুমতি জেলাশাসকের কাছ থেকে মিলতে পারে।
পরিবেশ প্রশাসকদের অনেকেই বলেন, সবুজ বাজি উৎপাদনের জন্য আইন মেনে সুরক্ষিত ক্লাস্টার গড়া দরকার। এতে অনেক প্রশিক্ষিত সবুজ বাজি কারিগর তৈরি হবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে। একটু চিন্তা করলে বোঝা যায়, আসলে এগুলো কথার কথা। সুপ্রিম কোর্টের রায় (১১ ডিসেম্বর, ২০১৮) অনুযায়ী, দেশে সারা বছরে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা ছাড় দেওয়া আছে বাজি জ্বালানোর জন্য, যা সবুজ বাজি হতে হবে। আইন অনুসারে এই বাজি-কেন্দ্রিক উৎপাদন নেহাতই অস্থায়ী এবং মরসুমি ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত। তা কী করে সম্বৎসরের বৈধ পেশা হয়ে উঠতে পারে?
আসলে গ্রামে বেকারত্ব, অর্ধ বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে, এবং পুলিশ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনে, এক শ্রেণির মানুষ মৃত্যুফাঁদ গড়ে তুলছে। আর কত মানুষ মরলে এই বেআইনি বাজি তথা বোমা তৈরির কারখানা এ রাজ্যে বন্ধ হবে, এই প্রশ্ন করা দরকার প্রশাসনকে।