নিজকাজে: ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ চলচ্চিত্রের শুটিং-এ ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় এবং পরিচালক সত্যজিৎ রায় (পিছন থেকে)
অপরাজিত উপন্যাসে সমসাময়িক রাজনীতির উল্লেখ খুব বেশি নেই। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে ‘নিহিলিজ়ম’ বা শূন্যবাদ সংক্রান্ত বই পড়ছে অপু, এটা জানা যায়। ধর্ম জিনিসটা সমষ্টিগত পরিচয়ের বদলে নিজের নিজের ব্যক্তিগত থাকাই ভাল বলে তার বিশ্বাস গড়ে উঠছে, এও বলা থাকে। আর থাকে প্রণব। অপুর এই বন্ধুটি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং জেলে যায়। তার পর দেখা হলে অপুকে বলে, কিছু দিন গভর্নমেন্টের অতিথি হয়ে এলুম রে!
অপুকে যদি কেউ স্বাধীনতা আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করত, কী উত্তর হত তার? সে কি বলত, আমার বন্ধুরা অনেকেই আন্দোলনে রয়েছেন, এটুকু বলাই যায়? যেমন বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়! কলকাতা পত্রিকার সাক্ষাৎকারে তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হচ্ছে, কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ছিল? তিনি উত্তর দিচ্ছেন, না। আমার অধিকাংশ বন্ধু বামপন্থী, এইটুকু বলা যায়।
সত্যজিতের ছবিতে যখন যুবক অপুকে দেখি, অপুর সংসার-এর সেই প্রথম দৃশ্যেই থাকে একটি মিছিল। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অপু যখন রাস্তায় নামছে, আমাদের দাবি মানতে হবে বলে মিছিল চলেছে মহানগরের রাস্তায়। অপু সেই মিছিলের অংশ নয়, কিন্তু মিছিল বাদ দিয়েও তার জীবন নয়। তাই এর কিছু দিন পরেই রেস্টুরেন্টে বসে সে যখন পুলুকে বলবে, স্ট্রাইকারদের জায়গায় লোক নেওয়া হচ্ছে জেনে সে রেলের চাকরি নিতে আগ্রহ বোধ করেনি, তার মুখে বেমানান হবে না সেটা। বিএনআর-এর চাকরি না নেওয়ার প্রসঙ্গ উপন্যাসেও আছে। লক্ষণীয়, ছবিতে প্রণবের চরিত্রটি বদলেছে। অপু বলছে, “...তুই দেশে ফিরে এসে মোটা মাইনের চাকরি করবি, তার পর সেটল ডাউন করবি...!” প্রণব বা পুলুর রাজনৈতিক অতীতের কথা ছবিতে নেই। পরিচালকের নজর অপুর দিকে বেশি। তাই তাকে বোঝাতে রইল দু’টি আঁচড়— একটিতে ধরা থাকল অপুর পরিপার্শ্ব অর্থাৎ মিছিলের দৃশ্য, অন্যটিতে অপুর নিজস্ব ‘অবস্থান’ অর্থাৎ চাকরি না নেওয়ার প্রসঙ্গ। প্রত্যক্ষত রাজনীতির মানুষ না হলেও অপুর ‘অবস্থান’টুকু জানানো আবশ্যিক, মনে করেছিলেন সত্যজিৎ— এই অনুমান অসঙ্গত হবে না।
আপাত ভাবে ঠিক এর বিপরীত ঘটনাটা ঘটে চারুলতায়। অমলও লেখক হতে চায়, রোম্যান্টিক মন তারও আছে। রাজনীতির মানুষ সে-ও নয়। ভূপতি যখন তাকে সাধ করে তার কাগজ দেখায়, অমল শুধু রাজনীতির বিষয়ে তার ঔদাসীন্যই প্রকাশ করে না, একটা ছোট্ট টিপ্পনীও জুড়ে দেয়। সে ভূপতির সম্পাদকীয়তে চোখ বুলিয়ে বলে, “এ সব কথা লিখলে যদি পুলিশে ধরে?... সিডিশন! আমি ওর মইধ্যে নাই!” এই একটি বাক্যে অমলের ভবিষ্যৎ গতিবিধির একটা দিকনির্দেশ যেন আগাম ধরা থাকে। যেখানেই কোনও ঝুঁকির প্রশ্ন, মন্মথ দত্তর সারশূন্য লেখার ভক্ত (এখানেও গল্পের সঙ্গে তফাত) অমল তার মধ্যে নেই। তার স্বভাবের অতি-নির্বিবাদী, প্রায় পলায়নী অভিমুখটিকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্যই যেন তাকে আগে থেকেই সিডিশন-সাবধানি হিসেবে দেখিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করলেন সত্যজিৎ। এটি তাঁর নিজস্ব সংযোজন। এখানেও সেই ‘অবস্থান’-এর প্রশ্ন।
সত্যজিতের চিন্তনে অপু যেমন সম্পূর্ণ হয় না তার রাজনৈতিক অবস্থান ছাড়া, অমল সম্পূর্ণ হয় না রাজনীতি সম্পর্কে তার গা-বাঁচানি ছাড়া। নায়ক-এ (১৯৬৬) এসে দেখব, অরিন্দমের আগের জীবন আর নায়ক-জীবনে আলাদা হয়ে যাওয়ার মাপকাঠিটাই হল রাজনীতির ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার অভ্যাস। যে বন্ধুর সঙ্গে একদা অসঙ্কোচে রাজনৈতিক মিটিংয়ে যেতে পারত সে, নায়ক হয়ে যাওয়ার পর সে আর তার ডাকে সাড়া দিতে পারে না।
সত্যজিৎকে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে বর্ণনা করার চল সচরাচর নেই। অথচ গুগাবাবা সিরিজ় কিংবা কলকাতা ট্রিলজি শুধু নয়, তাঁর প্রায় সব ছবিই কোনও না কোনও ভাবে রাজনৈতিকতার কথা বলে এবং সময়ের চিহ্নকে ধারণ করে চলে। কাঞ্চনজঙ্ঘা-র (১৯৬২) রায়বাহাদুর শুধু ব্রিটিশ-ভজনা করেই থেমে যান না, মিটিং-মিছিল-হরতালের প্রতি তাঁর ঘৃণাও সমান ভাবে প্রকাশ পায়। আবার পরের বছরই মহানগর-এর জন্য যে গল্প সত্যজিৎ বেছে নিচ্ছেন, সেই ‘অবতরণিকা’য় আঁকা থাকছে এর বিপ্রতীপ ছবি— অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ের প্রতি দেশীয় ‘বস’-এর বিদ্বেষ।
সত্যজিতের রাজনীতি-চিন্তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা কম হওয়ার কারণই হল, তাঁকে চট করে কোনও খোপে ফেলা মুশকিল। একে তো স্লোগানের চেয়ে মূল্যবোধে আস্থা তাঁর বেশি, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর বিচিত্রগামিতা। পথের পাঁচালী বা সদ্গতি-তে সত্যজিতের ‘শ্রেণিচেতনা’ বামপন্থীদের পছন্দ হয়, জলসাঘর-এ ‘সামন্ততন্ত্রের প্রতি দরদ’ তাঁদের হতাশ করে। বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীরা দেবী আর মহাপুরুষ নিয়ে উৎফুল্ল হন, সোনার কেল্লা তাঁদের উদ্বিগ্ন করে। নারীবাদীরা কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানগর, চারুলতায় মুগ্ধ, কিন্তু গল্পে নারীচরিত্রের অনুপস্থিতিতে বিমর্ষ। সত্যজিৎ সকলকেই বড় ঝামেলায় ফেলে দেন। এমনকি সরকারকেও। রাজ্য সরকার সোনার কেল্লা প্রযোজনা করেছে বলে পরের ছবি জন অরণ্য হবে না, সত্যজিতের অভিধানে এমন কোনও কথাই নেই। তাঁর রাজনীতি, তাঁর ছবির রাজনীতি নিয়ে যে বাজারে নানা রকম মতামত, সে বিষয়ে তিনি কম ওয়াকিবহাল ছিলেন না। কিন্তু কোনও শিবিরকে কৈফিয়ত দেওয়া বা খুশি করার তাগিদ তিনি অনুভব করেননি। বরং স্পষ্ট জানিয়েছেন— “তথাকথিত প্রোগ্রেসিভ অ্যাটিচিউডের যে ফর্মুলাগুলো রয়েছে, এগুলো আমার কাছে খুব একটা ইন্টারেস্টিং, ভ্যালিড বা খুব একটা সঙ্গত বলে মনে হয়নি।”
প্রতিদ্বন্দ্বী-তে সিদ্ধার্থ বলেছিল, ভিয়েতনামের যুদ্ধকে বিগত দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে উল্লেখ করার জন্য কমিউনিস্ট হওয়ার দরকার হয় না। এই মনোভাবটিকে অনেকাংশে সত্যজিতের স্বীয় মনোভাব বলে মনে করা যায়, কারণ ব্যক্তির নিজস্ব অবস্থানের প্রশ্নটিই সত্যজিতের ছবিতে বার বার ভাস্বর দলীয় ঝান্ডার চেয়ে। দলের খাতায় নাম না লিখিয়েও যে রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া সম্ভব, ধারাবাহিক ভাবে সম্ভব, সত্যজিতের ছবি এবং সত্যজিতের জীবন তারই দলিল। বাঁধাধরা রাজনীতির মধ্যে না থেকেও সিনে টেকনিশিয়ান ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি, রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির আহ্বানপত্রে তিনি, খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে তিনি, ভিয়েতনামের জন্য সমাবেশে তিনি— আবার সেই তিনিই ফরমায়েশি দেশপ্রেমের ঘেরাটোপে পড়তে চাইবেন না। ভারত-চিন যুদ্ধের সময় ভারতের প্রতিরোধ নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির জন্য জওহরলাল নেহরুর প্রস্তাবে উৎসাহ পাবেন না, তাই বলে নেহরুর মানসিক যন্ত্রণার প্রতি তাঁর সমানুভূতিতেও এতটুকু খাদ থাকবে না। রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সঙ্কট’-এর প্রসঙ্গ টেনে তিনি লিখবেন একটি অমোঘ বাক্য— “...এই দুঃখবোধ, এই অন্তর্দাহ যার নেই, মহত্ত্বের আসনে তার কোনও প্রতিষ্ঠাও নেই।” (দ্র: শিল্পী-দরদী জওহরলাল)
এই দুঃখবোধ, এই অন্তর্দাহ— কথাগুলো আজকের দিনে রাজনীতিকদের জন্য প্রায় সোনার পাথরবাটির মতো শোনাতে পারে। নাগরিক সমাজের অবস্থা তথা ‘অবস্থান’ও খুব আলাদা নয়। কোনও দুঃখ, কোনও দাহই আজ আর জনমাধ্যমে বিজ্ঞাপিত না হয়ে অন্তরে বসত করে না। রাজনীতির বোধ আত্মপ্রচারের বিজ্ঞপ্তিতে পর্যবসিত না হয়ে ক্ষান্ত হয় না। মিছিলের সেলফি-তে ভরে ওঠে দেওয়াল। তদ্বিপরীতে সত্যজিতের রাজনীতি যেন অনেকটাই ঘোষণাবিমুখ। তাঁর ছবি কতখানি ‘সমাজসচেতন’, তাঁর ভাবনা কতখানি ‘রাজনীতিমনস্ক’, সে সব নিজে থেকে লিখে পাতা ভরানোর প্রয়োজন তিনি বোধ করেন না। শিল্পীর দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য একই সঙ্গে তীক্ষ্ণ এবং স্বচ্ছ: “এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে কমিটমেন্টের মতো সহজ জিনিস আর নেই। যাঁরা কাজ করেন না, কেবল কথা বলেন, তাঁরা মুখে বললেই কমিটেড হতে পারেন। কারণ কমিটমেন্টের ছেঁদো বুলি কারুর অজানা নেই।... আমি নিজে কমিটেড কি না তা লোকে আমার ছবি দেখেই বিচার করুক।” (দ্র: সাক্ষাৎকার সমগ্র)
সারা জীবন নিজের কাজের প্রতি সৎ এবং নিষ্ঠ থেকে যাওয়া এবং কাজের মধ্য দিয়ে নিজের বিশ্বাসকে প্রকাশ করাটাও আদতে একটা বৃহৎ রাজনীতি। এই কথাটুকু মনে রাখলে সত্যজিৎকে বুঝতে সুবিধা হতে পারে। বোঝাটা জরুরিও বটে। কেননা সত্যজিতের শতবর্ষে দেশ-কালের যা চেহারা দাঁড়িয়েছে, নিজের কাজের জগতে স্বধর্মে অবিচল থাকাটা ক্রমশই খুব বেশি করে রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে উঠছে। উল্টো রাস্তাটি, বলা বাহুল্য, নিরাপদ এবং সহজ— “সিডিশন! আমি ওর মইধ্যে নাই!”