শ্রদ্ধার্ঘ্য: মনমোহন সিংহের শেষকৃত্যে রাহুল গান্ধী। ২৮ ডিসেম্বর, নয়াদিল্লি। ছবি: পিটিআই।
মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঠিক পরের বছরের কথা। সন ২০০৫। আমেরিকার কংগ্রেস। সেখানে মনমোহন বলেছিলেন, নীতিতে বদলের বিষয়ে ভারত খুবই মন্থর বলে সমালোচনা হয়। কারণ যে কোনও নীতি বদলের জেরে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে মানুষের মনে ভয়, সংশয় দূর করে তার পর এগোতে হয়। গণতন্ত্রের অর্থই হল এই ভাবে পরিবর্তনের পক্ষে ঐকমত্য তৈরি করা। শুধু কথায় নয়। কার্যক্ষেত্রেও মনমোহন সিংহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ঐকমত্য গড়ে তোলার উপরে জোর দিতেন। এই মনোভাব তাঁর দুর্বলতা ছিল না। এটাই ছিল শক্তি। মনমোহন সিংহের যাবতীয় আর্থিক নীতি যে সময়ের ঝড়ঝাপটা সামলেও টিকে গিয়েছে, এটিও তার অন্যতম কারণ।
এ-হেন মনমোহন সিংহের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অদ্ভুত দৃশ্যের সাক্ষী হল দিল্লির রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, রাজনাথ সিংহ থেকে রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়্গেরা নিগমবোধ ঘাট শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন। অথচ তাঁদের মধ্যে কার্যত কোনও বাক্য বিনিময় হল না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর শেষকৃত্য কেন শ্মশানঘাটে হবে, কেন স্মৃতিসৌধের জন্য নির্দিষ্ট জমিতে শেষকৃত্য করা হল না, এ সব নিয়ে সরকারের সঙ্গে কংগ্রেসের মতান্তর ছিল ঠিকই, তা সত্ত্বেও সরকার ও বিরোধী শিবিরের শীর্ষনেতৃত্বের মধ্যে এমন বাক্য বিনিময় বন্ধ হয়ে যাওয়া জাতীয় রাজনীতিতে বিরল।
প্রেক্ষিত তৈরিই ছিল। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে সরকার ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে তিক্ততা চরমে পৌঁছেছে। সংসদে শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে বাক্সংঘাত হয়েই থাকে। এ বারের শীতকালীন অধিবেশনে শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই শারীরিক সংঘাতের অভিযোগ উঠেছে। লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর ধাক্কায় দুই বিজেপি সাংসদকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে বলে বিজেপি অভিযোগ তুলেছে। কংগ্রেসের পাল্টা অভিযোগ, বিজেপি সাংসদদের ধাক্কায় রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে আহত হয়েছেন। সর্বোপরি রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে বিজেপি সাংসদরা থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে এফআইআর করে এসেছেন।
সংসদের দুই কক্ষে বিরোধী দলনেতার পদটি সাংবিধানিক। প্রধানমন্ত্রী তথা শাসক শিবিরের শীর্ষকর্তারা দেশের স্বার্থে যে কোনও বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির জন্য বিরোধী দলনেতাদের সঙ্গেই কথা বলেন। কূটনৈতিক প্রশ্নে তাঁদের পাশে রেখে এগিয়ে থাকেন। জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ে সরকার ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে সম্পর্ক এতখানি তলানিতে ঠেকেনি। নেহরু যেমন রাম মনোহর লোহিয়া থেকে আচার্য কৃপালনীকে সম্মান দিতেন, তেমন ইন্দিরা গান্ধীর মতো প্রধানমন্ত্রীও সে সময়ের অন্যতম বিরোধী দলনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতেন। রাজীব গান্ধী, পি ভি নরসিংহ রাও থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়েও সেই পরম্পরা বজায় থেকেছে।
মনমোহন জমানায় লোকসভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সময় সরকারের সঙ্গে বিরোধীদের লোকসভার মধ্যে তুমুল বাগ্বিতণ্ডা হলেও অধিবেশন মুলতুবির পরেই প্রণবের সঙ্গে লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ, অরুণ জেটলিদের কথা হত। সুশীল কুমার শিন্দে লোকসভার নেতা হওয়ার পরেও দেখা যেত, লোকসভায় তর্কাতর্কির পরে শিন্দের সঙ্গেই বিজেপি নেতারা মধ্যাহ্নভোজন করছেন। এখন বিরোধী দলনেতার মতো সাংবিধানিক পদে আসীন ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাসক শিবিরের সাংসদরা থানায় গিয়ে এফআইআর করছেন, তা-ও আবার সংসদ চত্বরে ধাক্কাধাক্কির অভিযোগে। বিজেপির সাংসদ নিশিকান্ত দুবে সংসদ চত্বরে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকে প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘আপনার লজ্জা করে না?’ এই ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকেই স্পষ্ট, ভারতের গণতন্ত্রে শাসক দল ও বিরোধীর মধ্যে সম্পর্ক কতখানি তলানিতে ঠেকেছে।
বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে চলা কেন জরুরি?
পোড়খাওয়া রাজনীতিকরা বলেন, সংসদ হল সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বেরিয়ে যাওয়ার মঞ্চ। সংসদে সেই সুযোগ করে না দিলে সেই ক্ষোভ সড়কে চলে যায়। নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মায়। অরাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধে। নৈরাজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়। মোদী সরকার তার প্রমাণ পেয়েছে। বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করে তিন কৃষি বিল সংসদে পাশ করালেও রাজধানীর সীমানায় কৃষক আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছে। এক বছর দেশের রাজধানীর সীমানা অবরোধ করে সেই আন্দোলনের পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কৃষি বিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নয়া নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-র ক্ষেত্রেও সংসদে আইন পাশ করালেও আন্দোলন ঠেকানো যায়নি।
মোদী জমানায় নতুন সংসদ ভবন তৈরি হয়েছে। সংসদ চত্বরে বিরোধীদের বিক্ষোভ দেখানোর জন্য যে গান্ধী মূর্তির সামনে নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল, তা পুরনো ভবনের পিছনে সরানো হয়েছে। ফলে বিরোধীদের বিক্ষোভের নতুন ঠিকানা হয়েছে সংসদ ভবনের প্রধান দরজা মকরদ্বারের সামনে। সেই মকরদ্বারের সামনেই সরকার ও বিরোধী শিবির এক সঙ্গে বিক্ষোভ দেখাতে হাজির হওয়ায় ধুন্ধুমার কাণ্ড।
আসলে নরেন্দ্র মোদী সরকার গোড়া থেকেই বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে চলার বদলে তাঁদের কোণঠাসা করে চলার আগ্রাসী নীতি নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সংসদের যাবতীয় বক্তৃতা শুরু ও শেষ হয়েছে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে দোষারোপ করে। গত দশ বছরে লোকসভায় বিজেপির সংখ্যার জোর ছিল। তার জোরে সংসদে হট্টগোলের মধ্যে অথবা সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা ছাড়া একের পর এক বিল পাশ হয়েছে। গুজরাতের বিধানসভাতে বিরোধী দলনেতা বা বিরোধী বিধায়কদের সাসপেন্ড করে দেওয়াটা বহু বছর ধরেই রুটিন ঘটনা। সংসদেও বারবার তার প্রতিফলন ঘটেছে। এক বছর আগে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে ১৪১ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। তার পরে লোকসভা নির্বাচন হয়েছে। বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে শরিক নির্ভর হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে, কেন্দ্রের সরকার বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে চলার অভ্যাসটাই হারিয়ে ফেলেছে। অতীতে সরকার ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে সংঘাত হলে লোকসভার স্পিকার, রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় দেখা যেত। এখন তাঁদের বিরুদ্ধেই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
তার ফল? সাত দশকের রাজ্যসভার ইতিহাসে এ বারের সংসদ অধিবেশনে এই প্রথম বিরোধীরা এককাট্টা হয়ে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তথা উপরাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন। সংসদের অধিবেশনে কংগ্রেস তথা বিরোধী শিবির আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগে তদন্তের দাবি করেছিল। বিরোধীরা এমন দাবি তুলেই থাকেন। সরকার তা যুক্তি দিয়ে খারিজ করে। এ বার দেখা গেল, শাসক শিবির তার জবাবে প্রধান বিরোধী দলকে দেশদ্রোহী প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আমেরিকার ধনকুবের জর্জ সোরোস ভারতে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন। তাঁর সঙ্গে কংগ্রেস নেতারা হাত মিলিয়েছেন বলে কেন্দ্রের মন্ত্রী, বিজেপি সাংসদরা অভিযোগ তুলে গেলেন।
সংবিধানের পঁচাত্তর বছরের যাত্রা নিয়ে লোকসভা, রাজ্যসভায় আলোচনাতেও প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের মন্ত্রীরা কংগ্রেসকে সংবিধানবিরোধী বলে প্রমাণ করার মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এই সংবিধান নিয়ে আলোচনার সময় ভীমরাও আম্বেডকর সম্পর্কে অমিত শাহের মন্তব্য ঘিরেই বিরোধীরা ফের প্রতিবাদে নামেন। সেখান থেকেই সংসদ চত্বরে ধাক্কাধাক্কির অভিযোগ। লোকসভার বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে পুলিশে এফআইআর। মজার কথা হল, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী শক্তির সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ তুললেও কেন্দ্রীয় সরকার যেমন তা নিয়ে তদন্তের পথে হাঁটেনি, তেমনই রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে এফআইআর-এর পরে অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ কী তদন্ত করেছে, তারও উত্তর মেলেনি।
বার বার নির্বাচনের ফলে উন্নয়নের কাজে বাধা পড়ে বলে নরেন্দ্র মোদী লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েত সব নির্বাচন এক সঙ্গে করে ফেলে ‘এক দেশ, এক ভোট’ ব্যবস্থা চালু করতে চান। মুশকিল হল, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি বা তাঁর দল নির্বাচনের আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে পারেন না। এ জন্য নির্বাচনের রুটিনে বদল নয়, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় বদল প্রয়োজন।