Romila Thapar

Independence Day: ক্রমাগত স্মরণ করাতে হবে

বিকৃত ইতিহাস যে ভাবে ছড়াচ্ছে, উল্টো দিকের ইতিহাসটারও একই রকম জোরদার প্রচার চাই: আনন্দবাজার-কে বললেন রোমিলা থাপর

Advertisement

রোমিলা থাপর

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২১ ১৩:১১
Share:

পথপ্রদর্শক: ভারত কোন পথে, বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গাঁধী

প্রশ্ন: কিছু কাল আগে ‘রিফ্লেকশনস অন ন্যাশনালিজ়ম অ্যান্ড হিস্ট্রি’ প্রবন্ধে আপনি লিখেছেন— আপনাদের প্রজন্ম যে জাতীয়তাবাদের ভাবনা নিয়ে বড় হয়েছিল, তা ছিল গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সামাজিক সাম্য নির্মাণে বিশ্বাসী। এর বিপরীতে, আজ আমরা দেখছি এক ভয়ঙ্কর সংখ্যাগুরুবাদ এখন নিজেকে জাতীয়তাবাদ নামে জাহির করছে। প্রশ্ন হল, সেই ‘আমাদের জাতীয়তাবাদ’কে ফিরিয়ে আনতে হলে কী করা উচিত? বিশেষত পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল প্রচারমাধ্যমের কী ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত?

Advertisement

রোমিলা থাপর: যে কোনও দেশের ইতিহাসেই অনেক রকম রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থাকে। ভারতে দেখেছি গোষ্ঠী-ভিত্তিক সমাজ, রাজন্যশাসিত রাজ্যপাট, বড় মাপের সাম্রাজ্য, বিদেশি শক্তির উপনিবেশ, আর সব শেষে, স্বাধীন ‘নেশন’ বা ‘জাতিরাষ্ট্র’। এই জাতিরাষ্ট্র হতে চাওয়ার ইচ্ছার মধ্যে যে জাতীয়তাবাদ, তা কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা। এর মধ্যে রয়েছে নানা গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, তাদের বিবিধ সংস্কৃতি মিলিয়ে-মিশিয়ে একটি ‘নেশন’ হয়ে ওঠার চেষ্টা। অর্থাৎ অনেকের একত্র আসার ইচ্ছাই হল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ মানেই একটি ‘ইনক্লুসিভ’ বা সমন্বয়ী আদর্শ।

এখনকার ‘বিকৃত’ জাতীয়তাবাদ কিন্তু তা ভাবে না। তাই সঙ্গত কারণেই অনেকে তাকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বলে স্বীকার করতে নারাজ। এই ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ বলে, হিন্দুরাই নাকি ধর্মীয় সংখ্যাগুরু হিসেবে জাতির রূপটি দিয়েছে। এখন, ‘অনেক’-এর মধ্য থেকে ‘একটি’ বিশেষ আইডেন্টিটিকে বেছে নেওয়ার দাবি (সে ধর্মই হোক, জাতপরিচয়ই হোক, কিংবা ভাষাই হোক), অন্যত্রও দেখেছি আমরা। কিন্তু যে হেতু এই সব মতাদর্শ সমন্বয়বাদী নয়, বরং এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর বিভেদ ঘটাতেই উদ্গ্রীব, এদের কি আদৌ আমরা ‘জাতীয়তাবাদ’ বলব? একটিমাত্র আইডেন্টিটির ভিত্তিতে তৈরি সংখ্যাগুরুবাদ তো আর জাতীয়তাবাদ হতে পারে না!

Advertisement

আমাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় সংগ্রাম ছিল সমন্বয়বাদী, সব ভারতীয়কে এক সঙ্গে নিয়ে চলার মতাদর্শ, ধর্মকে কোনও বিভেদরেখা হিসেবে দেখা হয়নি সেখানে। সেই সংগ্রাম চেয়েছিল এমন একটি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, যে রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সামাজিক সাম্য নীতিতে বিশ্বাসী।

স্বাধীনতার পর অনেক দশক কেটে গেল— আজও এই আদর্শ সম্পূর্ণ রূপায়িত হয়নি। আগেকার দিনে সব কিছুর ভাল-মন্দ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করা যেত, যে-কেউ তা করতে পারত। সমালোচনাকে জাতীয়তাবাদ-বিরোধিতা বলে দাগিয়ে দেওয়া হত না। দেশে সংস্কারের গতিটি ধীর হলেও সংস্কারের অভিমুখ নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। সম্প্রতি কিন্তু যাত্রাপথটি পাল্টে গিয়েছে, সংখ্যাগুরুবাদের ভিত্তিতে বিকৃত জাতীয়তাবাদেরই এখন রমরমা। মনে রাখা ভাল, এমন ধরনের সংখ্যাগুরুবাদ কিন্তু সফল হতে পারে একমাত্র কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসনের ছত্রছায়াতেই, যেখানে গোটা সমাজে সেই শাসন বিষয়ে যথেষ্ট ভয় ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

রোমিলা থাপর।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের পুরনো-পরিচিত জাতীয়তাবাদকে কী ভাবে নতুন করে ফিরিয়ে আনা যায়, তা একটা অতি গুরুতর চিন্তার বিষয়। উপনিবেশ থেকে আমাদের দেশ কী ভাবে জাতিরাষ্ট্র হয়ে উঠল, তা নিয়ে এখনও আলোচনা-গবেষণার দরকার আছে। নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, আমরা কিন্তু এখন আর কোনও শাসকের শাসনের অধীন সমাজ নয়, আমরা একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক। নাগরিকদের অধিকার থাকে, কর্তব্যও থাকে। এই অধিকারগুলি কখনওই ভারতীয় নাগরিকদের বুঝিয়ে বলা হয়নি। হবে কী করে— সব সরকারই ভীত থাকে নাগরিক অধিকার নিয়ে। সব সরকারই মনে করে, নাগরিক তার অধিকার বেশি করে ব্যবহার করলে তার মনোমধ্যে ক্ষমতাধারীর প্রতি ভয়ের ভাবটা আর থাকে না!

এই পরিস্থিতিতে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রধান কাজ— নাগরিকদের অধিকার কতখানি ও কী কী, ক্রমাগত আলোচনার মাধ্যমে সেটা মনে করিয়ে দেওয়া। এর মানে এই নয় যে, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের সরাসরি রাজনৈতিক হয়ে উঠতে হবে। এ কথার অর্থ হল— যে সব শব্দ, ঘটনা, ভাবনা আমরা প্রতি দিনের জীবনে, কথাবার্তায়, ব্যবহার করি, সেগুলোর সত্য ইতিহাস আর যথার্থ ব্যঞ্জনা মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে। এই নাগরিক অধিকারের সচেতনতা তৈরির জন্য সংবিধানের সঙ্গে ভাল করে পরিচয় থাকা খুব জরুরি। নাগরিকত্বের ‘কোয়ালিটি’ বা গুণমান যদি বাড়াতে হয়, এ ছাড়া উপায় নেই। ধরো, যে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ শব্দটা ব্যবহার করে বার বার বিরুদ্ধমতাদর্শী মানুষকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, সেই শব্দটাই তো বিতর্কের বিষয় হতে পারে! কী মানে এই শব্দটার? কোনও নাগরিককে কী ভাবে তাঁর দেশ থেকে তাঁর দেশে শাসনকারী সরকারকে আলাদা করে দেখতে হবে? যাঁরা গ্রেফতারি চালাচ্ছেন, তাঁদেরও বুঝতে হবে এই জটিল শব্দটির প্রকৃত অর্থ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যদি এ সব বিতর্ক চালাতে ভয় পায়— যেমন ঘটছে সাম্প্রতিক কালে— সে ক্ষেত্রে তাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে ইউনিভার্সিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজই কিন্তু খোলামেলা আলোচনা চালিয়ে যাওয়া!

প্র: ইতিহাস পাঠ কী ভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে আজকের এই অস্তিত্বের লড়াইয়ে? আপনি বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন— অনুদার অগণতান্ত্রিক সংখ্যাগুরুবাদ তার নিজের বিষাক্ত ধ্যানধারণা প্রচারের অস্ত্র করে তুলছে ইতিহাসকে, বা ইতিহাসের বিকৃত ভাষ্যকে। স্বীকার করতেই হবে যে, এই প্রকল্পে তারা দারুণ সফল। ইতিহাসকে তাদের কবল থেকে উদ্ধার করার পথ কী? আমাদের কি সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে আলাদা করে ‘পপুলার হিস্ট্রি প্রজেক্ট’-এর কথা ভাবা উচিত? যদি তা-করি, তার পথটাই বা কী হতে পারে?

উ: পপুলার হিস্ট্রি প্রজেক্ট-এর চিন্তাটা ভালই, যদি সেই প্রজেক্ট পেশাগত ইতিহাসবিদদের লেখা ইতিহাসকে তুলে ধরে। সেই ইতিহাসের কেন্দ্রে থাকা দরকার এমন কিছু যা আজকের দিনে আমাদের দেশে প্রাসঙ্গিক। যে সব বিকৃত এবং ভ্রান্ত ধারণা ইতিমধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেন সেগুলো তৈরি হল, সে বিষয়েও আলোচনা জরুরি। এমনিতে ‘পপুলার’ ইতিহাস বলতে আমরা যা দেখি, সেগুলি খুব ধরাবাঁধা গতের। অথচ অনেক নতুন, আকর্ষণীয় ভাবে ইতিহাস লেখা সম্ভব। আর যদি ইতিহাস লিখতেই হয়, ইতিহাসের চরিত্র বা ঘটনা নিয়েই লিখতে হবে, পুরাণ বা লোককাহিনিকে ইতিহাস বলে দাবি করা যাবে না।

যেমন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আর উত্তর-পশ্চিমে হেলেনীয় গ্রিকদের সঙ্গে তাঁর সংযোগের কাহিনি নতুন করে বললে কেমন হয়? কিংবা হর্ষবর্ধনের কাহিনি— বাণভট্ট বা চিনা সাধক হিউয়েন সাং-এর বর্ণনা অনুসারে? কিংবা রাজরাজ চোলের সমুদ্র-সংযোগের কথা? কিংবা ফিরোজ় শাহ তুঘলকের ভারত-ইতিহাস চর্চা, মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গিরের প্রকৃতিবিজ্ঞানে উৎসাহের কথা? পুরাণ আর কল্পকাহিনিকে নিয়ে গালগল্প না ফেঁদে, তথ্য-প্রমাণ সহ যে ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত, যুক্তিনিষ্ঠ, সেটা তুলে ধরা দরকার, দুটোর মধ্যে তফাত পরিষ্কার করা দরকার।

বাস্তবিক, অনুদার সংখ্যাগুরুবাদ এখন একটা বিরাট যুদ্ধ করতে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, এবং সেই যুদ্ধ দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে এ দেশের নানা প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানো হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বিকৃত ইতিহাস ছড়ানোর পাশাপাশি যদি উল্টো দিকের মতটাও একই ভাবে প্রচার করা হয়— সমাজমাধ্যমে, টিভি চ্যানেলে, কিংবা সংবাদপত্রে— তবেই ইতিহাস উপস্থাপনার কোনও সত্যিকারের উন্নতি হতে পারে। গালিগালাজ করে লাভ নেই, ‘ওরা যে ভাবে করছে আমরাও সে ভাবে করব’ এমন গোঁয়ার্তুমিরও অর্থ নেই। সত্যি কথাটা স্পষ্ট করে, তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বলাটাই যথেষ্ট। আর কিছু না হোক, এর ফলে সংখ্যাগুরুবাদী অপপ্রচার বা ‘ট্রোল’ অন্তত আর একটু শিক্ষিত হয়ে ওঠার চেষ্টা করবে!

একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়— শিক্ষার পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস। সাম্প্রতিক কালে হিন্দুত্ববাদী অপপ্রচার দিয়ে রাঙিয়ে নতুন ইতিহাস পাঠ্যবই লেখা হচ্ছে। জেসুইটরা যেমন অল্পবয়সিদের মনে ক্যাথলিক ভাবধারা ঢোকানোর সংগঠিত প্রয়াস করে থাকে, হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদও ঠিক সে পথেই এগোচ্ছে। বহু সহস্র স্কুলে শুরু হয়ে গিয়েছে এই কার্যক্রম।

পাঠ্যবই যে কত গুরুতর, তা বলে শেষ করা যায় না। আমরা এত দিন বড়ই বেশি উদাসীন থেকেছি এ বিষয়ে, স্কুলে কী ধরনের বই পড়ানো হচ্ছে, সে দিকে কোনও মনোযোগ দিইনি। জোর দিয়ে বলিনি যে, পাঠ্যবই বেছে নেওয়া এবং তার মান পরীক্ষা করার কাজটা পেশাগত শিক্ষাবিদকে দিয়েই করানো আবশ্যিক। ইতিহাস বিষয়ে এ কথা বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ইতিহাস এমন একটি ‘ডিসিপ্লিন’ বা বিষয়, যা মানুষের সামাজিক সত্তা, সমাজের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করে দেয়। বিজ্ঞান বা অর্থনীতির পাঠ্যবই বা পাঠ্যক্রম যেমন রাজনীতিক বা প্রশাসকরা তর্জনীসঙ্কেতে ঠিক করে দিতে পারেন না, ইতিহাসের ক্ষেত্রেও তেমনই। প্রয়োজনমাফিক ইতিহাস বিকৃত করে সংখ্যাগুরুবাদের আদর্শপ্রচারের কাজে লাগানোর বিরুদ্ধে এখনও তেমন পর্যাপ্ত প্রতিরোধ কই।

অতীত বিষয়ে আমাদের জ্ঞানই কিন্তু বর্তমান বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়। সুতরাং অতীত বলতে কী বুঝছি, কী জানছি, সেটা আমাদের স্থির করতে হবে খুব সতর্ক ভাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement