চিন্তনকারী: কংগ্রেসের ‘নবসঙ্কল্প শিবির’-এ সনিয়া ও রাহুল গান্ধী, অশোক গহলৌত, উম্মেন চান্ডি, আনন্দ শর্মা, গুলাম নবি আজাদ, উদয়পুর, ১৫ মে। ছবি: পিটিআই।
জোট-রাজনীতির ললাটে কালি লেপন করার দায়িত্ব কি এ বার রাহুল গান্ধী নিজের হাতে তুলে নিলেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে দেখে রাজনীতির পণ্ডিতেরা অনেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এর ফলে তৃণমূল নেত্রী পরোক্ষে বিজেপির ‘সুবিধা’ করে দিতে চান। এ বার উদয়পুরে কংগ্রেসের চিন্তন শিবির থেকে রাহুলের আঞ্চলিক দল-বিরোধী বার্তা জেনে তাঁরা কী বলবেন?
জোট-রাজনীতি নিয়ে আলোচনার আগে রাহুলের বক্তব্যের বাস্তব দিকগুলি দেখা যাক। এটা সকলেই মানবেন, আজকের রাজনীতিতে দেশে আঞ্চলিক দলগুলির প্রভাব ও আধিপত্য অস্বীকার করা রাজনৈতিক বাস্তববুদ্ধির পরিচয় নয়। জাতীয় স্তরে একদলীয় শাসনের অধ্যায় যে লুপ্তপ্রায়, এটা শিশুও বোঝে।
যদিও রাহুল বলেছেন, “বিজেপি শুধু কংগ্রেসকে নিশানা করে। কারণ তারা জানে, আঞ্চলিক দলগুলি বিজেপিকে হারাতে পারবে না।” কথাটি সর্বাংশে ভুল না হলেও যে অবস্থান থেকে রাহুল এটা বলেছেন, সেখানে অবশ্যই একটি ফাঁক এবং ফাঁকির জায়গা আছে।
প্রথমত, কোথাও কোনও আঞ্চলিক দলের নেতা এক বারও বলেননি যে, তাঁরা কেউ একক শক্তিতে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম। একা কংগ্রেসেরও কিন্তু সেই ক্ষমতা নেই। যদি তা-ই হত, তা হলে তো জোট গড়ার প্রশ্নই উঠত না। সেটা বুঝেই কংগ্রেস-সহ সকলকে নিয়ে জোট গড়ার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনা হয়েছে। আর সেখানেই গুরুত্ব বাড়ছে বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলির। এই সরল বাস্তবতা রাহুলের না বোঝার কথা নয়। তিনি নিশ্চয় এটাও জানেন, জোট-রাজনীতি তার নিজের ভাষায় কথা বলে। জাতীয় রাজনীতিতে সেটা বার বার প্রমাণিত।
দ্বিতীয়ত, দেশে কংগ্রেসের শক্তি আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে তারা বহু রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলিকে মোকাবিলা করতেও ব্যর্থ। একের পর এক বিধানসভা ভোটে ছবিটি আরও স্পষ্ট। এই অবস্থায় কংগ্রেস লোকসভায় বিজেপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় ফিরবে ভাবলে সেটা স্বপ্নের পোলাও-তে ঘি ঢালার চেয়ে বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না।
অন্য দিকে, কংগ্রেসের ‘নেতৃত্ব’ স্বীকার করার অগ্রিম শর্তে, ধরা যাক রাহুলকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরে, সকল আঞ্চলিক দল এসে বিজেপি-বিরোধী জোট গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সেই অভিলাষও অতি-সরলীকরণ। ক’জন কংগ্রেস সমর্থকই বা এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, বলা কঠিন। তাই রাহুলের বক্তব্যের পরে জোটের জট আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে বই কমবে না।
এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির শাসনাধীন জম্মু-কাশ্মীর বাদ দিয়ে দেশের বাকি ত্রিশটি রাজ্যের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল, গুজরাত, হরিয়ানা-সহ বারোটিতে সরাসরি বিজেপির সরকার। আরও ছ’টিতে তারা রাজ্যস্তরে আঞ্চলিক শাসক জোটের শরিক। কংগ্রেসের সরকার রয়েছে শুধু রাজস্থান ও ছত্তীসগঢ়ে। মহারাষ্ট্র, তামিনলাড়ু ও ঝাড়খণ্ডে কংগ্রেস শাসক জোটের অংশ। যেগুলিতে আবার আঞ্চলিক দলের প্রাধান্য। কেরলে বাম এবং বাকি রাজ্যগুলিতে চলছে আঞ্চলিক দলের সরকার। পশ্চিমবঙ্গ যার অন্যতম।
সন্দেহ নেই, ’১৯-এর লোকসভায় বাংলায় বিজেপির কাছে ধাক্কা খাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ’২১-এর বিধানসভায় দেশের অমিত শক্তিমান শাসক দলকে যে ভাবে পর্যুদস্ত করেছেন এবং পর পর করে চলেছেন, তাতে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর দাঁড়ানোর ভিত আগের চেয়ে মজবুত। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী পক্ষে থাকা কংগ্রেস এবং বামেদেরও তিনি শূন্য হাতে ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে তৃণমূলের একাধিপত্য জাহির করতে সক্ষম। সব দিক যদি তাঁর ‘অনুকূল’-এ থাকে, তবে এই প্রবণতায় আগামী লোকসভা ভোটে রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে খুব অল্পই হয়তো তাঁর হাতছাড়া হবে।
জোট রাজনীতিতে সংখ্যার একটি গুরুত্ব আছে। কোনও দলের হাতে মোটামুটি পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটি আসন থাকলে প্রয়োজনমতো তার দর কষাকষির ক্ষমতা কিছুটা বেশি হতেই পারে। শেষ পর্যন্ত কী হবে, পরের কথা। তবে অধিক আসন সংখ্যার প্রত্যাশা এবং পরবর্তী পরিস্থিতির ভাবনা থেকেই হয়তো মমতার দলও তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ‘দেখতে’ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আর সত্যিই তেমন কোনও সুযোগ এসে গেলে মমতা কোনও ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করবেন বলেও মনে হয় না!
শুধু মমতাই বা বলি কেন, লোকসভা ভোটে নিজ নিজ রাজ্যে আসন বাড়িয়ে দর কষাকষির রাস্তা খুলতে শরদ পওয়ার, কেসিআর, স্ট্যালিন-রাও কি চান না? এর জন্য কাউকে দোষ দেওয়াও যায় না। কিন্তু জোট গড়ে ওঠার আগেই রাহুল যে ভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বের বিষয়টি সরাসরি সামনে এনে দিলেন— এর পরিণতি নিয়ে সংশয় স্বাভাবিক।
এ কথা সত্যি যে, আঞ্চলিক দলগুলি সম্পর্কে রাহুলের পর্যবেক্ষণের নেপথ্যে একটি বড় জায়গা জুড়ে আছেন মমতা। উভয়ের রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রথম থেকেই খুব মসৃণ নয়। সংসদীয় রাজনীতিতে রাজীব গান্ধীর হাত ধরে উঠে আসা মমতা যখন কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল গড়েন, রাহুল রাজনীতিতে পা রেখেছেন তার অনেক পরে। তাই রাজীব-পরবর্তী কংগ্রেসে সনিয়ার সঙ্গে মমতার সম্পর্ক যতটা ক্রিয়াশীল থাকতে পেরেছে, রাহুলের বেলায় সেটা হয়ে ওঠেনি।
এটা অবশ্যই পারস্পরিক। রাহুলকে ‘নেতা’ বলে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে মমতার এক প্রকার মানসিক বাধা রয়েছে। রাহুলের দিকেও তাই। সময়ের সঙ্গে বাংলার রাজনীতিতে এর প্রতিফলন কতখানি তীব্র হয়েছে, আমরা জানি। আর রাজ্যের রাজনীতিতে তৃণমূলের কাছে কংগ্রেস নানা ভাবে কোণঠাসা হওয়ার পরে বিষয়টি আরও বিষময় হয়ে উঠেছে। এখানে কেউ কাউকে জমি ছাড়তে প্রস্তুত নয়, রাজনীতির স্বাভাবিক যুক্তিতেই।
অন্য কয়েকটি রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সঙ্গে কংগ্রেস মিলেমিশে আছে ঠিকই। তবু কংগ্রেসের ‘নেতৃত্ব’ কোথাও প্রতিষ্ঠিত নয়। সুতরাং জোট গড়ার সময় কংগ্রেসকে নেতা বলে মেনে নেওয়ার একটা অনিশ্চয়তা এখানেও থেকে যাচ্ছে। তবে এটা ঘটনা যে, সারা দেশে অন্তত দেড়শো আসনে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের সরাসরি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রে তাদের বাদ রেখে জোট অলীক কল্পনা। এমনকি, বড় বিপর্যয় না হলে সংখ্যার নিরিখে কংগ্রেস হয়তো বিরোধীদের মধ্যে একক সর্বোচ্চ আসনের অধিকারীও হতে পারে। তখন আবার এক অঙ্ক সামনে আসবে।
জোট-উদ্যোগের সূচনা থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলের নেতারা অবশ্য সচেতন ভাবে নেতৃত্বের প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য মূলত দু’টি। এক, গোড়াতেই বিবাদের পরিসর তৈরি না করে কাজ এগিয়ে নেওয়া। দুই, হাতের তাস লুকিয়ে রেখে ভোটের ফল অনুযায়ী ঝোপ বুঝে কোপ মারা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বার বারই আঞ্চলিক দলগুলির ঐক্যের উপর জোর দেন। তাঁর অভিমত হল, বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির ‘শক্তি’ বাড়লে আখেরে দিল্লিতে আসন বাড়বে। এই ভাবনার মধ্যে কংগ্রেসকে ‘অধিক গুরুত্ব’ না দেওয়ার একটি বার্তা অবশ্যই ধরা পড়ে। সেই সঙ্গেই বোঝা যায়, জোটের মধ্যে আর একটি অলিখিত জোট তৈরি রাখার কুশলী চিন্তা। পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে যেটা আরও অর্থবহ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান, যেখানে যে দল বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম, সেখানে সেই দলকে এগিয়ে দিয়ে অন্যেরা পিছনে দাঁড়াক। এই রাজ্যে যেমন তৃণমূল কংগ্রেস। জোট-রাজনীতিতে বাকিদের কাছে এই ফর্মুলাটি কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে, এখনই বলা শক্ত। তা ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসও তো দেখা যাচ্ছে এখন অন্য রাজ্যে লড়তে উৎসাহী।
সে সব আরও পরের কথা। আপাতত রাহুল যে ভাবে জোটের ঘরে গণ্ডি কেটে দিলেন, তাতে এর পর অঙ্কুর থেকে চারা কী ভাবে মাথা তোলে, তা দেখার আগ্রহ বাড়ল।