প্রাসঙ্গিক: মুক্তধারা নাটকের দৃশ্য। ১৯৯৬
আজি হতে শতবর্ষ পরে... শতবর্ষ পরে কোনও কবিতা নয়, অসামান্য এক নাটকের কথা মনে পড়ছে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তধারা। এক বার ফিরে দেখা যেতে পারে রাষ্ট্রশক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজ এবং পরিবেশ নিয়ে এ নাটকে বিধৃত রবীন্দ্র-ভাবনাকে, আজও যা অর্থবহ। ইতিহাসের আধুনিক কালখণ্ডে নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্র ও তার সহযোগী সমাজের মুষ্টিমেয় শক্তিশালীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে প্রকৃতি আর পরিবেশকে স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে চেয়েছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ, বিনষ্ট হয়েছে ভারসাম্য। প্রাকৃতিক ও দুর্বল মানুষকে এর মাসুল গুনতে হয়েছে। এই ঐতিহাসিক সত্যের খতিয়ান এই নাটক। সেই সঙ্গে আছে বিকল্প পন্থা অনুসন্ধান: আগ্রাসন, শাসন ও দাম্ভিক ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে সচেতন, বিবেকবান মানুষের প্রতিবাদের কথাও। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত উল্লেখ করে এর তাৎপর্য অনুসন্ধান করলে বোঝা যায় কী ভাবে সমকালীন সমস্যাকে রবীন্দ্রনাথ চিহ্নিত করে তার সমাধানের পথ খুঁজতে চেয়েছিলেন— আজকের ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনযাপন প্রণালী নিয়ে যা ভাবতে শেখায়। কবির সদা সচেতন, সংবেদনশীল ও অনুভূতিপ্রবণ মনন আমাদের চিন্তাকে আলোড়িত, আলোকিত করতে পারে।
নাটকের কাহিনি আমাদের নিয়ে যায় পার্বত্য প্রদেশ উত্তরকূটে, যেখানে রাজা রণজিতের রাজসভার ‘যন্ত্ররাজ’ বিভূতি লৌহযন্ত্রের বাঁধ তুলে প্রকৃতির অকৃপণ দান মুক্তধারা ঝর্নাকে আবদ্ধ করেছেন। এর উপরে নির্ভর করে শিবতরাইয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা। এই যন্ত্রের দানবীয় আকার মানুষকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে, তাই বিদেশি পথিক বলে ওঠে, “বাবা রে! ওটাকে অসুরের মতো দেখাচ্ছে, মাংস নেই, চোয়াল ঝোলা।” ভীষণাকৃতির লৌহযন্ত্র লোভ ও আসুরিক শক্তির নির্মম দম্ভের প্রতীক। এর নির্মাতারা প্রকৃতিকে ব্যবহার করে দুর্বল মানুষের উপরে আধিপত্য অর্জন করতে চায়। তাই বিভূতি বলেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বালি-পাথর-জলের ষড়যন্ত্র ভেদ করে মানুষের বুদ্ধিকে জয়ী করা: “কোন চাষীর কোন ভুট্টার ক্ষেত মারা যাবে সে কথা ভাববার সময় ছিল না।” রাজার আশা, দেবতা শিবতরাইকে ‘তৃষ্ণার শূলে’ বিদ্ধ করে উত্তরকূটের সিংহাসনের তলায় ফেলে দেবেন। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের দ্যোতনা। ভারতের ইতিহাসের ঔপনিবেশিক কালকে পরিবেশের ইতিহাসে এক যুগবিভাজিকা বললে ভুল হবে না। পরাধীন ভারতে বিদেশি শাসকগোষ্ঠী প্রাকৃতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে নিজ স্বার্থে। প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে প্রকৃতির সম্পদের উপরে রাষ্ট্রশক্তি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা যে করেনি তা নয়। ব্রিটিশ আমলে এই প্রবণতা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিল। অরণ্যচারীরা যেমন প্রথাগত চিরাচরিত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও কম হয়নি। উনিশ শতক থেকে আবার তথাকথিত উন্নয়নমূলক কাজকর্ম— জলসেচ ব্যবস্থা, সড়ক ও রেল যোগাযোগ ইত্যাদি পরিবেশকে বিপর্যস্ত করেছিল। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি ঘটেছিল স্বাস্থ্যহীনতা, ম্যালেরিয়ার মতো অসুখের বিস্তার, মহামারির প্রকোপ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রান্তিক মানুষের জীবন। কবির চোখে ধরা পড়েছিল ব্যবসাবাণিজ্যের চাকচিক্যের পাশাপাশি বিপন্ন গ্রামজীবনের ছবি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কল-কারখানার বিস্তার শহরের পরিবেশকে করেছিল আবিল। চার দিকের এই পরিবর্তন, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বাণিজ্যে মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্য, নগরের সমৃদ্ধি ও গরিবের দুর্দশা, এই সব কিছু সম্বন্ধে কবি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করেছেন বহু লেখায়। শিল্পোন্নত ইউরোপের শহর, ভারত ও এশিয়ার অন্যত্র নগরজীবনে পরিবেশের অবক্ষয় কবিকে বিচলিত করেছে, “লন্ডনের বাতাসের মতো বাতাস কোথাও দেখলুম না। হাজার হাজার চিমনি অর্থাৎ ধুমপ্রণালী থেকে অবিশ্রান্ত পাথুরে কয়লার ধোঁয়া ও কয়লার গুঁড়ো উড়ে উড়ে লন্ডনের বাতাসের হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করেছে। দু’দণ্ড লন্ডনের রাস্তায় বেরিয়ে এসে হাত ধুলে সে হাত ধোয়া জলে কালির কাজ করা যায়, কয়লার গুঁড়োয় মাথাটাও বোধহয় অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ হয়ে দাঁড়ায়।”
ভারতে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে একটু-আধটু শিল্প গড়ে উঠেছিল। ১৮৫৪ সালে হুগলির তীরে প্রথম চটকল স্থাপিত হল, এর বিস্তার পরিবেশকে ক্রমাগত দূষিত করে তুলছিল। ১৮৬৩-তে সরকার বাধ্য হয়ে চালু করল ‘দ্য ক্যালকাটা অ্যান্ড হাওড়া স্মোক নুইসেন্স অ্যাক্ট’, যা পরিমার্জিত হয়ে তৈরি হয়েছিল ‘বেঙ্গল স্মোক নুইসেন্স অ্যাক্ট’ (১৯০৫)
‘জ্যোতিদাদা’ যখন হাওয়া বদল করতে যেতেন গঙ্গাতীরে তখন বাতাস ছিল কালিমামুক্ত। কিন্তু পরে দেখা গেল “তরুছায়াপ্রচ্ছন্ন গঙ্গাতীরের নীড়গুলির মধ্যে কলকারখানা ঊর্ধ্বফণা সাপের মতো প্রবেশ করিয়া শোঁ শোঁ শব্দে কালো নিঃশ্বাস ফুঁসিতেছে।”
জাপান যাত্রার সময় রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্যলক্ষ্মীর নির্মমতা লক্ষ করেছিলেন, যার বাহন যন্ত্র। “গঙ্গা দিয়ে যখন আমাদের জাহাজ আসছিল তখন বাণিজ্যশ্রীর নির্লজ্জ নির্দয়তা নদীর দুই ধারে দেখতে দেখতে এসেছি। ওর মনে প্রীতি নেই বলেই বাংলাদেশের এমন সুন্দর গঙ্গার ধারকে এত অনায়াসে নষ্ট করতে পেরেছে।” প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের যুদ্ধ। মুক্তধারা-র দু’বছর আগে লেখেন, “যন্ত্র কেবলই বলছে আমি জোর করে বাধা কাটিয়ে যাবো। যন্ত্রের এই ঔদ্ধত্যে সমস্ত পৃথিবী তাপিত।”
দেশগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা মানুষের মধ্যেও তৈরি করে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ। শিবতরাই আর উত্তরকূটের প্রজাদের কথোপকথনে তার প্রতিফলন। লোভী ও আগ্রাসনকামী মানুষের হাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চাবিকাঠি নষ্ট করছে প্রকৃতি ও মানুষের একাত্মতা, আর সেই অপরিমিত লোভ থেকেই জন্ম সামাজিক শোষণের। তাই বলে কবি যন্ত্র বা প্রযুক্তিকে বিসর্জন দিতে বলেননি। এখানে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক দেখা যায় বললে ভুল হবে না। তাঁর বিভিন্ন লেখা ও বিচিত্র কর্মকাণ্ডে বলে দেওয়া আছে, বিজ্ঞান আর যন্ত্রের ব্যবহারে যে শক্তি তৈরি হয় তাকে সাধারণের কল্যাণের কাজে লাগাতে হবে। ১৮৯০ থেকে গ্রামবাংলার দুর্দশা দেখে কবি সে ভাবেই পল্লি পুনর্গঠনের ডাক দিয়েছিলেন, যার প্রথম পর্যায় বলা চলে শিলাইদহ আর দ্বিতীয় পর্যায় শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের শিক্ষা আত্মশক্তির বিকাশে সাহায্য করবে। প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে একাত্মতা আর সমন্বয় সাধন তাঁর আজীবন ভাবনা, যা শান্তিনিকেতনের শিক্ষাঙ্গনে প্রতিফলিত। ভারত ও প্রাচ্যের সভ্যতার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণ করে কবি বলেছেন প্রাচ্যের আদর্শ বরাবর প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে ঐক্যসাধন, যেখানে পশ্চিম সর্বদা গর্বিত প্রযুক্তির উপরে আধিপত্য বিস্তার করে। পণ্ডিতেরা বলেছেন, রবীন্দ্রচিন্তার মূলে আছে সামঞ্জস্যের ধারণা, এখানেই আছে তাঁর সমস্ত ভাবনা বা তত্ত্বের চাবিকাঠি। তবে মনে রাখতে হবে, উপনিষদে বর্ণিত বিশ্বমানব ও বিশ্বপ্রকৃতির সামঞ্জস্যের ধারণা যেমন রবীন্দ্রভাবনায় গভীর ভাবে কাজ করেছে, সমসাময়িক সামাজিক বাস্তবতাও সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে ও তাকে চালিত করেছে। পশ্চিমের শোষণের সবচেয়ে বড় বলি ভারতের সাধারণ মানুষ। মুক্তধারাতে বাঁধ বাঁধার কাজে বলি দেওয়া হয়েছে অসংখ্য সাধারণ, শ্রমজীবী মানুষকে। সন্তানহারা অম্বা, জোয়ান নাতিদের হারানোর শোকে সন্তপ্ত বটু সমাজের এই সর্বহারাদের প্রতীক। বলদর্পী বিভূতি ঘোষণা করেন, এদের প্রাণদান বৃথা যায়নি। অন্য দিকে বলা আছে প্রতিবাদী শক্তির উত্থানের কথা, অহিংস প্রতিবাদের কথা। মুক্তধারা ঝর্নার তলায় কুড়িয়ে পাওয়া যুবরাজ অভিজিৎ জলের শব্দে মাতৃভাষা শুনতে পেয়েছেন আর তাকে মুক্ত করার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।
ধনঞ্জয় বৈরাগী উৎপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি। ইতিমধ্যে গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে। এই নাটক লেখার বেশ কিছু বছর পরে অরণ্যের সত্যাগ্রহ আইন অমান্য আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিস্তার লাভ করেছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিশাল বাঁধ ও জলাধার নির্মাণের ফলে মানুষের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সংঘটিত প্রতিবাদ। প্রযুক্তির ব্যবহারকে সর্বসাধারণের কল্যাণে প্রয়োগ করার, এবং প্রকৃতি, পরিবেশ ও সমাজের চাহিদায় সামঞ্জস্য বিধানের যে আয়োজন কবির লেখায় ও কর্মকাণ্ডে রয়েছে, আজও তার প্রাসঙ্গিকতা ফুরোয়নি। সাম্প্রতিক অতিমারি থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করতে না পারলে আরও বড় সঙ্কটে পড়তে চলেছে তথাকথিত ‘সভ্য’ মানুষজন। কবির লেখা তাই শুধু অতীতের খতিয়ান নয়, পরবর্তী সময়কাল ও বর্তমান সময়কে তা এক সূত্রে বেঁধেছে; ভবিষ্যতের পন্থা নির্দেশকারী চিরকালীন এক সৃষ্টি তা। তাঁর সেই শিক্ষা আমরা নিতে পারব কি না, না কি ব্যর্থ হব, তা অন্য প্রসঙ্গ।
ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়