পরিসংখ্যান বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে নারীশিক্ষার প্রসার এবং নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ— দমন-পীড়ন, দৈহিক-মানসিক নির্যাতন, যৌন নিগ্রহ সবই বেড়েছে, বাড়ছে। এই দু’টি বিষয়ের মধ্যে কেউ আপাত বৈপরীত্য দেখতে পারেন। কিন্তু বিষয় দু’টির সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধির অনিবার্যতা অনস্বীকার্য।
ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়া রিপোর্ট (২০২২) অনুসারে, স্বাধীনতার সময়ে ভারতে নারীসাক্ষরতার হার ছিল জনসংখ্যার প্রায় ৯%। প্রতি ১১ জন মেয়ের ১ জন ছিল সাক্ষর, যা বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৭৭%। ২০১১-র জনশুমারিতে নারীসাক্ষরতার হার ৬৪.৬৩%। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় (২০১৯-২০২১) ১৫-৪৯ বছরের নারীর সাক্ষরতার হার ৭১.৫%। গ্লোবাল ডেটা-য় (জুন, ২০২২) ২০১০-২০২১ সময়কালে নারীসাক্ষরতার হার ৮০.৩৫% থেকে ১৪.৪% বেড়ে হয়েছে ৯১.৯৫%। অল ইন্ডিয়া সার্ভে অব হায়ার এডুকেশন-এ (২০২১-২২) উচ্চশিক্ষায় মহিলাদের তালিকাভুক্তির সংখ্যা ক্রমবর্ধমান— ২.০৭ কোটি (মোট শিক্ষার্থীর ৪৮%)। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২’এ পিএইচ ডি-তে মেয়েদের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৪৭,৭১৭ থেকে পৌঁছেছে ৯৮,৬৩৬-এ। নারী ক্ষমতায়নের সূচক হিসাবে শ্রমবাজারে, রাজনৈতিক পরিসরে নারীর প্রতিনিধিত্বও দৃশ্যতই বাড়ছে। শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার ২০১৭-১৮’র ২৩.৩% থেকে বেড়ে ২০২১-২২’এ ৩২.৮%।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো জানাচ্ছে, নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ৩০%-এরও বেশি বেড়েছে— ৩.৩৭ লাখ থেকে ৪.৪৫ লাখ। ২০১৪-য় নারীদের বিরুদ্ধে প্রতি লাখে ৫৬.৩ হারে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, ২০২২-এ সেই হার ৬৬.৪। অপরাধগুলির মধ্যে আছে ধর্ষণ, পারিবারিক হিংসা, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার মতো ঘটনা।
প্রশ্ন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের মধ্যে কি সম্বন্ধ আছে বা থাকতে পারে? দু’টি সম্ভাব্য বিকল্প উত্তর— হ্যাঁ এবং না। আমি প্রথম বিকল্পের সমর্থক। দ্বিতীয় বিকল্পটি আমার মতে, বাস্তবসম্মত নয়। যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নির্বাসিত, সেখানে নারীর ক্ষমতায়ন স্থিতাবস্থায় ব্যাঘাত ঘটাতে বাধ্য। তারই প্রতিক্রিয়ায় নারীদের উপর হিংসা, পীড়ন জোরদার হওয়াটা প্রায় অনিবার্য। কাজেই দু’টি বিষয় সম্বন্ধবিহীন নয়। বরং এদের মধ্যে গূঢ় সম্বন্ধেরই আভাস মেলে।
বিস্তারে বললে, পুরুষশাসিত ব্যবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রে পুরুষ। পুরুষকেন্দ্রিকতা কেবল নারীর পক্ষেই হানিকারক নয়, তলে তলে গুরুতর ক্ষতি করে পুরুষেরও। জন্মসূত্রে পুরুষবর্গীয় হওয়ার খাতিরে যদি কিছু ব্যক্তি সমাজে বিশেষ সুবিধার অধিকারী হয়, তা হলে তাদের মনের, ব্যক্তিত্বের বিকাশ যথাযথ হয় না। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় এক ব্যক্তি ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠার পথে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বা ‘সুপিরিয়র’ ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। লিঙ্গপরিচয়ের সুবাদে সামাজিক ভাবে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা তার কাছে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সহজ, স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। অপর লিঙ্গের ব্যক্তিদের তাচ্ছিল্য, হেয় করার অভ্যাসও রপ্ত করে। যুগ যুগ ধরে এই ব্যবস্থা চলতে চলতে এখন বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যেন পুরুষমাত্রেই ‘সুপিরিয়র’, শ্রেয়; আর নারী বা অপর লিঙ্গ মানেই ‘ইনফিরিয়র’, নিকৃষ্ট, পিছিয়ে পড়া। এমতাবস্থায় যদি ‘পিছিয়ে পড়া’, ‘পিছিয়ে থাকা’ নারীকুল নানা ভাবে সমাজের সব ক্ষেত্রেই সক্ষম হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে তবে পুরুষ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে বাধ্য হয়, প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখতে শুরু করে; কিন্তু তাকে স্বাগত জানাতে পারে না। বিশেষত যে পুরুষেরা আত্মসন্তুষ্টিতে মগ্ন, নিজেদের উৎকর্ষে মুগ্ধ, তারা নারীদের এই ক্ষমতায়নে অজানতেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সেই বোধ থেকে অনেক সময় তাদের ভিতর জমে ঈর্ষা, আক্রোশ যা নারীর প্রতি হিংসা, নিগ্রহের আকারে হিংস্র চেহারায় প্রকাশিত হয়। নারীকে নিজের চেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন হিসাবে পুরুষ মানতে পারে না। ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহের পিছনেও ক্রিয়াশীল সেই ক্ষমতার দম্ভ। কাজেই বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন নারীশিক্ষার বিস্তার এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রকারান্তরে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে ইন্ধন জোগায়। নারী যতই শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত, নিজের অধিকার নিয়ে সরব হবে, বাইরের জগতে পা ফেলবে, ততই নেমে আসবে নিপীড়নের মুষল।
সব পুরুষ নিশ্চয়ই এমন নয়। দেশে নারীশিক্ষার প্রবর্তকরা অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ। কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজের মানসিকতা দেশে বিশেষ বদলায়নি। তাই আজও কেন্দ্রীয় সরকার বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে তাদের বিশেষ আপত্তির কথা জানায়।