১৯ মে, ১৯৬১। শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১১ জন ভাষা সত্যাগ্রহী। মূল বাংলা থেকে দূরে এই জনপদে বাংলার সাংবিধানিক মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে সংঘটিত আন্দোলন আলোড়ন তুলেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ধারাবাহিক ভাবে ঠাঁই পেয়েছিল অবিভক্ত কাছাড় জেলার সংগ্রাম। ২০ মে-র শিরোনাম: ‘কাছাড়ে বাঙ্গালী নিধন পর্ব: আসাম সরকারের বিভৎস চণ্ডনীতি’। নেহরুর নির্দেশে অসম যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। কিছু দিন শিলঙে থেকে সব পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র বার করার চেষ্টা করেন— ‘শাস্ত্রী-সূত্র’।
১৯৬০-এর ২৪ অক্টোবর বিধানসভায় অসমের সরকারি ভাষা আইন পাশ হয়। বিমলাপ্রসাদ চালিহা মন্ত্রিসভার এই বিল নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরেই অসন্তোষ ছিল, কাছাড়ের বিধায়করা ভাষানীতি মানতে পারেননি। ওই বিলে অসমিয়াকেই সে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়, একভাষী রাজ্যের চেহারা পায় অসম। অথচ, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব বা সংস্কৃতির নিরিখে অসম কখনও একভাষী নয়। সংবিধানের সপ্তদশ অধ্যায়ের ৩৪৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে যে ভাষা আইন বিধানসভায় গৃহীত হয়, তা ৩৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হয়ে যায়। সে দিন শুধু অসমিয়া নয়, বাংলারও সরকারি ভাষা হওয়ার যোগ্যতা ছিল।
ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রশাসনিক স্বার্থে উত্তর-পূর্বকে কাটাকুটি করেছেন। সাংস্কৃতিক ভূগোলের সঙ্গে খাপ খায়নি রাজনৈতিক ভূগোল। ১৮২৬-এ ‘ইয়ান্ডাবু সন্ধি’তে অসম ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। জোড়া হয় বাংলার সঙ্গে। বাংলায় তখন সরকারি কাজকর্ম ও আদালতের ভাষা ফারসি। কাছাড় তখনও ডিমাসা শাসনাধীন। ডিমাসা রাজদরবারের ভাষা ছিল বাংলা। সরকারি ভাষা হিসেবে বঙ্গদেশেই যখন বাংলার প্রচলন হয়নি, তখনই কাছাড়ে বাংলার রমরমা! ডিমাসা বা কাছাড়ি রাজত্বে ঋণদান ও দণ্ডদান বিধি বাংলায় লেখা হত। সপ্তদশ শতকে কাছাড়ি রাজসভার কবি ভুবনেশ্বর বাচস্পতি পয়ার ছন্দে নারদীয় রসামৃত বাংলা অনুবাদ করেন। পরের শতকে রাজা সুরদর্প নারায়ণ সম্পর্কে কবি চন্দ্রমোহন বর্মণ লেখেন, “হেথায় হেড়ম্ব দেশে সুরদর্প রাজা/ আশ্বিনে প্রতিমা গড়ি করে দুর্গাপূজা।” বর্তমান বরাক উপত্যকায় বাংলার প্রচলন ও প্রসারের ইতিহাসের সূত্র মধ্যযুগেও পাওয়া যায়।
ভাষা সমস্যার সূচনা ১৮৩৭ সালে। বঙ্গদেশে বাংলাকে সরকারি ভাষা বানিয়ে ইংরেজরা অসমের সরকারি দফতর, আদালত ও শিক্ষাক্ষেত্রেও বাংলা চালু করে। নবজাগ্রত অসমিয়া মধ্যবিত্ত একতরফা সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না। মনে করা হয়, ইংরেজ ঘনিষ্ঠ বাঙালিরাই ‘দুষ্কর্ম’-এর জন্য দায়ী। পরে অসমিয়া গবেষকরাই দেখিয়েছেন, বাংলা চালুর পিছনে বাঙালিদের ভূমিকা ছিল না। ১৮৭৩-এ সিদ্ধান্ত পাল্টে মর্যাদা পায় অসমিয়া। কিন্তু তত দিনে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের চোখে বাঙালিরা ‘অপরাধী’ হয়ে গিয়েছেন। পরের বছর চিফ কমিশনার শাসিত অসম প্রদেশ তৈরি করতে গিয়ে বাংলাভাষী গোয়ালপাড়া, সিলেট ও কাছাড়কে প্রশাসনিক বিভাগে ঢোকায় ইংরেজরা, কারও মতামত না নিয়েই। অসম ও সিলেটে প্রতিবাদ হয়। বাঙালিরা তখন নতুন অসমে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ‘সংখ্যালঘু’ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে সিঁদুরে মেঘ দেখেন অসমিয়ারা। ‘সম্প্রসারণবাদী’ বাঙালিদের ‘আক্রমণে’ তাঁদের অধিকার যায় যায়! অবশেষে স্বাধীনতা আসে বাংলাকে ভাগ করে। গণভোটে সাড়ে তিন থানা বাদ দিয়ে সিলেট যায় পাকিস্তানে। অসমে কমে বাংলাভাষীর সংখ্যা। স্বস্তি আসে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের ঘরে। ভাষা-বিদ্বেষের কবলে পড়ে অসম, এক ভাষা প্রতিষ্ঠা সেই পটভূমিতেই।
কাছাড়ের গণসংগ্রামের ফলে সংশোধিত হয় সরকারি ভাষা আইন, বরাক উপত্যকার ভাষা হয় বাংলা, রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা ইংরেজি। আজও অসমে বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রণোদনা এই আন্দোলন। তার মূল চরিত্রে প্রতাপ বা বিদ্বেষ ছিল না। কাছাড় থেকে পদত্যাগ করা প্রথম বিধায়ক নন্দকিশোর সিংহ অবাঙালি। শিলং-এ মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন খাসিয়ারা। অসমে সব ভাষাগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষিত রাখা ছিল আন্দোলনের উদ্দেশ্য। তবু, ষাট বছর পরেও গুলিচালনা তদন্তে গঠিত মেহরোত্রা কমিশনের প্রতিবেদন সরকার প্রকাশ করেনি। ২১ ফেব্রুয়ারি মনে রাখলেও এই আত্মত্যাগ মানুষ বিস্মৃত। জনস্মৃতিতে নেই কুমুদ, সত্যেন্দ্র, সুনীল, শচীন্দ্র, বীরেন্দ্র, হিতেশ, চণ্ডীচরণ, সুকোমল, তরণী, কানাইলাল, কমলা। ১৯৫২’র আন্দোলন রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করেছিল, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জন্ম। ১৯ মে তা পারেনি। তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা নির্বাচনী রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে গিয়েছে। দিনটি ফুল-মালায় উদ্যাপিত হলেও ইভিএমে বোতাম টিপতে গেলে আড়াল থেকে ধর্মীয় পরিচিতিই উঁকি দেয়। বাঙালি চেতনা ঢাকা পড়ে যায় মেরুকরণের রাজনীতিতে।
অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ, শিলচর