শিউরাম বা শিবরামকে দিয়েই এই লেখা শুরু করা যায়। বৃন্দাবনের রূপ গোস্বামীর গোবিন্দদেব মন্দিরের সেবায়েত শিবরাম ১৬৭১ সালের অক্টোবর মাসে বিগ্রহ নিয়ে পালাল। মোগল বাদশাহ ঔরঙ্গজেব কয়েক মাস আগে মথুরার কেশবদেব মন্দির ভেঙে দিয়েছেন, গোবিন্দদেব তবে আর নিরাপদ থাকবেন কী ভাবে?
অম্বরের রাজা মানসিংহের বংশধরেরাই এই মন্দিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। মাঝপথে অম্বররাজ রামসিংহের নির্দেশ এল— মথুরা ছাড়িয়ে ভূতেশ্বর অবধি চলে এসো, সেখান থেকে বিগ্রহ নিয়ে অম্বর। এই পরিস্থিতিতে বৃন্দাবন, মথুরায় না থাকাই ভাল।
অম্বর অবধি কিন্তু যায়নি শিউরাম। ১৬৭৫ সালে সে বিগ্রহসমেত বৃন্দাবনে ফিরে আসে। ১৬৯২ সাল অবধি সে সেখানেই ছিল। তার চেয়েও বড় কথা, ঔরঙ্গজেবের প্রপিতামহ সম্রাট আকবরের আমলে গোবিন্দদেব মন্দিরের ব্যয়নির্বাহের জন্য যে ১৩৫ বিঘা জমি দেওয়া হয়েছিল, প্রপৌত্রের জমানাতেও সেটি অক্ষুণ্ণ থেকে গেল। বাদশাহ জমি নিলেন না, মন্দির ভাঙতেও এলেন না।
শুধু গোবিন্দদেব নন, ঔরঙ্গজেবের আমলে বৃন্দাবনের গোপীনাথ ও মদনমোহন মন্দিরের জমির চরিত্রেও পরিবর্তন হল না। বরং ১৬৯৭ ও ১৭০৭ সালে দু’-দু’বার জানানো হল, আকবরের আমলে এই মন্দিরগুলি যে রকম ১০০ বিঘা জমি ভোগ করত, সেই নিয়ম বলবৎ থাকবে। মদনমোহন মন্দিরের সেবায়েত গোসাঁইদাস আবেদন করলেন, আকবরের আমলে তাঁদের জমি উপভোগের যে বাদশাহি স্বত্ব বা চকনামা দেওয়া হয়েছিল, জাঠ বিদ্রোহের সময় সেটি হারিয়ে গিয়েছে, এই সমস্যার সুরাহা করা হোক। জানা গেল, অসুবিধা নেই, ফের জরিপ করে তাঁকে নতুন চকনামা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হবে। কাল্পনিক গল্প নয়, নথিপত্রগুলি এখনও বৃন্দাবন শোধ সংস্থান নামে একটি গবেষণা-প্রতিষ্ঠানে আছে, ইরফান হাবিব ও প্রয়াত তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার ফল হিসাবে সেগুলি সম্প্রতি ব্রজভূম ইন মোগল টাইমস নামে এক বইতে সঙ্কলিত হয়েছে।
অর্থাৎ, উপনিবেশের শেখানো লব্জতে আমরা যতই আকবর বনাম ঔরঙ্গজেব তথা গুড মুসলিম বনাম ব্যাড মুসলিম কপচাই না কেন, মোগল শাসনের নিয়মনীতিগুলি মোটের উপর এক ছিল, তেমন বিচ্যুতি ঘটেনি। ১৫৯৩ সালে আকবরের ফরমান: মথুরা-বৃন্দাবনে ময়ূর শিকার করা যাবে না, মন্দিরের গোসম্পদে কর ধার্য করা যাবে না। তার ৬৬ বছর পরে, ১৬৫৯ সালে ঔরঙ্গজেবের ফরমানও প্রায় এক। মন্দিরের গোচারণভূমিতে কোনও বাধা সৃষ্টি করা যাবে না, আকবরের নিয়মই চলবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ঔরঙ্গজেব যদি এতই সহিষ্ণু, তা হলে মথুরায় কেশবদেবের মন্দির ভাঙলেন কেন? আর মোগল দরবারের ঘনিষ্ঠ অম্বররাজই বা শিউরামকে বিগ্রহ নিয়ে পালিয়ে আসায় উৎসাহ দিলেন কেন? ফিরে যেতে হবে জাঠ বিদ্রোহের কথায়, যার নেতা ছিলেন গোকুল নামে এক মথুরাবাসী জোতদার। বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল মথুরার কেশবদেব মন্দির। ঔরঙ্গজেবের বড়দা দারাশিকো ওই মন্দিরে সোনার রেলিং গড়ে দিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেব রেলিং তো বটেই, গোটা মন্দিরটিকে ধ্বংস করে দেন। অম্বররাজ সেই ধ্বংসকাণ্ডে ভয় পেয়ে শিউরামকে ইষ্টদেবতা-সহ চলে আসতে বলেন। ঔরঙ্গজেবের চরিত্র এটাই। বিদ্রোহকে রেয়াত করেন না। হিন্দুবিদ্বেষী মুসলমান নামক একমাত্রিক ছাঁচে এ-চরিত্র ধরা যাবে না।
ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী প্রায়ই বলতেন, “আমাদের দোষটা কোথায় জানো? ইংল্যান্ডের ইতিহাসে যেমন খ্রিস্টান বনাম মুসলমান ক্রুসেড আছে, ক্যাথলিক বনাম প্রোটেস্টান্ট লড়াই আছে, সেখানকার লোকেরা এ দেশের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ভাবলেন, হিন্দু বনাম মুসলমান ব্যাপারটা ওই রকম।” এটাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সারাৎসার। বছরশেষে গুজরাত, হিমাচলপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। অতঃপর আগামী বছর রাজস্থান,তেলঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, মেঘালয়, ত্রিপুরা, কর্নাটক। তার পরে ২০২৪। অতএব হিন্দুত্ববাদ ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত হয়েছে। বছর পাঁচেক আগে বৃন্দাবন, মথুরায় গিয়েছিলাম। বৃন্দাবন নিরামিষাশী। মাঝে মাঝে তাই জেলাশহর মথুরায় চলে আসতাম। সেখানে মাছ-মাংস পাওয়া যেত। গত বছর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথমথুরাকে নিরামিষাশী ঘোষণা করে দিয়েছেন! ঘুঁটি সাজানো চলছে।
চলছে আদালতের চত্বরেও। অজ্ঞাতকুলশীল কিছু সংগঠন ঠিক ঠিক জায়গা বেছে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্যান্ডোরার বাক্স খোলার ব্যবস্থা করছে। নেহাতই পুরনো ছক। অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির আগের ধাপটা মনে করা যাক। ফৈজাবাদ ছিল বড় শহর, লখনউয়ের ঢের আগে থেকে ফৈজাবাদই ছিল অওধের নবাবদের রাজধানী। ছোট্ট অযোধ্যা স্টেশনে বেশির ভাগ ট্রেন দাঁড়াত না, থাকার জন্য গোটাকয়েক ধর্মশালা। ভদ্রস্থ হোটেল, রেস্তরাঁ মানেই ফৈজাবাদ। সেই ফৈজাবাদ নামটা উড়িয়ে দিয়ে বলা হল, গোটা জায়গাটাই অযোধ্যা। বাকিটা ইতিহাস। প্যান্ডোরার বাক্স এক বার খোলা হলে আইন-আদালত দিয়ে কি আর তাকে বন্ধ করা যায়?
আদালতি প্রতর্কে আইনের হরেক ব্যাখ্যা চলতেই থাকবে। কিন্তু জনসমাজের ছোট ইতিহাস? মথুরায় ফিরি। কৃষ্ণজন্মভূমির পাশে একটি ইদগা থাকায় যাঁদের রাতের ঘুম উবে গিয়েছে, তাঁরা বরং ওই জন্মস্থানের পাশে ‘হোলি দরওয়াজা’ পেরিয়ে মুসলিম মহল্লায় চলে আসতে পারেন। পারভিন, সাজিদা প্রমুখ মুসলিম মহিলারাই বংশপরম্পরায় মথুরার শ্রীকৃষ্ণ ও অন্যান্য বিগ্রহের পোশাক, মুকুট তৈরি করেন। ৬১ বছরের বৃদ্ধ মুন্না খান চমৎকার কীর্তন গান, মহল্লার রামনবমীতে তাঁর গান অন্যতম আকর্ষণ। জনসমাজের স্থানীয় ছোট ইতিহাসে মন দিন, হিন্দুত্বের শিখা আপনিই নিবে যাবে।
১৯৯১ সালে ধর্মস্থান অবিকৃত রাখার আইন বজায় রাখার সাংবিধানিক যুদ্ধটাই তাই একমাত্র পথ নয়। মথুরার সাজিদারা কোনও আইনবলে বলীয়ান হয়ে শ্রীকৃষ্ণ, দেবকীর পোশাক বানান না। ব্রজভূমে আর যা-ই থাক, কৃষ্ণ জন্মভূমি নামে কস্মিন্কালে কোনও মন্দির নিয়ে মাতামাতি ছিল না। ১৮০৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মথুরা দখল করে। সেখানকার বড় বাজার বা কাটরার জমি নিলামে কেনেন বারাণসীর ব্যবসায়ী রাজা পাটনিমল। আজ বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার মসজিদে পর পর ভিডিয়ো-জরিপের আবেদনে ইতিহাসের দেবতা তাই মুচকি হাসতে পারেন। বিষাদের হাসি।
কাটরা বা বাজার এলাকায় রাজা পাটনিমলের উত্তরসূরিরা এই মন্দির তৈরির চেষ্টা করেন, মসজিদের তরফে এই চেষ্টার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। কিন্তু ১৯৩৫ সালে পাটনিমলের উত্তরসূরি রাজকৃষ্ণ দাসের হয়ে মামলা লড়তে এসে কংগ্রেস নেতা ও আইনজীবী কৈলাসনাথ কাটজু জিতলেন। অতঃপর ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩ হাজার টাকায় রাজকৃষ্ণের থেকে জায়গাটা কিনে নিলেন মদনমোহন মালবীয় ও যুগলকিশোর বিড়লা। মালবীয়ের মৃত্যুর পর বিড়লা ও জয়দয়াল ডালমিয়া মিলে স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি ট্রাস্ট তৈরি করেন। সেই ট্রাস্ট ১৯৫৩ সালে মন্দির তৈরির কাজ শুরু করে, শেষ হয় ১৯৮২ সালে।
বছর পাঁচেক আগে গিয়েছিলাম এই মন্দিরে। ভুগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করে দেখি, গরাদের আড়ালে শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে দাড়িওয়ালা বসুদেব, কাতর শয়ানে দেবকী। দূরে যোগমায়া। এমন ঝুলনমার্কা জেলখানা-মন্দির ভূভারতে কোথাও দেখিনি।
এটাই সেই কারাগার কি না, শ্রীকৃষ্ণ নামক শিশুটি এখানেই জন্মেছিলেন কি না, কেউ জানে না। জানার কথাও নয়। মথুরা জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট: ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে গজনীর সুলতান মামুদ, পরে সিকন্দর লোদী এই নগরীতে লুটপাট, ধ্বংসলীলা চালিয়েছিলেন; তার পরই সটান লোকবিশ্বাস: “মোগল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের আমলে কৃষ্ণ জন্মভূমির লাগোয়া যে ইদগা মসজিদ তৈরি হয়েছিল, লোকবিশ্বাস, সেটি এক মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে তৈরি।” লোকবিশ্বাস নিয়ে এই হাঙ্গামা একশো বছর আগেও ছিল না। প্রায় একশো বছর আগে, বাংলা ১৩৩৩ সালে মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকায় পুলিনবিহারী দত্ত ‘মাথুর কথা’ নামে মথুরা ভ্রমণ নিয়ে একটি ধারাবাহিক লিখতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অবধি সকলে তখন সেই লেখার প্রশংসা করেছিলেন। পুলিনবিহারী তাঁর গাইড-বইয়ে একটি মানচিত্র দিয়ে জানাচ্ছেন, টিলার এ পাশে কারাগার, এখানে মসজিদ, আর একটু এগিয়ে পাশে পোতড়া কুণ্ড, দেবকী যেখানে আঁতুড়ের সদ্যোজাত শিশুর জামাকাপড় কেচেছিলেন। লোকবিশ্বাস নিয়ে মুশকিল— সদ্য-জননী দেবকীকে শুধু বন্দিনি থাকলে চলবে না, আঁতুড় ঘর থেকে বেরিয়ে স্নান এবং কাচাকুচি সেরে পবিত্রও হতে হবে। জন্মস্থান নিয়ে মথুরার জনতা একশো বছর আগেও মাথা ঘামায়নি। বরং এখানকার ব্রাহ্মণদের বিখ্যাত শ্লোক, “ভূতেশ্বরঞ্চ বরাহং কেশবং ভাস্করং ধ্রুবম্। দীর্ঘবিষ্ণুঞ্চ বিশ্রান্তিং মহাবিদ্যেশ্বরীং তথা।” মানে, ভূতেশ্বর শিবলিঙ্গ, বালক ধ্রুব, ভাস্কর সূর্যদেব এবং কেশব, দীর্ঘবিষ্ণু, বিশ্রান্তি, বরাহ নামের চারটি বিষ্ণুমূর্তিই এখানে আরাধ্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমানই যে এক এবং একমাত্র দেবতা, এমন কথা সেখানে ছিল না।
কিন্তু ভোটভিখারি হিন্দুত্বের এ সব কথায় কী আসে যায়?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।