Togetherness

ইবাদতের মাস, একাত্মতারও

মা-বাবুজিকে রমজানের রোজা তরক করতে দেখিনি কোনও দিন। সেই সঙ্গে দেখিনি সেহরি বা ইফতারে বাড়াবাড়ি কোন আয়োজন করতে।

Advertisement

সেমিমা হাকিম

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫ ০৭:৩৩
Share:

তা  হলে আজ ভোর রাতে সেহরি!” আকাশবাণীতে নাখোদা মসজিদের ইমামের রোজা ঘোষণার সংবাদ শোনামাত্র শুরু হত মায়ের প্রস্তুতি। সে অবশ্য সামান্যই। রাতের রান্নার সঙ্গে সামান্য বেশি— উদ্বৃত্তটুকু দিয়েই ভোর রাতের সেহরি, ডাল-ভাতের সঙ্গে এক টুকরো মাছ বা মাংস, তার পর গোটা দিন নির্জলা উপবাস।

Advertisement

মা-বাবুজিকে রমজানের রোজা তরক করতে দেখিনি কোনও দিন। সেই সঙ্গে দেখিনি সেহরি বা ইফতারে বাড়াবাড়ি কোন আয়োজন করতে। নবিজি সাধারণত খেজুর বা কোনও মিষ্টি জাতীয় খাবার দিয়ে ইফতার শুরু করতেন। নবিজি যা বলেছেন বা করেছেন, তার পালনকে সুন্নত বলে। সুন্নত পালনার্থে মা-বাবুজিও খেজুর ও জল দিয়ে রোজা খুলতেন, সঙ্গে থাকত দু’-এক টুকরো করে বিভিন্ন মরসুমি ফল এবং অবশ্যই চিনি নুন পাতিলেবুর শরবত। ফলাহার সেরে মগরিবের নমাজ পড়তেন দু’জনে। তার পর বেগুনি, পেঁয়াজি আর ছোলাভাজা দিয়ে মুড়ি খেতেন, সঙ্গে ঘন দুধের চা।

সব বাড়িতে অবশ্য এমন সাদামাঠা নয় সেহরি-ইফতার। আমাদের গ্রামের বাড়িতেই ভাবিরা রাত দুটোয় নতুন করে উনুন ধরিয়ে এক-এক জনের চাহিদামতো এক-এক রকমের পদ রাঁধতে বসতেন। আমার এক সহকর্মীর কাছে শুনেছিলাম, তাঁর আব্বা নাকি সেহরিতে পোলাও, বিরিয়ানি, মোগলাই, রোল ইত্যাদি খান। যে দিন যেটা ইচ্ছে হয়, সেই সহকর্মীর মা অত রাতে সেটাই বানিয়ে দেন। ইফতারেও থাকে রাজসিক খাবারদাবারের ব্যবস্থা। দুপুর থেকে শুরু হয়ে যেত ইফতারের জন্য রান্নাবান্না, জোগাড়যন্ত্র। ভেবেছিলাম, যে রমজান নিজের নফস বা প্রবৃত্তিকে দমন করার মাস, সেখানে এই ধরনের চাহিদা বড্ড বেমানান।

Advertisement

রমজান তো শুধু দিনেরবেলা খাওয়া থেকে বিরত থাকা না। এ মাস ইবাদতের। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সকলেই বেশি করে কোরান শরিফ পড়েন, তসবিহ পাঠ করেন, রমজানের বিশেষ নমাজ তারাবিহ আদায় করেন, এতেকাফে বসেন অনেকে। পুরুষদের জন্য এই অতিরিক্ত এবাদতের জন্য সময় বার সহজ হলেও নারীদের জন্য সহজ না। রোজা রেখে সারা দিন খাটুনির পরে রাত জেগে হেঁশেল সামাল দেওয়া, সবার আবদার মেটানোর পর ভেঙে আসে শরীর। তবু পরকালের ভয়ে যে কোনও প্রতিকূলতা জয় করে নিতে পারেন তাঁরা।

সেহরি শেষ হয় প্রায় ফরজের আজানের আগে। নমাজ পড়ে মহিলারা বসেন তেলাওয়াতে। রমজানে সম্পূর্ণ কোরান শরিফ এক বার পড়া বিধেয়। একে ‘এক খতম’ বলে। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে চাপা প্রতিযোগিতা চলে, কে কত খতম দিল তা নিয়ে। বলা হয়, ইলম (জ্ঞানার্জন) ও ইবাদত (আল্লাতায়ালার সাধনা)— এই দুইয়ের জন্য ঈর্ষা ও পরস্পরকে ছাপিয়ে যাওয়ার সুস্থ প্রচেষ্টা সব সময় জায়েজ। তাই বাড়ির মেয়েরা সময় পেলেই বসে যান কোরান শরিফ পড়তে। হোক না তা এক আয়ত (একটি বাক্য), বা এক রুকু (অনুচ্ছেদ), বা এক পারা (খণ্ড)। একটু-একটু করে জুড়েই দেখা যায়, কোনও কোনও মহিলার দুই-তিন, এমনকি পাঁচ খতম পর্যন্ত হয়ে যায় রমজান মাসে।

রমজান মাসে থাকে জাকাত, ফেতরা, সদকা ইত্যাদি অনেক কাজ। এর মধ্যে জাকাত ও সদকা সারা বছর ধরে দেওয়া গেলেও অতিরিক্ত নেকি বা পুণ্যের আশায় বেশির ভাগ দানখয়রাত করা হয় এই মাসেই। তবে যেমন খুশি আর যাকে খুশি দেওয়া যায় আবার এই টাকা। বাবুজি খবরের কাগজ খুলে সোনারুপোর দাম দেখে বাড়ির সমস্ত গয়নার দাম কষতেন সঙ্গে যোগ করতেন ব্যাঙ্কের জমা টাকা (যা এক বছরের থেকে বেশি সময় জমা আছে)। তার আড়াই শতাংশ জাকাত দিতে হবে। জাকাতের প্রথম হকদার দুঃস্থ আত্মীয়, তার পর প্রতিবেশী, আশেপাশের অঞ্চলের গরিব মানুষজন। অর্থাভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না এমন শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও জাকাত দেওয়া যেতে পারে এবং পরিমাণে এতটা হতে হবে যে, সে দিন যেন তাকে অন্যের কাছে ভিক্ষা করতে না হয়।

অনেক গরিব মানুষ জাকাত নিতে চান না। বলেন, “কেয়ামতের মাঠে কপালে লেখা থাকবে জাকাত গ্ৰহণকারী।” তাঁরা কিন্তু সদকা গ্ৰহণ করেন। তাই দিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটান। আর অবস্থাপন্ন মানুষ পুণ্য জমান এই সব নানা অছিলায়।

রমজানের শেষাংশে আসে ফেতরা। জাকাত সদকা যেমন শুধু ধনীদের জন্য নির্দিষ্ট, ফেতরা কিন্তু দিতে হয় প্রতিটি মুসলমানকে এবং এক জনের ফেতরার সম্পূর্ণ টাকা বা খাদ্যবস্তু শুধুমাত্র এক জনকেই দেওয়া যাবে। দুই বা ততোধিকের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া নিষেধ। আড়াই সের যব বা সমমূল্যের টাকা দান করতে হয় এ ক্ষেত্রে। গরিব মানুষেরও কাজ হতদরিদ্রকে ফেতরা দেওয়া। দানের মধ্যে যে আলো জ্বলে ওঠে নিজের অন্তরে তাকে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে যেন ফেতরার মধ্যে দিয়ে।

রমজান যত শেষের দিকে চলে আসে মন খারাপ হয়ে যায় সবার। এই এক মাস ধনী-দরিদ্র সবাই এক সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে তারাবিহ পড়েছে, এক থালা থেকে খাবার খেয়েছে মজলিশি ইফতারে, একে অন্যের প্রয়োজন মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিনা প্রশ্নে— এই যে একাত্মবোধ, এই এক শরীর হয়ে ওঠা, এই সুখানুভূতির সময় যেন শেষ হয়ে আসে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement