ব্র্যান্ড মোদী দুর্বল হলেও ব্র্যান্ড রাহুল-এর ভাগ্যে সূর্যোদয় হয়নি
Rahul Gandhi

নেতৃত্বের দাবি কোণঠাসা

কংগ্রেসের সদর দফতরে সে দিন দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসেছিল। মহারাষ্ট্রের হার নিয়ে অনেকেই ইলেকট্রনিক ভোট যন্ত্র ওরফে ইভিএম-কে দোষারোপ করছিলেন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৫
Share:

এ বছর দিল্লিতে নভেম্বরের শেষে একেবারেই ঠান্ডা ছিল না। চব্বিশ নম্বর আকবর রোডের কনফারেন্স হল নভেম্বরের শেষ বিকেলে যথেষ্ট উত্তপ্তই ছিল। কংগ্রেসের সদর দফতরে সে দিন দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসেছিল। মহারাষ্ট্রের হার নিয়ে অনেকেই ইলেকট্রনিক ভোট যন্ত্র ওরফে ইভিএম-কে দোষারোপ করছিলেন। আদানি ঘুষ কাণ্ড নিয়ে কী ভাবে নরেন্দ্র মোদীকে কোণঠাসা করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা পেশ করছিলেন। সে সময় আচমকাই শশী তারুর বলেছিলেন, এ সব ছেড়ে কংগ্রেসকে আমজনতার সমস্যা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। যেমন, বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধি।

Advertisement

রাহুল গান্ধী তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ইভিএমে কারচুপি ও আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও আমজনতার বিষয়। সে দিন শশী তারুর যা বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস এখন একই কথা বলছে। তা হল, শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ঘুষ দিয়ে বেশি দামে সৌর বিদ্যুৎ বিক্রির বরাত আদায়ের অভিযোগ আমজনতার বিষয় নয়।

শুধু আদানি কেলেঙ্কারি বলে নয়। আধ ডজন উপনির্বাচনে জিতে তৃণমূল নেতৃত্ব এখন মনে করছে, দুর্নীতি ব্যাপারটাই এখন আর ভোটের বিষয় নয়। কারণ, স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ, শিক্ষামন্ত্রীর গ্রেফতারি থেকে হাসপাতালে দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের অভিযোগের পরেও তৃণমূল গত লোকসভা ভোটে, তার পরে উপনির্বাচনে ভাল ফল করেছে। তার আগে সারদা-রোজ় ভ্যালির মতো চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি বা নারদ কাণ্ডের পরেও তৃণমূল নির্বাচনে জিতে এসেছে।

Advertisement

তৃণমূল নেতৃত্ব যেটা বলছেন না, তা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় উপর থেকে নিচুতলা পর্যন্ত দুর্নীতি নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী শিবির তা নিয়ে ভোটারদের নাড়া দিতে পারেনি। নির্বাচনের দিন যে বিরোধী ভোটারদের বাড়ি থেকে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বুথ পর্যন্ত নিয়ে আসতে হয়, তা বিরোধী দলগুলি করে উঠতে পারেনি। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলগুলির সেই সাংগঠনিক শক্তি নেই। আর জি কর আন্দোলন তীব্র হলেও ভোটে তার প্রতিফলন না পড়ার এটাই কারণ।

রাহুল গান্ধীরও একই সমস্যা। তিনি আদানি ঘুষ কাণ্ড বা নরেন্দ্র মোদী-গৌতম আদানির আঁতাঁতকে আমজনতার বিষয় করে ফেলতেই পারেন। কারণ আদানি সত্যিই ঘুষ দিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বেচে থাকলে, তার বিল আমজনতাকেই মেটাতে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে ভোটারদের নাড়িয়ে তোলার জন্য যে সংগঠন দরকার, তা কংগ্রেসের কাছে নেই। মনমোহন সরকারের শেষ জমানায় যখন টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই শুরু হল, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, এ সব মানুষ বুঝবে না। কিন্তু বিজেপি প্রচার করে করে মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে, ইউপিএ সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা ঘুষ খেয়েছেন। আদানি ঘুষ কাণ্ড বা ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে বিজেপিকে বিপাকে ফেলতে হলে একই রকম প্রচার দরকার। কংগ্রেসের কাছে তার জন্য প্রয়োজনীয় সংগঠন কোথায়?

রাহুল গান্ধী সব সময়ই বিজেপি-আরএসএসকে একই বন্ধনীতে রেখে নিশানা করেন। বিজেপি ও আরএসএসের সংগঠন নির্বাচনের ময়দানে টাট্টু ঘোড়ার মতো ছোটে, তার কারণ মতাদর্শ। বিজেপি-আরএসএস যাকে হিন্দুত্ব বলে, রাহুল তাকে বিভাজনের রাজনীতি বলেন। কিন্তু এই মতাদর্শই ফেভিকলের মতো বিজেপি ও আরএসএসকে বেঁধে রাখে। ‘বাঁটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ থেকে ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’ মন্ত্রে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-আরএসএসের এককাট্টা হওয়ায় তা ফের প্রমাণিত। উল্টো দিকে কংগ্রেসের মতাদর্শ কি সংগঠনকে দৌড় করাতে পারে?

কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের মতাদর্শকে নতুন মোড়কে হাজির করেছিলেন। আর্থিক অসাম্য, সামাজিক ন্যায়, সংবিধানকে সামনে রেখে রাহুল গান্ধী বিজেপির থেকে কংগ্রেসের ফারাক বুঝিয়েছিলেন। তার সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, কৃষকদের সমস্যার মতো আমজনতার রোজকার রুটিরুজির প্রশ্ন যোগ হয়েছিল। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জিততে না পারলেও তারই ফয়দা তুলেছে। ‘ঘৃণার বাজার’-এ তিনি ‘মহব্বতের দোকান’ খুলতে এসেছেন বলে রাহুল গান্ধী নিজেকে কংগ্রেসের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, কিন্তু তাতে কংগ্রেসের সাংগঠনিক সমস্যা মেটে না। রাহুল গান্ধী নিজে সংগঠনের নিচুতলা থেকে উঠে আসেননি। ফলে তার পক্ষে সংগঠন সামলানো মুশকিল। আবার রাহুল গান্ধী তথা গান্ধী পরিবারকে বাদ দিয়ে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের হাতে পুরোপুরি সংগঠনের লাগাম থাকবে, কংগ্রেস দলে এটাও ভেবে নেওয়া মুশকিল। কংগ্রেসের নেতারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে থাকলে ভোটারদের মধ্যে কংগ্রেসের সংগঠন সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। ফলে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে কংগ্রেসকে বার বার হারতেই হবে।

মহারাষ্ট্রের ভোটে কংগ্রেসের জোটের হার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, একই মন্ত্র আওড়ে বার বার ভোটারদের মন জয় করা যাবে না। লোকসভা ভোটে রাহুল গান্ধী সংবিধান হাতে দলিতদের ভোট টেনেছিলেন। কৃষকদের সমস্যা, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষের ফয়দা তুলেছিলেন। কিন্তু সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে রাহুল গান্ধী একমাত্র জাতগণনার বাইরে আর কোনও বিকল্প নীতি দেখাতে পারেননি। রাহুল বার বার কৃষকদের সমস্যা, বেকারত্বের কথা বলছেন। সেখানেও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার বাইরে কংগ্রেস আর কোনও সমাধান দেখাতে পারেনি। প্রবল ভাবে হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকে পড়া শহুরে মধ্যবিত্তের জন্য রাহুল গান্ধীর ভাষ্যে কিছু নেই। কংগ্রেসের এখন ‘মুসলিমদের দল’ তকমাতেও আপত্তি। ফলে বিজেপি আবার মন্দির-মসজিদ বিতর্ক খাড়া করতে চাইলেও বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এগোলেও কংগ্রেস হিন্দুত্বের প্রশ্নে সরাসরি সংঘাতে যেতে নারাজ।

প্রশ্ন হল, তা হলে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি বা আরজেডি, ডিএমকে-র মতো আঞ্চলিক দলের ফারাক কী থাকল? যদি ফারাক না-ই থাকে, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী জোট ইন্ডিয়া-র নেতৃত্ব দাবি করলে আপত্তি কোথায়?

কংগ্রেস বিরোধী জোটের নেতৃত্বের দাবি শুধু একটাই কারণে করতে পারে। তা হল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় উপস্থিতি। কিন্তু প্রশ্ন হল, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস একা লড়লে লোকসভা নির্বাচনে কত আসনে জিততে পারবে? এই পাঁচটি রাজ্যে লোকসভা আসনের সংখ্যা ২৪৯টি। লোকসভার মোট আসন ৫৪৩-এর প্রায় অর্ধেক। আর যেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির একার লড়াই, সেখানেও কংগ্রেসের হাল কহতব্য নয়। ঠিক এই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্ব দাবি করছেন। কংগ্রেসকে কোণঠাসা করতে বাকি আঞ্চলিক দলের নেতানেত্রীরাও তৃণমূল নেত্রীকে সমর্থন করছেন।

রাহুল গান্ধীর এত দিন সবচেয়ে বেশি মাথা ব্যথা ছিল ‘ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদী’। সেই ‘ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদী’-র জনপ্রিয়তা এখন কমতে শুরু করেছে। লোকসভা ভোটে ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ থেকে ‘মোদীর গ্যারান্টি’-র প্রচার সত্ত্বেও বিজেপির আসন কমে যাওয়ায় তা প্রমাণিত। কিন্তু তাতে রাহুল গান্ধীর দুশ্চিন্তা বাড়ছে বই কমছে না। কারণ বিজেপি এখন নরেন্দ্র মোদীকে ছাড়াই রাজ্যের বিধানসভা ভোটে জিতছে। রাহুল গান্ধী ‘ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদী’-তে কালি ছেটাতেই অতীতে রাফাল বিমান কেনায় দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন। এখন তিনি আদানি ঘুষ কাণ্ড নিয়ে রোজ সংসদ চত্বরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। মুশকিল হল, ‘ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদী’ অস্তাচলে গেলেই যে ‘ব্র্যান্ড রাহুল গান্ধী’-র উদয় হবে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই।

লোকসভা ভোটে কংগ্রেস ৯৯ আসন জেতার পরেই হয়তো রাহুল গান্ধী ধরে নিয়েছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে সূর্যোদয় শুরু হয়েছে। হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের ভোটের ফল দেখিয়ে দিয়েছে, বাস্তব তা নয়। রাহুল গান্ধী যদি ধরে বসে থাকেন, কালের নিয়মেই এক দিন নরেন্দ্র মোদীর পতন ও তাঁর উত্থান হবে, তা হলে ভুল করবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরীওয়ালরা সুযোগ পেলেই কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীকে হবু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement