হাতে পাঁজি মঙ্গলবার কি না জানি না। তবে আজ, মঙ্গলবার কার্নিভালের রকমসকম দেখলে দক্ষিণেশ্বরের সেই পূজারি ব্রাহ্মণ নির্ঘাত তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি একটু পাল্টে দিয়ে বলতেন, “পাঁজিতে বিশ আড়া জল লেখা আছে। নিংড়ালে এক ফোঁটাও কার্নিভাল বেরোবে না।”
রানি রাসমণির দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মাসমাইনে-করা সেই পুরোহিত তরুণদের খুব ভালবাসতেন। তাঁরা দেখা করতে গেলে বসিয়ে প্রসাদ খাওয়াতেন, মাঝে মাঝে নিজে থেকে যেচে সন্দেশ হাতে তাঁঁদের বাড়ি চলে যেতেন। আজ যদি তিনি এসপ্ল্যানেডের মোড়ে অনশনমঞ্চ আর অদূরে রেড রোডে সরকারি কার্নিভাল দেখতেন, কী বলতেন? কিছু বলতে হত না, তাঁর শিকাগোজয়ী শিষ্য নরেন্দ্রনাথ দত্ত ফের আউড়ে দিতেন, “প্রাচীন ধর্ম বলিত, যে ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখে না, সে নাস্তিক। নবীন ধর্ম বলিতেছে, যে আপনাতে বিশ্বাস রাখে না, সে নাস্তিক।”
আরও একটা বিষয়। স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায় বেলুড়ে যখন দুর্গাপুজো শুরু হল, সঙ্কল্প কার নামে হল? সারদা দেবী। তাঁকে কামারপুকুরে স্বামীর ভিটে থেকে টেনে আনা হল, সেই পুজোয় তিনি গোটাটা উপস্থিত থাকলেন। তার আগে দুর্গাপুজো মানে রাজা-রাজড়াদের পুজো। শত্রুবধের কামনায় দুর্গাপুজো করেন দক্ষিণ ভারতে বিজয়নগরের রাজারা, এ দিকে মিথিলা, দারভাঙার রাজারা। বহু পুরাণে দুর্গাপুজোর আর এক নাম তাই রাজসিপূজা, রজস শব্দের আর এক অর্থ রক্ত। ক্ষত্রিয় রাজা বলি দেবেন, দেবীর রজস বা রক্ত তাঁর রক্তে আধিদৈবিক ভাবে মিশে যাবে, তিনি হয়ে উঠবেন রজোগুণসম্পন্ন সর্বজয়ী বীর শাসক।
রজোগুণ, বীরত্বের ধার ধারে নাকি উনিশ শতকের কলকাত্তাইয়া বাঙালি? হুতোম দুর্গাপুজোর বর্ণনায় লিখে গিয়েছেন, “নবাবী আমল শীতকালের সূর্য্যের মতো অস্ত গ্যালো।… নবো মুনসি, ছিরে বেণে ও পুঁটে তেলি রাজা হলো। সেপাই পাহারা, আসা সোটা ও রাজা খেতাপ ইণ্ডিয়া রবরের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়ুনির মতো রাস্তায় পাদাড়ে ও ভাগাড়ে গড়াগড়ি যেতে লাগলো।” বাঙালি আজও খেতাব ভালবাসে। আদাড়েপাদাড়ে বঙ্গশ্রী, বঙ্গভূষণ গড়াগড়ি খায়, কে খবর রাখে! বিনীত গোয়েলদের নামে অযথা গালমন্দ করে লাভ নেই। হুতোম লিখছেন, “থানার সামনে পাহারাওয়ালাদের প্যারেড হয়ে গিয়েচে। এঁরা লড়াই করবেন কিন্তু মাতাল দেখে ভয় পান।”
বাবু সংস্কৃতির মাতাল নয়, উচ্চবর্গের সামন্তপ্রভু ও গির্জার যাজকদের নিয়ে চাষাভুসো ও নিম্নবর্গের মাতলামি, অঙ্গভঙ্গি, হাসি-তামাশাতেই ইউরোপের কার্নিভাল। কেউ মুখোশ পরে ধেইধেই নাচে, কেউ রান্নাঘর থেকে হাঁড়িকড়াই, খুন্তি এনে ঢং-ঢং বাজায়, এক জন ‘সেরা বোকা’কে নির্বাচন করে তার মাথায় মুকুট পরানো হয়। মধ্যযুগে যাজক ও বৈদ্যরা কী করতেন? শরীর দেখতেন, নিদান দিতেন। উচ্চবর্গ আমার শরীরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবে? আমি আমার শরীর ও মুখশ্রী পাল্টে দেব। তাই বিভিন্ন উদ্ভট আকারের মুখোশের মধ্য দিয়েই ঘোষিত হত কার্নিভালের জয়যাত্রা।
বাংলা সাহিত্য এই নন্দিত নরকে এক বারই প্রবেশ করেছে। নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাসে পাগলাটে হারবার্ট সরকারকে মৃত্যুর পর তার ছেঁড়াখোঁড়া তোশক-সহ কেওড়াতলার চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সেই তোশকের নীচে ছিল নকশাল আমলের বোমার মশলা। রাষ্ট্রযন্ত্র আঁচ করতে পারেনি সেই প্রবল বিস্ফোরণ, হারবার্টের মৃত বাবা তার মাকে সুদূর অন্তরিক্ষে বলেন, “তুমি কাঁদছ শোভা? এ তো কার্নিভাল।” শাসকের বিপক্ষে যখন কার্নিভাল, সে আঁচ করতে পারে না কখন কে কী ভাবে অন্তর্ঘাত ঘটাবে!
এই যে খিস্তি-কৌতুক, মধ্যযুগের কার্নিভাল-সাহিত্যে এর অজস্র উদাহরণ আছে। আমাদের মতো ভব্যসভ্য ভিক্টোরীয় ভাষায় ওঁরা কখনও বায়ুনিঃসরণ বলতেন না, সরাসরি বলতেন ‘ফ্ল্যাচুলেন্স’। এক চাষার এক বার সে রকম অবস্থা হল, দেবদূত তাকে নিতে এল। আত্মাকে ধরার জন্য সেই দুর্গন্ধওয়ালা শব্দকে সে থলেতে ভরে নিল। তার পর সেই থলে ও চাষাকে নিয়ে নরকে গেল। চাষার আত্মা তো আর স্বর্গে যাবে না, নরকই তার উপযুক্ত স্থান। সেখানে থলে ফেটে দুর্গন্ধ বেরিয়ে এল। গন্ধে অতিষ্ঠ সবাই রায় দিল, চাষার আত্মা স্বর্গে যাবে না ঠিকই। কিন্তু ওকে নরকে আনারও দরকার নেই। স্বর্গ-নরকের খ্রিস্টীয় ধারণাকে এ ভাবেই ওলটপালট করে দেওয়া হল। কার্নিভাল-সাহিত্যে এই রকম ধারণার প্রাদুর্ভাব কোথা থেকে? সামন্ততন্ত্রে তখন গরিব চাষা জোলারা সবাই একটা ঘরে গাদাগাদি করে থাকে, সকলে সকলের শরীরী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়। তিস্তাপারের বাঘারুর ঢের আগে থেকে ইউরোপের গরিবরা শরীর দিয়ে উচ্চবর্গের ভব্যতাকে প্রত্যাখ্যান করত। কার্নিভাল তারই উৎসব। কার্নিভালের ঐতিহ্য জিশুখ্রিস্ট, স্বর্গ, নরক, পবিত্র আত্মা কিছুই মানে না।
পুরো ঘটনাটাই এক ধরনের সেফটি ভালভ। মধ্যযুগের ইউরোপ ধর্মপ্রাণিত, যাবতীয় ছুটি ও উৎসব ধর্মীয় উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এই দিনটায় ধর্মের বাড়াবাড়ি নেই, ডিউক ও বিশপদের অত্যাচারের বাইরে যা কিছু বলার, যা কিছু করার অধিকার। উনিশ শতকের কলকাতায় বড়লোক জমিদারদের কেচ্ছা নিয়ে জেলেপাড়ার যে সব সঙ বেরোত, সেখানেই কার্নিভালের প্রকৃত উত্তরাধিকার। কোনও ধর্মকথায় নয়, আদালতি প্রতর্কে নয়, ভিনদেশি পর্যটকদের চমৎকৃত করায় নয়, শহরের শোষিত নিম্নবর্গকে এক দিন দ্রোহের অধিকার দেওয়াতেই কার্নিভালের প্রকৃত জৌলুস।